মামুনুল হকের নাম নেই কমিটিতে, তবে তিনি কারামুক্ত হলে পদ পাবেন বলে আভাস দিলেন এক নেতা।
Published : 31 Aug 2023, 08:05 PM
ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন ‘অরাজনৈতিক সংগঠন’ হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ফিরে এসেছেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনের সময় সহিংসতার পর তাদেরকে বাদ দিয়ে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠনটির কমিটি করা হয়েছিল।
তবে দুই বছর আগের ঘটনায় তুমুল আলোচিত কারাবন্দি নেতা মামুনুল হকের ঠাঁই হয়নি নতুন কমিটিতেও।
কমিটিতে ফিরেছেন হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে ইউসুফ মাদানি। জায়গা পেয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত নেতা মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জামাতা মাওলানা সাখাওয়াত রাজীও।
দুই বছর আগে সহিংসতার মামলার আসামি ও নেজামে ইসলামের নেতা হারুণ ইজাহার ও আজিজুল হক ইসলামাবাদী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামীর নেতা আবদুর রব ইউসুফী ও জুনায়েদ আল হাবিব, খেলাফত মজলিসের নেতা সাখাওয়াত হোসাইন, শোয়ায়েব জমিরিসহ আরও বেশ কয়েকজন রাজনীতিক ফিরেছেন কমিটিতে।
তবে গত দুই বছরে হেফাজতের এই রাজনীতিক নেতাদের রাজনৈতিক অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। কট্টর সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে কেউ কেউ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গড়ে তুলেছেন। কেউ কেউ অবশ্য আগের অবস্থানেই আছেন।
বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগর মাদ্রাসায় হেফাজতের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী নতুন এই পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান সংগঠনের প্রচার সম্পাদক মুফতি কেফায়াতুল্লাহ আজহারী।
তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে গঠিত ১২ সদস্যের সাব কমিটি আজ আমিরে হেফাজতের কাছে নতুন করে কমিটির পদায়নসহ ২১১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি ও ৫৩ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদের তালিকা পেশ করেন।
“আমিরে হেফাজত আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ৫৩ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ এবং ২১১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির উভয় তালিকাকে অনুমোদন করেন।”
মামুনুল হকের কমিটিতে পদ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কেফায়াতুল্লাহ বলেন, “তিনি এখনও কারামুক্ত নন। কারামুক্ত হলে যথাযথ পদায়ন করা হবে।”
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষিত নারী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান শাহ আহমদ শফীকে প্রধান করে করা হয় ‘অরাজনৈতিক সংগঠন’ হেফাজতে ইসলাম। কিন্তু এর নেতাদের প্রায় সবাই ছিলেন ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দলের নেতা।
সে সময় এই নেতাদের বেশিরভাগই ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোটের অংশীদার। ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলার সময় এই আন্দোলনের পুরোধাদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ৫ মে রাজধানী অবরোধ করে। সে সময় সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানান হয়।
তবে গত এক দশকে এই সমীকরণ পাল্টেছে অনেকটাই। পরের কয়েক বছরে হেফাজত নেতাদের অনেকের অবস্থান বদলে যায়। ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক দলগুলোর সিংগভাগই এখন আগের শরিকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না।
তবে আহমদ শফীর মৃত্যুর পর ২০২০ সালে হেফাজতের নতুন কমিটি করা হলে সংগঠনটি আবার রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে। সরকারের সঙ্গে সংঘাতের পরিস্থিতিতেও যায়। এমনও বক্তব্য আসে, দেশ চালাতে হলে তাদের ‘কথামত চলতে হবে’।
হেফাজতের সদ্য ঘোষিত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মীর ইদরিস বলেন, “সবাইকে রাখা হয়েছে। যারা কারা অভ্যন্তরে আছেন তারাও হেফাজতে ইসলামের সদস্য। তাদের শুধু এখন কমিটিতে পদ দেয়া হয়নি। আর কিছু নয়।”
ঘোষিত কমিটিতে হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকার জামিয়া দারুল মাআরিফ মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভীকে।
আমির পদে যথারীতি আছেন শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। দুই সিনিয়র নায়েবে আমির হলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুফতি খলিল আহমদ কাসেমী এবং ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের জামিয়া নুরিয়া আশরাফাবাদ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী।
নতুন কমিটির নায়েবে আমির করা হয়েছে ৪৫ জনকে। এদের একজন প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে ইউসুফ মাদানী। তবে তার আরেক ছেলে আনাস মাদানী স্থান পাননি এই কমিটিতে।
মহাসচিব পদে আছেন সাজিদুর রহমান। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদে আছেন জুনায়েদ আল হাবীব।
যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি হেফাজতের বাতিল হওয়া কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। নেজামে ইসলামের সঙ্গে জড়িত।
১০ যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে আছেন লালখান বাজার মাদ্রাসার মুহাদ্দিস হারুণ ইজাহার। হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের তাণ্ডবের 'মদদদাতা' হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন হারুণ। তার বিরুদ্ধে ২৬টি মামলা ছিল। চলতি বছর ২৩ মে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির ছিলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী। তিনি ২০২০ সালে মারা যাওয়ার পর নানা আলোচনার মধ্যে ওই বছরের ১৫ নভেম্বর সম্মেলনে জুনাইদ বাবুনগরীকে আমির করে হেফাজতের ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছিল।
২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের বিরোধিতা করে হেফাজত বিক্ষোভ ও হরতাল ডাকে। এসময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামে সহিংসতায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়। সংঘাতের অর্ধশত মামলার পর মামুনুলসহ হেফাজতের ডজন খানেক কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের অনেকেই এখনো কারাবন্দি।
সংঘাতময় পরিস্থিতিতে পুলিশের অভিযানে চাপের মধ্যে ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল রাতে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন সংগঠনটির তৎকালীন আমির জুনাইদ বাবুনগরী।
এর দুই মাসের মাথায় ৭ জুন ঢাকার খিলগাঁওয়ের মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে হেফাজতের ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করেন সংগঠনটির মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী। সেই কমিটিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িত সব নেতাকে বাদ দেওয়া হয়।
সবশেষ গত ৫ অগাস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি মাদ্রাসায় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় বিলুপ্ত কমিটির সব সদস্যকে আবার কমিটিতে ফেরানোর বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় বলে হেফাজতের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সেদিনের সভায় সংগঠনের মহাসচিবকে আহ্বায়ক করে ১২ সদস্যের একটি সাবকমিটিও গঠন করা হয়। এরপর মহাসচিব সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের সাবকমিটি বৈঠক করে একটি খসড়া কমিটির তালিকা করা হয়।
বৃহস্পতিবার সাবকমিটির আহ্বায়ক ও হেফাজতের মহাসচিব সাজিদুর রহমানের নেতৃত্ব সাবকমিটির সদস্য মুফতি জসীমুদ্দীন, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব, মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী, মাওলানা আইয়ুব বাবুনগরী, মাওলানা মীর ইদরীস, মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ আজহারী হেফাজতের আমিরের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের বৈঠক শেষে এই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়।
ওই সভায় মামুনুল হকসহ সকল কারাবন্দি সব আলেমের দ্রুত মুক্তি, ২০১৩ সাল থেকে হেফাজত নেতাদের নামে হওয়া সব মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান সংগঠনের আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।
হেফাজতের কমিটিতে ফিরছেন পুরনোরা
হেফাজতের কমিটি বিলুপ্ত: বাবুনগরী
দুই বছর পর জামিনে মুক্ত হেফাজতের হারুন ইজহার
বিলুপ্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হেফাজতের আহ্বায়ক কমিটি
হেফাজতের কর্তৃত্ব বাবুনগরীর হাতে
হেফাজতের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জিহাদী, ঢাকার সেক্রেটারি মামুনুল
গ্রেনেড হামলার জঙ্গিদের ‘ঘনিষ্ঠ’ মামুনুল পাকিস্তানেও ছিলেন: পুলিশ
কোন ওয়াজে কে যাবেন, তাও নিয়ন্ত্রণ করতেন মামুনুলরা: পুলিশ
সহিংসতা আর হেফাজত নেতাদের ওয়াজের ভিডিও খুঁজছে পুলিশ
হেফাজতের সম্মেলন ঘিরে ভাঙনের সুর
একতরফা কাউন্সিল মেনে নেওয়া হবে না: ফয়জুল্লাহ
জামায়াত-বিএনপির ‘হাতে যাচ্ছে’ হেফাজত, অভিযোগ শফী সমর্থকদের
হাটহাজারী মাদ্রাসার কর্তৃত্ব হারালেন আহমদ শফী