মাদক সেবনে বাধা দেওয়ায় চার বছর আগে চট্টগ্রামে কুকুর লেলিয়ে ছাদ থেকে ফেলে শিক্ষার্থী হিমাদ্রী মজুমদার হিমুকে হত্যার দায়ে পাঁচ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।
Published : 14 Aug 2016, 04:20 PM
বার বার বিলম্বিত হিমু হত্যার বিচার
অপেক্ষার প্রহর গুণছেন হিমুর বাবা-মা
হিমু হত্যা মামলার রায় পিছিয়ে ১১ অগাস্ট
চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ নুরুল ইসলাম রোববার চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অনুপম চক্রবর্তী রায়ের পর বলেন, “৩০২/৩৪ ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত পাঁচজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছে।”
সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া পাঁচ আসামি হলেন- জাহিদুর রহমান শাওন, জুনায়েদ আহমেদ রিয়াদ, তার বাবা শাহ সেলিম টিপু, শাহাদাত হোসেন সাজু ও মাহবুব আলী ড্যানি।
এদের মধ্যে শাওন জামিন নিয়ে এবং রিয়াদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক। কারাগারে থাকা টিপু, সাজু ও ড্যানি রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন বলে অনুপম জানান।
নিয়ম অনুযায়ী আসামিরা সাত দিনের মধ্যে এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। তবে পলাতক আসামিদের সেই সুযোগ পেতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল বন্দরনগরীর পাঁচলাইশ এলাকার সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে হিমুকে ধরে নিয়ে যায় আসামি শাওন, রিয়াদ, সাজু ও ড্যানি। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সদ্য ‘এ’ লেভেল পাস করা হিমুর বয়স তখন ১৮ বছর।
আসামিরা তাকে ধরে পাঁচলাইশ এলাকায় রিয়াদের বাবা ব্যবসায়ী টিপুর বাড়ির ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে আটকে রেখে মারধরের পর হিংস্র কুকুর লেলিয়ে ও ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেওয়া হয় ছাদ থেকে। হাসপাতালে ২৬ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর ওই বছরের ২৩ মে মৃত্যু হয় হিমুর।
হিমু খুনের ঘটনায় তার মামা শ্রীপ্রকাশ দাশ বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় এই হত্যা মামলা করেন। তদন্ত শেষে পুলিশ ২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়।
অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে পাঁচ আসামির বিচার শুরু করে আদালত। ১৮ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
হিমুর মামা শ্রীপ্রকাশ আদালতে তার সাক্ষ্যে বলেন, স্থানীয় মাদকবিরোধী সঙ্গঠন শিকড়ের সদস্য ছিলেন হিমু। আর এ মামলার আসামিরা মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
২০১১ সালের ২৬ অক্টোবর শিকড়ের পক্ষ থেকে এম ইসমাইল নামের একজন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করলে ওই সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে আসামিদের বিরোধের সূত্রপাত হয়।
মাদক সেবনে বাধা দেওয়ার কারণেই কুকুর লেলিয়ে হিমুকে হত্যা করা হয় বলে আদালতে বলেন শ্রীপ্রকাশ।
রাষ্ট্রপক্ষে ২০ জনের সাক্ষ্য শুনে আদালত রায়ের জন্য প্রথমে ২৮ জুলাই ও পরে ১১ অগাস্ট দিন রাখে। দুই দফা পেছানোর পর অবশেষে রোববার পাঁচ আসামির সাজা ঘোষণা করেন বিচারক।
রায় দ্রুত কার্যকর চায় হিমুর পরিবার
রায়ে সন্তোষ জানিয়ে দ্রুত তা কার্যকর দেখতে চেয়েছেন হিমুর বাবা প্রবীর মজুমদার ও মা গোপা মজুমদার।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় গোপা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মা হিসেবে আমি এ রায়ে সন্তুষ্ট। প্রত্যাশা অনুযায়ী আসামিদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।”
রায়ের সময় আদালতে হিমুর বাবা প্রবীর মজুমদার এবং মামা মামলার বাদী শ্রীপ্রকাশ দাশ অসিত আদালতে থাকলেও মা গোপা মজুমদার ছিলেন নগরীর হেম সেন লেইনের বাসাতেই।
ছেলের ছবির সামনে বসে গোপা কাঁদছিলেন বলে স্বজনরা জানান।
গোপা বলেন, “আমার ছেলেকে তো আমি বাঁচাতে পারিনি। সে হাসপাতালে বারবার বাঁচার জন্য আকুতি করছিল। আমি মা হিসেবে আমার সন্তানের জন্য কিছুই করতে পারিনি সেদিন।
“সে যেখানেই থাকুক, এ রায় তো সে দেখেছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা দ্রুত কার্যকর হলে হিমুর আত্মা শান্তি পাবে।”
হিমুর বাবা প্রবীর সাংবাদিকদের বলেন, “বিচার প্রক্রিয়ায় দেরি হলেও রায়ে আমি সন্তুষ্ট। শত বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে আজকের এই জায়গায় এসেছি।”
প্রভাবশালী আসামিদের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা জানিয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত পলাতক দুই আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি।
“আমার ছেলেকে হত্যার পর থেকে অনেক হুমকি পেয়েছি। তাদের পরিবার অনেক প্রভাবশালী।”
রায়ের সন্তষ্ট বাদী শ্রীপ্রকাশ দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রকৃত আসামিরা সাজা পেয়েছে, এতে আমি ও আমার বোনের পরিবারের সদস্যরা খুশি।”
মামলাটি ভিন্ন খাতে নিতে নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় গণমাধ্যমের সহযোগিতার কথাও স্মরণ করেন তিনি।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অনুপম চক্রবর্ত্তী সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ে তারা সন্তুষ্ট এবং আশা করছেন উচ্চ আদালতেও সাজা বহাল থাকবে।
২০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে আদালতের রায় হয় বলে জানান তিনি।
ন্যায়বিচার হয়নি: আসামিপক্ষ
আসামিপক্ষের আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল তা যথাযথ ছিল না। আসামি পক্ষের যুক্তিগুলো ‘কনসিডার’ করা হয়নি।
“এ রায়ে ন্যায়বিচার হয়নি। আমরা উচ্চ আদালতে যাব।”
রায় ঘোষণার সময় আসামির কাঠগড়ায় থাকা টিপুকে অনেকটা স্বাভাবিক দেখা গেলেও সবসময় মাথা নিচু করেই ছিলেন। রায় ঘোষণার পর বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি।
অন্যদিকে সাজু রায় ঘোষণার পর ‘আল্লাহ ভরসা’ বলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানান। অন্য আসামি ড্যানির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।