হেফাজতের সম্মেলন ঘিরে ভাঙনের সুর

হেফাজতে ইসলামের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে যে সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে, তার কোনো বৈধতা নেই বলে দাবি করছে একটি পক্ষ।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Nov 2020, 12:25 PM
Updated : 12 Nov 2020, 12:25 PM

এই কাউন্সিলকে ঘিরে হেফাজতে ইসলামের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম আর থাকবে না বলে মনে করছেন প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর অনুসারীরা।

রোববার সকালে হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় কাউন্সিল আহ্বান করেছে এক পক্ষ।

এতে সারাদেশের জেলা প্রতিনিধিসহ প্রায় পাঁচশ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

তবে প্রয়াত আমির আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানিসহ অনুসারীরা কাউন্সিলের দাওয়াত পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিনিধি সম্মেলন হলেও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন জ্যেষ্ঠ আলেমদের ১৫ জনের শুরা কমিটি। এতে হেফাজতে ইসলামের আমীর ও মহাসচিব নির্ধারণ করা হবে।

এছাড়া অন্য কয়েকটি শীর্ষ পদেও পরিবর্তন আসতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।

প্রতিনিধি সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন নাজিরহাট আল জামিয়া আল আরাবিয়া নছিরুল ইসলাম মাদ্রাসার শুরা সদস্য ও ফটিকছড়ি বাবুনগর মাদ্রাসার মুহতামিম মহিবুল্লাহ বাবুনগরী। তিনি মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরীর মামা।

হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিনিধি সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দসহ জেলা নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। প্রায় পাঁচশ জনকে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে ।”

রোববার সকাল ১০টায় হাটহাজারী মাদ্রাসায় সম্মেলন শুরু হবে। নায়েবে আমির হিসেবে মহিবুল্লাহ সভাপতিত্ব করবেন বলে জানান ইসলামাবাদী।

হেফাজতের এক কর্মসূচিতে আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী (ফাইল ছবি)

হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দিন রুহী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যিনি (মহিবুল্লাহ বাবুনগরী) কাউন্সিল আহ্বান করেছেন, তিনি হেফাজতের কেউ নন। তিনি তো হেফাজত থেকে পদত্যাগ করেছেন। হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন, এমনকি হেফাজতের বিরুদ্ধেও বক্তব্য দিয়েছেন।”

কাউন্সিলের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “এই কাউন্সিলের কোনো বৈধতা নেই। একটা পকেট কমিটি হবে। হেফাজতে ইসলামের যে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম তা বিনষ্ট হয়ে যাবে। একটা গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই কাউন্সিল করা হচ্ছে।”

কওমী মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি এবং প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়ায় অভ্যন্তরীণ বিরোধে দুই বছর আগে হেফাজতের নায়েবে আমির পদ ছেড়েছিলেন মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।

কাউন্সিল আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে মাঈনুদ্দীন রুহী বলেন, “আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি ১৫১ জনের। তারা বাকি লোক কোথায় পেলেন? তাদের খাতিরের লোকজনকে দাওয়াত দিয়েছে। বলা হচ্ছে, দেশের শীর্ষ আলেমদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের শীর্ষ আলেমরাই তো দাওয়াত পাননি।

“যে ছয়জন কাউন্সিল আয়োজনের কাজ করছেন বলে জেনেছি তাদের মধ্যে চারজন চট্টগ্রাম মহানগর বা উত্তর, দক্ষিণের কেউ না। তাই তাদের অনুসারীরাই আমন্ত্রণ পাবে।”

সম্মেলনে আনাস মাদানীসহ তার অনুসারীরা দাওয়াত না পেলেও প্রয়াত শফীর বড় ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রয়াত আমির আহমদ শফীর অনুসারী এবং চরমোনাইর পীরের অনুসারীদের বাদ দিয়ে কাউন্সিলে দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ মাঈনুদ্দীন রুহীর।

আজিজুল হক ইসলামীবাদীর কাছে মহিবুল্লাহ বাবুনগরীর পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “উনার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। উনি নায়েবে আমির আছেন।

“নেতৃত্ব নির্বাচনে আমাদের কোনো ভোটের পদ্ধতি নেই। সবার মতামত নিয়ে তারপর শুরা সিদ্ধান্ত নেবেন। কোনো পদে কেউ প্রার্থী নেই। শুরাই আলোচনা করে ঠিক করবে, কে কোন পদ পাবেন।”

হেফাজত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে জোর গুঞ্জন নতুন আমির পদে জুনাইদ বাবুনগরীকে চান তার অনুসারীরা। আর মহাসচিব পদে বর্তমান নায়েবে আমির নূর হোসাইন কাসেমীর নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায়।

আহমদ শফীর অনুসারী মাঈনুদ্দীন রুহী বলেন, “শুনছি তারা নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করতে চান। আর জুনাইদ বাবুনগরী নিজেই আমির হতে চান।

“নায়েবে আমির যদি নিজেই মহাসচিব হন, তাহলে সংগঠনের চেইন অব কমান্ড তো থাকবে না। নূর হোসাইন কাসেমী ২০ দলীয় জোটের এক দলের নেতা। হেফাজতের গঠনতন্ত্রে আছে, দলীয় কেউ মহাসচিব হতে পারবে না।”

নূর হোসাইন কাসেমী ২০ দলীয় জোটের অংশীদার জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে গণজাগরণ আন্দোলন শুরুর পর তার বিরোধিতায় নেমে আলোচনায় উঠে আসে হেফাজতে ইসলাম। তার আগেই গঠিত এই সংগঠনের আমিরের পদে ছিলেন আহমদ শফী।

হেফাজতের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমিরের দায়িত্বে ছিলেন শাহ আহমদ শফী (ফাইল ছবি)

শফীর বয়স হওয়ায় হাটহাজারী মাদ্রাসায় তার উত্তরসূরি নির্বাচন নিয়ে তার অনুসারী এবং বাবুনগরীর অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয় চলতি বছর।

মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম বা সহকারী পরিচালকের পদে থাকা জুনাইদ বাবুনগরী ছিলেন মাদ্রাসাটির শীর্ষ পদের অন্যতম দাবিদার। কিন্তু শফীর ছেলে আনাস মাদানির সঙ্গে তার দ্বন্দ্বে মাদ্রাসায় অস্থিরতা দেখা দেয়।

এর জেরে গত ১৭ জুন সহকারী পরিচালকের পদ হারান বাবুনগরী। শফী সমর্থকরা সেই দফা টিকে গেলেও তার রেশ থেকে যায়।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকার পর মাদ্রাসা খোলা হলে সেপ্টেম্বরে আকস্মিকভাবে কয়েকশ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভের মুখে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসার শুরা কমিটি বৈঠকে আনাস মাদানিকে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। আর মুহতামিম আহমদ শফী নিজের পদ ছেড়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মারা যান আহমদ শফী। তার জানাজায় জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে জুনাইদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে।

হেফাজতে ইসলামের বর্তমান মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী (ফাইল ছবি)

শফীর মৃত্যুর পর হাটহাজারী মাদ্রাসায় ফেরেন জুনাইদ বাবুনগরী; হেফাজতের নতুন নেতৃত্ব গঠনে তার সমর্থকরা সক্রিয় হয়।

এর মধ্যে গত ২৫ অক্টোবর নাজিরহাট মাদ্রাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে ফটিকছড়ির আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী হেফাজত আমির হিসেবে জুনাইদ বাবুনগরীকে দেখতে চাওয়ার কথা জানান।

দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা হেফাজতের নেতারা সম্প্রতি ফরাসি সাময়িকীতে হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে ব্যঙ্গচিত্রের প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন, যাতে জুনাইদ বাবুনগরী ও কাসেমি ছিলেন নেতৃত্বে।