গ্রেনেড হামলার জঙ্গিদের ‘ঘনিষ্ঠ’ মামুনুল পাকিস্তানেও ছিলেন: পুলিশ

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় জড়িত জঙ্গিদের ‘ঘনিষ্ঠ’ ছিলেন দাবি করে পুলিশ বলছে, তাদের একজনের সঙ্গে প্রায় দেড় মাস পাকিস্তানেও ছিলেন তিনি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2021, 12:06 PM
Updated : 25 April 2021, 06:44 PM

রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার হারুন অর রশিদ।

নিজ কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “মামুনুল হকের জব্দ করা মোবাইল ফোন থেকে বাবরি মসজিদের নামে কাতার, দুবাই ও পাকিস্তান থেকে টাকা আনার তথ্য-প্রমাণও মিলেছে।”

উপ কমিশনার হারুন বলেন, পুলিশ হেফাজতে সাত দিন জিজ্ঞাসাবাদ করে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটির কেন্দ্রীয় এই নেতার ‘রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের’ কথাও জানতে পেরেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।

মামুনুল হেফাজতে ইসলামকে ‘পাকিস্তানের একটি সংগঠনের আদলে’ পরিচালনা করতে চাইছিলেন জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “তিনি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ছিলেন। জামায়াতের সহায়তায় ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা ভাবনা ছিল তার।”

মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের বিরোধিতায় হেফাজতের বিক্ষোভ কর্মসূচি ও হরতালকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে ব্যাপক তাণ্ডব চলে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণহানিও হয়।

এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকার একটি রিসোর্টে ৩ এপ্রিল এক নারীসহ আটকের পর একাধিক বিয়ের ঘটনায় আলোচনায় আসেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল।

গত ১৮ এপ্রিল দুপুরে ঢাকার মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করার পর মোহাম্মদপুর থানার নাশকতার এক মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মামুনুলকে সাত দিন রিমান্ডে নেয় পুলিশ।

জিজ্ঞাসাবাদে ‘জঙ্গিদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার তথ্য’ উঠে এসেছে জানিয়ে উপ কমিশনার হারুন বলেন, মামুনুলের আপন ভগ্নিপতি মুফতি নিয়ামত উল্লাহ ১৫/২০ বছর পাকিস্তানে ছিলেন। সেখানে তিনি একটা মাদ্রাসায় পড়াতেন। সেখান থেকে দেশে এসে তিনি জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়াতে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার সঙ্গে পরে মামুনুলের বোনের বিয়ে হয়।

“এই নিয়ামত উল্লাহর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িত মাওলানা তাজউদ্দিন। একবার নিয়ামত উল্লাহ গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। তাকে পরে ছাড়িয়ে আনে।

“নিয়ামতের সঙ্গে ২০০৫ সালে পাকিস্তানে গিয়ে ৪৫ দিন ছিলেন মামুনুল। সেখানে বিভিন্ন জঙ্গি ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তখন যোগাযোগ করেন।”

পুলিশ কর্মকর্তা হারুন বলেন, মামুনুলের ভগ্নিপতি পাকিস্তানের ‘গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে’ সেখানে ছিলেন বলে তারা জানতে পেরেছেন।

“আমরা যেটা পেয়েছি, তার সাথে পাকিস্তানি একটা জঙ্গিগোষ্ঠী সরাসরি জড়িত। এটার লিয়াজোঁ করতেন তার ভগ্নিপতি নিয়ামত উল্লাহ।”         

উপ কমিশনার হারুন বলেন, “আমরা তদন্তকালে জেনেছি, মামুনুলের প্রথম স্ত্রীর বাবা আর বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিম ভায়রা ভাই। তবে সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি।”

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও ২৪ জন ওই ঘটনায় নিহত হন।

পরে তদন্তে জানা যায়, মুফতি আব্দুল হান্নানের জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের কর্মীরা বিদেশি জঙ্গিদের সহযোগিতায় ওই গ্রেনেড হামলা চালায়। আর এই ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তখনকার চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’। হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড আনা হয় পাকিস্তান থেকে।

সেই মামলার রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালতে। আর খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

সংবাদ সম্মেলনে উপ পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদ।

পুলিশ কর্মকর্তা হারুন বলেন, মামুনুলকে জিজ্ঞাসাবাদে তার বিদেশ থেকে অর্থ আনার বিষয়েও তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারীরা।

“দেশের বাইরে থেকে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লক্ষ কোটি টাকা এনে তিনি বিভিন্ন মসজিদে-মাদ্রাসায় জঙ্গি, উগ্রবাদী কাজে ব্যবহার করতেন।”

আর এ কাজে তিনি ভারতের বাবরি মসজিদের নাম ব্যবহার করতেন জানিয়ে হারুন বলেন, “কারণটা হল বাবরি মসজিদের নামটা দিলে একটা ইসলামি সেন্টিমেন্ট নেবে; অন্যদিকে ভারত বিদ্বেষী কিছু লোকের সাহায্য সে পাবে। সে কারণে সে বাবরি মসজিদের নাম করে কোটি কোটি টাকা এনেছে বিভিন্ন দেশ থেকে।

“এই টাকা দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদে, বিভিন্ন কাওমি মাদ্রসায় সে উগ্র জঙ্গিবাদি কায়দায় কিছু কিছু লোককে ম্যানেজ করেছে। এবং তাকে যেন বিভিন্ন মাদ্রাসায় ওয়াজ করার জন্য নেওয়া হয়, সে ব্যবস্থা করেছে।”  

মামুনুলকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই মামলায় তার ভাই মাওলানা মাহফুজুল হকও আসামি।

মাহফুজুল হক সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হেফাজত নেতাদের এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না কেন- এই প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, “মন্ত্রীর সাথে দেখা করার বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে যে দোষী তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” 

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলমও শনিবার জানিয়েছিলেন, হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে।

তিনি বলেন, “পাকিস্তানের ‘তেহেরিক-ই-লাব্বায়িক’নামের সংগঠনের আদলে তারা হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশকে গঠন করে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মত এদেশকে গড়ে তুলতে চায়। যার পেছনে জামাত-শিবির রয়েছে।”

ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, দেশের কোন মাহফিলে কে ওয়াজ করবেন, সেটাও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা মাহবুব বলেন, “রাবেতাতুল ওয়ায়েজীন নামের সংগঠনটি বেশ তৎপর। হেফাজতের উগ্রপন্থি নেতারা এর নেতৃত্ব দিচ্ছে। কোথাও কোন ওয়াজ মাহফিল করতে হলে তাদের মাধ্যমে আসতে আয়োজকদের বাধ্য করা হয়।”

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজীন’ এর নেতৃত্বে ছিলেন বলে দাবি করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

নরেন্দ্র মোদীর সফরকেন্দ্রিক বিক্ষোভ থেকে সহিংসতার ঘটনায় সম্প্রতি মামুনুল হকসহ হেফাজতের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

শনিবার গ্রেপ্তার হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আহমদ আবদুল কাদের ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন সাবেক সভাপতি।

আরও পড়ুন