পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিটে তার মৃত্যু হয় বলে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরের নেতা জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি মাওলানা আব্দুর রউফ ইউসুফি জানান।
দেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার ভিত মজবুত করতে তার ভূমিকা এবং ধর্মীয় পাণ্ডিত্যের কারণে বাংলাদেশে দেওবন্দের অনুসারী আলেমদের কাছে শতবর্ষী আহমদ শফী ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র, তাকে ডাকা হত বড় হুজুর বলে।
তবে নারী শিক্ষার বিরোধিতা, ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যায়িত করে নানা বক্তব্য এবং বাঙালি সংস্কৃতির নানা অনুসঙ্গ ও প্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থানের কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছেন বার বার।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর তার বিরোধিতায় হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে মাঠে নেমে আহমদ শফী সারা দেশে পরিচিতি পান।
তার জন্মসাল নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেননি হেফাজতে ইসলামের জ্যেষ্ঠ নেতারা। তবে ইসলামি ঐক্যজোটের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেছেন, শাহ আহমদ শফীর বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর।
দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্টে ভোগার পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত কারণে গত কয়েক বছর ধরেই আহমদ শফীর স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছিল। শিক্ষার্থীদের আকস্মিক বিক্ষোভের জেরে বৃহস্পতিবার তিনি হাটহাজারী মাদ্রাসার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান এবং এর পরপরই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ইসলামী ঐক্য জোটের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আলতাফ হোসেন বলেন, “চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ থেকে উনাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনে সন্ধ্যার আগে আগে আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ভর্তির পরপরই তিনি ইন্তেকাল করেন।”
দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত দেশের অন্যতম পুরনো এ কওমি মাদ্রাসার শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন।
কওমি মাদ্রাসার নেতৃত্বের উপর ভর করেই তিনি ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে আসা হেফাজতে ইসলামের আমিরের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আহমদ শফীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইসলামি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে তার ‘গুরুত্বপূর্ণ অবদানের’ কথাও তারা স্মরণ করেছেন।
আহমদ শফীর ছেলে হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক আনাস মাদানী শুক্রবার রাতে আসগর আলী হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, শনিবার দুপুরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার বাবার জানাজা হবে। পরে মাদ্রাসার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর খবরে শুক্রবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালের সামনে ভিড় করেন তার অনুসারীরা
হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর শুক্রবার সন্ধ্যায় পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তার ছেলে আনাস মাদানি।
শতবর্ষের এক অধ্যায়
শাহ আহমদ শফীর জন্ম চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাখিয়ারটিলা গ্রামে। তার বাবার নাম বরকম আলী, মা মোছাম্মাৎ মেহেরুন্নেছা বেগম। আহমদ শফী দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জনক।
তার দুই ছেলের মধ্যে আনাস মাদানি হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক। অন্যজন মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ পাখিয়ারটিলা কওমি মাদ্রাসার পরিচালক।
শফীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায়। এরপর পটিয়ায়র আল জামিয়াতুল আরাবিয়া মাদ্রাসায় (জিরি মাদ্রাসা) লেখাপড়া করেন। ১৯৪০ সালে তিনি হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় যান, সেখানে চার বছর লেখাপড়া করেন।
১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে যোগ দেন আহমদ শফী। এরপর থেকে টানা ৩৪ বছর ধরে তিনি ওই পদে ছিলেন। বাংলায় ১৩টি এবং উদুর্তে নয়টি বইয়ের রচয়িতা তিনি।
শফীর বয়স হওয়ায় হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি বিরোধ দেখা দেয়। মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম বা সহকারী পরিচালকের পদে থাকা হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী ছিলেন শীর্ষ পদের অন্যতম দাবিদার, কিন্তু শফী সমর্থকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে কযেক মাস আগে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
শাহ আহমদ শফী (ফাইল ছবি)
তারা শফীর অব্যাহতি এবং তার ছেলে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানির বহিষ্কার দাবিতে বিভিন্ন কক্ষে ভাংচুরও চালায়।
তাদের অন্য দাবির মধ্যে ছিল- আনাস মাদানি কর্তৃক অব্যাহতি দেওয়া তিন শিক্ষককে পুনর্বহাল, আনাসের নিয়োগ দেওয়া সব ‘অযোগ্য ও বদ আখলাকের’ শিক্ষক ও স্টাফকে ছাঁটাই এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর সব ধরনের জুলুম ও হয়রানি বন্ধ করা।
বুধবার মাদ্রাসার শূরা কমিটি বৈঠক করে আনাস মাদানিকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিক্ষুব্ধরা শান্ত হলেও সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার গুঞ্জনে তারা বৃহস্পতিবারও নামে বিক্ষোভে।
এই পরিস্থিতিতে সরকার কওমি মাদ্রাসাটি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও অধ্যক্ষকে বৃহস্পতিবার একটি চিঠি পাঠায় কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।
ওই চিঠি পাওয়ার পর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে রাতে আহমদ শফীর নেতৃত্বে বৈঠকে বসে মাদ্রাসার শূরা কমিটি। সেখানে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন ‘বড় হুজুর’ শফী।
শূরা কমিটির ওই বৈঠকে শফীর ছেলেসহ দুই শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে হাটহাজারী বড় মাদ্রাসায় দৃশ্যত আহমদ শফীর সুদীর্ঘ দিনের কর্তৃত্বের অবসান ঘটে।
সেই বৈঠকের পরপরই আহমদ শফীকে মাদ্রাসা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলে। শুক্রবার বিকালে ঢাকায় নিয়ে আসার পর সন্ধ্যায় তার জীবনের অবসান ঘটে।