পদ হারালেন বাবুনগরী

চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ হারিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2020, 01:37 PM
Updated : 18 June 2020, 02:13 PM

তার জায়গায় হাটহাজারী মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস (শিক্ষক) মাওলানা শেখ আহমদকে সহকারী পরিচালক করা হয়েছে।

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল প্রায় সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলা মাদ্রাসা পরিচালনার সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম (শুরা কমিটির) সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়।

হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক (মুহতামিম) পদে থাকছেন শাহ আহমদ শফীই।

শুরা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমৃত্যু মাদ্রাসার মুহতামিম পদে থাকবেন তিনি। কাউকে ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম বা দায়িত্বপ্রাপ্ত করা হয়নি।

শাহ আহমদ শফীর ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ শফি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শুরা কমিটির সভায় আজীবন মুহতামিম পদে আল্লামা শাহ আহমদ শফী থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। উনাকে সহযোগিতা করবেন নতুন সহকারী পরিচালক মাওলানা শেখ আহমদ।

“আগে সহকারী পরিচালক পদে জুনাইদ বাবুনগরী সাহেব দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি আর সে পদে থাকবেন না।”

বাবুনগরীর পদে এসেছেন ওই মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা শেখ আহমদ।

তবে শুরা কমিটির সভায় কারও অভিযাগে বা আপত্তির ভিত্তিতে সহকারী পরিচালক পদে পরিবর্তন এসেছে কি না তা জানাতে পারেননি মোহাম্মদ শফি।

নতুন সহকারী পরিচালক মাওলানা শেখ আহমদ হেফাজত আমির শফীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে জুনাইদ বাবুনগরীর ব্যক্তিগত সহকারী ইনামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিদ্ধান্ত হুজুর (বাবুনগরী) শুনেছেন। এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে তিনি সিনিয়রদের সাথে আলাপ করছেন। পরে জানাতে পারব।”

হেফাজতের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী হাটহাজারী মাদ্রাসার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদটি হারালেন বুধবারের এই সিদ্ধান্তের ফলে।

এই সিদ্ধান্তের পর গতমাস থেকে বাবুনগরীর পক্ষে তৎপর হাটহাজারী ওলামা পরিষদের নেতা মো. মীর ইদ্রিস শুরা কমিটির সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আগেও বলেছি পরবর্তী বিষয়গুলো নিয়ে শুরা যেন সিদ্ধান্ত নেয়। এককভাবে কেউ যেন সিদ্ধান্ত না দেন।

“এখন শুরা সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এটাই আমাদের চাওয়া ছিল।”

এদিকে বিকেলে মাদ্রাসায় বৈঠক শেষে শুরা কমিটির অন্য সদস্যরা হাটহাজারী থেকে যার যার গন্তব্যে চলে গেছেন।

বৈঠক শেষে সহকারী পরিচালক পদে পরিবর্তনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মাদ্রাসা ও সংলগ্ন এলাকায় দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। যান চলাচলও হাতে গোনা।

হাটহাজারী মাদ্রাসা

এর আগে সকাল থেকেই হাটহাজারী উপজেলার প্রবেশপথগুলোতে এবং মাদ্রাসার আশপাশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও দুইজন সহকারী কমিশনারসহ স্থানীয় প্রশাসনের লোকজনও মূল সড়কে পুলিশ ও র‌্যাবের সাথে ছিল।

বুধবার দুপুর থেকেই হাটাহাজারী ও সংলগ্ন এলাকায় ভারী বৃষ্টি হওয়ায় সড়কে জনসমাগমও কমে যায়।

হাটহাজারী মাদ্রাসার শুরা কমিটির কয়েকজন সদস্য ইতোমধ্যে মারা গেছেন। বুধবারের বৈঠকে শুরার ১১ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

এদের মধ্যে বর্তমান মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী ছাড়াও ছিলেন বেফাকের মহাসচিব ও ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, ফরিদাবাদ মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মুফতি নুরুল আমিন, মাওলানা আবুল কাসেম ভুইয়া, মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, কক্সবাজার বড়ইতলি মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা ছোহাইব নুমানী, কক্সবাজারের মাওলানা আবুল হাসান, শুলকবহর মাদ্রাসার মুহাদ্দিস মাওলানা ওমর ফারুক, মেখল মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা নোমান ফয়েজী, ফতেপুর মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও নানুপুর মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা সালাহ উদ্দিন নানুপুরি।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠা এই মাদ্রাসার মুহতামিম পদটি এই ঘরানার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হাটহাজারী উপজেলার আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত বাংলাদেশের অন্যতম বড় ও পুরনো কওমি মাদ্রাসা।

শাহ আহমদ শফী

এ মাদ্রাসার মহাপরিচালক (মুহতামিম) শাহ আহমদ শফী বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতি।

৯৫ বছরের বেশি বয়সী শফীই ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে আসা হেফাজতে ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা ফেরত আহমদ শফী ১৯৮৬ সালে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক পদে যোগ দেন।

হাটহাজারী মাদ্রাসার শীর্ষ পদে শাহ আহমদ শফীর উত্তরসূরি কে হবেন, তা নিয়ে তৎপরতায় দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে মে মাসের মাঝামাঝিতে।

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরীকে হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক (নায়েবে মুহতামিম) করা হয় ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই শুরা কমিটির এক সভায়।

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ আহমদ শফী মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে কারো নাম ঘোষণা করতে পারেন- এমন গুঞ্জন শোনা গেলে গত ১৫ মে রাত থেকেই বাবুনগরীর অনুসারীরা তৎপর হয়।

১৫ মে রাতে ও ১৬ মে সকালে দুই দফা নিজের অনুসারী হাটহাজারী ওলামা পরিষদের নেতাদের নিয়ে বৈঠকও করেন জুনাইদ বাবুনগরী।

১৬ মে ওই বিষয়ে আলোচনা করতে আহমদ শফীর সঙ্গে দেখা করেন মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা। তখন জুনাইদ বাবুনগরীও উপস্থিত ছিলেন।

জুনাইদ বাবুনগরী

সেদিন দুপুরে হাটহাজারী মাদ্রাসার মসজিদে নামাজে অংশ নিয়ে বাবুনগরীর অনুসারীরা হাটহাজারী ওলামা পরিষদের নেতারা মসজিদের মাইকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নিয়োগের গুঞ্জন নিয়ে বক্তব্যও দেন।

এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা কথা আসতে শুরু করলে সেদিন রাতেই অসুস্থ আহমদ শফী এক ভিডিও বার্তায় বলেন, কাউকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক বা সহকারী পরিচালক পদ তিনি দেননি।

এরপর উত্তেজনা কিছুটা স্তিমিত হলেও ভেতরে ভেতরে এ নিয়ে তৎপরতা চলতেই থাকে।

হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম পদে পরিবর্তন আসছে এমন আলোচনা জোরেশোরে চলতে থাকে। আলোচনায় আসে তিন জনের নামও।

বাবুনগরীর পাশাপাশি শোনা যেতে থাকে মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা শেখ আহমদ এবং সিনিয়র শিক্ষক আহমদ দিদার কাসেমীর নাম। এদের মধ্যে দিদার কাসেমী সাবেক মুহতামিম মাওলানা আব্দুল ওয়াহাবের ছেলে।

এর মধ্যে ৭ জুন আবার অসুস্থ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন আহমদ শফী। ১৫ জুন সুস্থ হয়ে মাদ্রাসায় ফিরেই শুরা বৈঠকের উদ্যোগ নেন তিনি।

এর আগে হেফাজতের আমীরের গত ১১ এপ্রিল হজম ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ায় নগরীর বেসরকারি সিএসসিআর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।

পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে এর তিন দিন পরেই তাকে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে গেণ্ডারিয়ার আজগর আলী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৬ এপ্রিল তিনি চট্টগ্রামে ফেরেন।