কী ঘটেছিল অবন্তিকার সঙ্গে?

ফেইক ফেইসবুক আইডিতে লেখালেখি নিয়ে তৈরি হয় বিরোধ। পরে অবন্তিকাকে সহপাঠীরা বলতে গেলে ‘এক ঘরে’ করে ফেলেন। এর মধ্যে মারা যান বাবা। সব মিলিয়ে ‘খুব অসহায়’ অবস্থায় পড়ে যান তিনি।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2024, 07:25 PM
Updated : 18 March 2024, 07:25 PM

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বাকি ছিল আর মাত্র একটি সেমিস্টার। তার আত্মহুতির ঘটনা জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্ন, অনেক আক্ষেপ।

সহপাঠী, বন্ধু আর স্বজনদের মনে প্রশ্ন, কী এমন ঘটেছিল যে নিজের জীবন নিজের হাতে শেষ করতে হল? তাদের আক্ষেপ এ কারণে যে, অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা কেবল নয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও মেয়েটি ছিল উজ্জ্বল।

নয়টি সেমিস্টারের মধ্যে দুটিতে দ্বিতীয় এবং বাকি সাতটিতে প্রথম স্থান পাওয়া মেয়েটির মৃত্যুর পর বিক্ষুব্ধ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা।

সহপাঠী, বন্ধু, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বেশ কয়েকজন চরিত্রের সন্ধান মিলেছে, যারা অবন্তিকার জীবনকে প্রভাবিত করেছেন নানাভাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বিমান চালানো শিখতে চলে যান অবন্তিকা। কিন্তু কয়েক মাস পরে ফিরে আসেন। সে কারণে তাকে পরের ব্যাচের সঙ্গে ক্লাস শুরু করতে হয়। সহপাঠীদের সঙ্গে দূরত্বের সূচনা তখন থেকেই। ক্লাসে অনেকগুলো বলয়ে বন্ধুত্ব চললেও কোনোটির অংশ হতে পারেননি এই তরুণী।

ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আর নানা ঘটনায় অবন্তিকার বাবাকেও একাধিকবার ডেকে আনা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার সামনেই মেয়েকে দোষারোপ করা হয়েছে।

সেই বাবাও যখন গত বছর এপ্রিলে পৃথিবী ছেড়ে গেলেন, অবন্তিকা তখন মানসিকভাবে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েন বলে তার একজন শিক্ষকের ভাষ্য। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “উপরে অনেক শক্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে ও (অবন্তিকা) একদমই ভেঙে পড়েছিল।”

অবন্তিকা যখন হলে থাকতেন, তখন তার পাশের কক্ষে থাকতেন এক বন্ধু। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা সব সময় ‘চাপে’ রেখেছে অবন্তিকাকে।

গত ১৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন এলাকার বাসায় আত্মহত্যা করেন ২৫ বছর বয়সী এই তরুণী। তার আগে নিজের ফেইসবুক আইডিতে এমন মৃত্যুর জন্য দায়ী করে যান দুইজনকে। তারা হলেন-সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।

আম্মান তাকে অনলাইন ও অফলাইনে ‘হুমকির ওপর রাখতেন’ এবং সহকারী প্রক্টরকে অভিযোগ দেওয়ার পর তিনিও ‘হুমকি ধমকি দিয়েছেন’–এমন অভিযোগের কথা লিখে গেছেন অবন্তিকা।

এই ঘটনায় আম্মানকে বহিষ্কার ও দ্বীন ইসলামকে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপকের পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন দ্বীন।

অবন্তিকার মা মামলা করার পর দুজনই গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

ভুয়া নামে ফেইসবুক আইডি থেকে শুরু

একই ক্লাসের রায়হান সিদ্দিকী আম্মানের সঙ্গে অবন্তিকার যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল, তার মূলে ছিল ফেইসবুকে খোলা একটি ফেইক আইডি। আর সেই আইডি খোলার কারণ ছিলেন তাদের সহপাঠী এক ছাত্রী।

তারা দুইজনই বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে সিট পান। ওই ছাত্রী থাকতেন ১৫ তলায়, আর অবন্তিকা ১৬ তলায়।

অবন্তিকার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ও চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী নসিন তাবাস্সুম প্রাপ্তি বলেন, “অবন্তিকার বিষয়ে অনেকের কাছে বাজে কথা ছড়িয়েছিল মেয়েটা। ক্লাসের কয়েকজনের নামেই সে এমন মন গড়া কথা ছড়িয়েছিল। ওর স্বভাবই এমন, ও একজনের কথা অন্যকে বলে বেড়ায়, কিন্তু সেটার দোষ আসে অবন্তিকার ওপর। অবন্তিকার বাবা মায়ের নামেও সে বিভিন্ন জনের কাছে বাজে কথা ছড়ায়।”

প্রাপ্তি বলেন, ক্লাসে যাদের নামে কথা রটানো হয়েছিল, তারা মনে করত এগুলো অবন্তিকার কাজ।

“তাদের ভুল ভাঙানোর জন্য, আর ওই মেয়েটাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য অবন্তিকা ফেইসবুকে ‘Rahman Shikder’ নামে একটা ফেইক অ্যাকাউন্ট খোলে। সেখান থেকে আম্মান, রাফি, বন্যা, রিমি, আঁখি, মাহিয়াসহ নিজের নামেও বাজে মন্তব্য করে। এটাই ওর জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়।”

অবন্তিকা যে ওই ফেইক আইডি থেকে ক্লাসের নানা জনের নামে নেতিবাচক মন্তব্য লিখতেন, এমনকি নিজের নামেও, সে কথা আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহও বলেছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা নিয়ে কোতয়ালি থানায় একটা জিডি করেছিল ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে। এমনকি অবন্তিকা নিজেও ছিল তাদের মধ্যে।

“পুলিশ বলেছিল, এটা যে করেছে তাকে তারা বের করে ফেলবে। অবন্তিকা তখন বন্ধুদের কাছে স্বীকার করে যে, এটা সেই করেছে। বিষয়টা পরে মীমাংসা হয়ে যায়, কিন্তু জিডি তারা তোলেনি। এ নিয়ে টানাপড়েন লেগেই ছিল।”

অবন্তিকার যে সহপাঠীর কথা প্রাপ্তি বলছেন, তার বক্তব্য শুনতে গত দুই দিনে তাকে বহুবার ফোন করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তিনি ধরেননি। পরে নম্বরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

জিডি নিয়ে দুশ্চিন্তা

ফেইক আইডির ঘটনা নিয়ে সহপাঠীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তো ছিলই, পরের দিনগুলোতে ওই জিডি নিয়ে অবন্তিকার মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। 

তার হল জীবনের এক বন্ধু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অবন্তিকা যে ফেইক আইডি খুলেছিল, সেজন্য সে নিজেও গিলটি ফিল করত। জিডি তোলেনি বলে টেনশন করত। ভাবত এটা যদি ভবিষ্যতে ওর জন্য ঝামেলা তৈরি করে?”

যদিও পুলিশের এক কর্মকর্তা এখন বলছেন, সেই জিডি আসলে তুলে নেওয়া হয়েছিল এক মাসের মধ্যে।

ওই জিডির বিষয়ে সে সময় তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কোতোয়ালি থানার এস আই রুবেল খান। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ২০২২ সালের ৪ অগাস্ট ওই সাধারণ ডায়েরি করা হয়, ২৮ অগাস্ট সেটি তুলে নেওয়া হয়।

“জিডি অবন্তিকার নামে ছিল না। বলা হয়েছিল, ‘অজ্ঞাতনামা কে বা কারা’ ফেইক আইডি দিয়ে আইন বিভাগের অনেকের নামে অপপ্রচার করছিল। ওই আইডি থেকে অবন্তিকার নামেও লিখছিল কিছু।

“এটা কয়েকদিন আমি দেখেছিলাম। পরে প্রক্টরিয়াল বডি দায়িত্ব নিল, প্রক্টর বলল যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এটার সমাধান করবে। জিডি নিষ্ক্রিয় করার জন্য অবন্তিকার বাবাও লিখিত দিয়েছিলেন। আম্মানও জিডি উইথড্রও করে নিয়েছিল।”

আম্মানরা কী করেছেন?

সহপাঠী ও স্বজনরা বলছেন, আম্মান ও তার বন্ধুদের কাছে থেকে ‘বুলিংয়ের’ শিকার হয়েছেন অবন্তিকা। তার সঙ্গে যেন অন্যরা না মেশে, সে জন্য ভূমিকা রাখেন আম্মান ও তার বন্ধুরা।

অবন্তিকা ও চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী নসিন তাবাসসুম প্রাপ্তি ছিলেন খুবই ঘনিষ্ঠ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে প্রাপ্তি বলেন, “অবন্তিকার চরিত্র নিয়েও ওরা খারাপ কথা বলত। অবন্তিকা পুরো একা হয়ে যায়। ক্লাস সে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ও উপরে উপরে অনেক স্ট্রং দেখালেও ও ভেতরে ভেঙেচুরে গেছিল। ওকে বলত ‘নষ্ট মেয়ে’।

“ওর শুভাকাঙ্ক্ষী যারা আছে, তাদের সঙ্গে সে কথা বলা কমিয়ে দেয়। সে চাইত না, তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে নিয়ে কোনো বিরূপ ধারণা পোষণ করুক। ওর বিরুদ্ধে রিউমার ছড়াত আম্মানসহ ওর ওই ক্লাসমেটরা।”

অবন্তিকা যখন হলে থাকতেন, তখন তার পাশের কক্ষে থাকা সেই বন্ধু জানান, অবন্তিকার সঙ্গে চলার কারণে বিভিন্ন সময়ে তাকেও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের মুখে পড়তে হয়েছে।

তিনি বলেন, “ও (অবন্তিকা) যতটুকু বলেছিল, ওকে অনেক কথা শোনাত। ওর বিষয়ে অন্যদের বলত ‘এতকিছুর পর এখনও ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। এ রকম মেয়ের সঙ্গে কেন মিশছ? ও সাইকো। ওর অনেক ঝামেলা আছে’।

“ওর বাবা-মায়ের নামে বাজে কথা বলত। এটা ও নিতে পারে নাই।”

আম্মান ও তার বন্ধুদের ‘এসব কর্মকাণ্ডে’ অবন্তিকা তার ক্লাসে অনেকটা একা হয়ে গিয়েছিলেন। এক বছর আগে বাবাকে হারিয়ে আরো ধাক্কা খান তিনি। সব মিলিয়ে তার জীবনে নানা জটিলতা তৈরি হয়।

অবন্তিকাকে কতটা মানসিক পীড়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে তার মা তাহমিনা শবনম  বলেন, “ঢাকায় মেয়েটা কলতাবাজারে ছিল। ইউনিভার্সিটির ছেলেগুলা ওই বাসা পর্যন্ত গিয়ে জানাইছে যে- ওর নামে জিডি আছে। ওই বাসার মেয়েরা তো এসব জানার কথা না। আমার মেয়ে এসে বলছে, ‘মা ওরা তো আমাকে এইভাবে মেন্টাল টর্চার করতেছে। আমি পড়তে পারছি না’।”

বাবার মৃত্যু নিয়েও অবন্তিকাকে হয়রানি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মেয়েটাকে বলত, ‘তোর বাবার কাছে তুই যাস নাই? তোর বাবা হাসপাতালে ছিল, তুই প্রোগ্রাম করিস’।

“আমাকে বলছিল, ‘মা একটা জিডি কর।’ আমি চাই নাই। আমি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করছিলাম। আমি গত বছর আমার হাজবেন্ড হারাইছি, এখন আমার মেয়েকে হারাইলাম।

“আমার ভুল হইছে, মেয়েটার পায়ে একটু সমস্যা ছিল, ওকে আমি ওখান (বিমান প্রশিক্ষণ) থেকে নিয়ে আসছিলাম। ওরা দিতে চায় নাই। আমি উইথড্রো করে ওকে নিয়ে আসছিলাম।”

অবন্তিকাকে ‘নিঃসঙ্গ করে দেওয়া হয়’

অবন্তিকার শিক্ষক ও আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তির কিছুদিন পরেই সে (অবন্তিকা) চলে গেল জিডি পাইলটে। সম্ভবত ট্রেনিংয়ের অভিঘাত ওর বাবা-মা সহ্য করতে পারে নাই। ও চলে এল। আমরা খুশিই হলাম।

“ওই যে এসেই পরের ব্যাচের সঙ্গে যুক্ত হওয়া, ওই বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে নাই। একটা গ্যাপ থেকে গেছে। আমার মনে হয়, এই দূরত্বটাই ঘোঁচেনি।

তিনি বলেন, “ক্লাসের যে বন্ধু বলয়, তার মধ্যে নানা মেরূকরণ আছে। ওর সার্কেলটা তেমন সুগঠিত না। বাকি সার্কেলগুলোতে ‘গলায় গলায় পিরিতি’ ছিল। ও হঠাৎ করে ফার্স্ট হয়ে যাচ্ছে, এটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এগুলো মিলে ওর মধ্যে একটা হতাশাবোধ ছিল।”

‘বন্ধুহীন’ হয়ে গিয়ে এক পর্যায়ে হল ছেড়ে মেসে ওঠেন অবন্তিকা।

চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী নসিন তাবাস্সুম প্রাপ্তির স্নাতক শেষ বর্ষের পরীক্ষার এক মাস বাকি থাকতে তিনি অবন্তিকার সঙ্গে তার নতুন বাসায় ওঠেন। মেস জীবনে অবন্তিকার ‘দশা’ দেখে তিনি চমকে ওঠেন।

প্রাপ্তি বলেন, “ও (অবন্তিকা) মানুষজনকে এত ভয় পাওয়া শুরু করেছিল, যে নতুন বাসায় নতুন মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেই ভয় পাচ্ছিল। ওর মনে হতে থাকে, সবাই ওকে ধোঁকা দেবে।

“আমি নতুন বাসার প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে গিয়ে গিয়ে ওর বিষয়ে শর্ট ব্রিফ দিয়ে যাই, যেন হলের মত ঘটনা ফের না ঘটে। আমি ওর মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য আমার গ্রামের বাড়িতেও নিয়ে যাই।”

প্রাপ্তি বলেন, “অবন্তিকার বাবা মারা যাওয়ার পর ওর বন্ধুদের একজন ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, ‘এখন কারো আব্বু মারা গেছে দেখে যদি কেউ সুইসাইড করে, তাহলে কিন্তু আমরা দায়ী থাকব না’।”

বাবার মৃত্যুতে মানসিক আঘাত

গত বছরের এপ্রিলে অবন্তিকার বাবার মৃত্যু তাকে ‘খুব অসহায়’ করে দেয় বলে মনে করেন শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ।

ভালো ছাত্রী হিসেবে অবন্তিকাকে মানসিকভাবে চাঙা করার চেষ্টা করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, “বাবা মারা যাওয়ার সময় প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ওর (অবন্তিকা) সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তখনই আমার কাছে মনে হয়েছিল, ওর মধ্যে যে প্রাণশক্তি সেটা মরে গেছে। কারণ প্রক্টর অফিসে মীমাংসার সময় ওর বাবা ওখানে উপস্থিত ছিলেন। ওর বাবাও দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।

“কুমিল্লায় বাড়ি, ওকে হলে থাকতে হয়, হলেরও দুয়েকজনের সঙ্গে সমস্যা তৈরি হচ্ছিল, কলতাবাজারে মেসেও সমস্যা হচ্ছিল। আবার বাবাও মারা গেলেন। সব মিলিয়ে ও অনেক অসহায় হয়ে পড়ে। আমার ধারণা, সে উপরে উপরে অনেক শক্ত দেখালেও ভেতরে ভেতরে ও একদমই ভেঙে পড়েছিল।”

এই শিক্ষকের মতে, অবন্তিকার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার ক্ষমতা ‘একটু কম ছিল।’

তিনি বলেন, “ও খুব মেধাবী ছিল, স্বপ্নবাজ ছিল, উপস্থাপনা করত, আবৃত্তি পছন্দ করত, এগুলো ওর স্ট্রং সাইড ছিল। কিন্তু ভেতরে ওর ইমোশনাল ভালনারিবিলিটি ছিল। এর অনেক ধরনের ব্যাখ্যা হতে পারে।”

অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনায় যে তদন্ত কমিটি হয়েছে, শিক্ষক মাসুম বিল্লাহও তার সদস্য। তিনি বলেছেন, “আমরা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেব। তবে তাড়াহুড়া করে আমরা কাউকে বিপদে ফেলতে চাই না।”

আম্মানের ‘পক্ষ নেন’ দ্বীন ইসলাম

অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম বলেন, আম্মান নানাভাবে হেনস্তা করতে থাকলে অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে নালিশ করেছিলেন।

 “কিন্তু সহকারী প্রক্টর এর বিচার করেননি, উল্টো আমার মেয়েকে ডেকে নিয়ে বাজে কথা বলেন। আম্মানের পক্ষ নেন। এতে আম্মান আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ে। আপত্তিকর মন্তব্য করত, হুমকি দিত। এসব ঘটনার বিচার চেয়ে না পেয়ে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।”

এক বছরের মধ্যে স্বামী ও মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা এই নারী বলেন, “মেয়ে আমার বিচারক হতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা তাকে বাঁচতে দিল না। আবন্তিকা সাহসী মেয়ে ছিল। কিন্তু বিচার না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।”

প্রক্টরের দিকেও আঙুল তুলেছেন অবন্তিকার মা। তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানের কাছেও গিয়েছিলাম। তাকে ১০টা নাম দিয়ে আসছি আমি। চেয়ারম্যান আমার সামনেই প্রক্টরকে ফোন দিয়েছেন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। প্রক্টর কী ব্যবস্থা নিল?”

অবন্তিকার মা বলেন, “আমি দায়ী করছি যারা মেন্টাল টর্চার করেছে তাদেরকে। আমি ডিপার্টমেন্টকে জানিয়েছি, প্রক্টরকে জানিয়েছি। তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে?”

গত বছরের নভেম্বরে অবন্তিকা একটি অভিযোগ দিয়েছিলেন জানিয়ে প্রক্টর মোস্তফা কামাল বলেন, উপাচার্যের নির্দেশে তখন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অবন্তিকার বাবাও এসেছিলেন। তদন্ত কমিটি সে বিষয়টা মীমাংসা করে দিয়েছিল।

“আমি তাকে যোগাযোগ করতে বলেছিলাম, কিন্তু সে আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেনি,” বলেন প্রক্টর।

সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।”

বিভাগের চেয়ারম্যান জানতেন ‘সব ঠিক আছে’

আইন বিভাগের চেয়ারম্যান সরকার আলী আক্কাসের দাবি, অবন্তিকার সঙ্গে যেসব ঘটনা ঘটেছে, এর অভিযোগ গিয়েছে প্রক্টর অফিসে, বিভাগে নয়।

তিনি বলেন, “প্রক্টর অফিস কী করছে না করছে, সেটা আমি অবন্তিকাকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি। যখনই দেখা হয়েছে, আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছি, ও বলেছে, ‘ঠিক আছে’।”

অবন্তিকা আত্মহত্যা করার আগের দিন গত বৃহস্পতিবারও এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন বলে সরকার আলী আক্কাসের ভাষ্য।

তিনি বলেন, “তখনও ও বলল, স্যার সবকিছু ঠিক আছে। আমি এটা নিয়ে খুবই শকড। আগের দিন ওর সঙ্গে কথা হল। ও কিছু বলল না। ডিপার্টমেন্টে আমার কলিগরাও বলছেন, ও খুব স্বাভাবিক ছিল। ওর যে কিছু চলছিল, বোঝাই যাচ্ছিল না।”

ওর বন্ধুদের মাধ্যমে মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছে- এ ধরনের কিছু জানতেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “অবন্তিকা প্রক্টর অফিসে দরখাস্ত দেওয়ার পরে আমাদের দুজন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজারকেও বিষয়টি জানিয়েছিল। তখন তারা ওই শিক্ষার্থীদের (অবন্তিকার সঙ্গে যাদের বিরোধ ছিল) শাসিয়েছিল যে, ‘তোমরা ঠিক হয়ে যাও, নইলে তোমাদের ভর্তি বাতিল করে দেব।’

“এরপরে অবন্তিকাকে স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজাররাও জিজ্ঞেস করেছিল। তখন সে বলেছে, ‘সব ঠিক আছে’।”

যাদের বিরুদ্ধে অবন্তিকা অভিযোগ করে গেছেন, সেই আম্মান সিদ্দিক ও দ্বীন ইসলাম এখন পুলিশ হেফাজতে। তাদের বক্তব্য জানার সুযোগ এখন নেই।

তবে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তাদের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

অবন্তিকা যেদিন আত্মহত্যা করেন, সেদিন রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের জবাবে আম্মান বলেছিলেন, “ঘটনাটি ২০২২ সালের অগাস্ট মাসের। তখন সে মিথ্যা ফেসবুক আইডি খুলে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়েছে।

“তখন আমরা কোতয়ালি থানায় জিডি করলে সে তার ভুল স্বীকার করে। সে যেন এরকম কাজ আর না করে সেজন্য আমরা প্রক্টরিয়াল বডিকে অবহিত করে রাখি। এর পর ওর সঙ্গে আমার আর কোন যোগাযোগ হয়নি।”

তিনি বলেন, “সবকিছুর পর আসলে ও নিজের মেন্টাল প্রেশার নিজে তৈরি করছে। ওর নিজের মানসিক অসুস্থতার জন্য নিজেকে হারিয়েছে।”

আর সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম বলেছিলেন, “এই ঘটনায় আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মেয়েটার সঙ্গে দেড় বছর আগে ছেলেটির ঘটনা নিয়ে যোগাযোগ হয়েছে। আমি চাই সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিচার হোক।”

আরও পড়ুন...

Also Read: ‘আর কোনো অবন্তিকা যেন এভাবে ঝরে না পড়ে’

Also Read: উত্তাল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Also Read: অবন্তিকার আত্মহত্যা: দ্বীন ইসলামের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তথ্য চায় তদন্ত কমিটি

Also Read: ‘আর কোনো অবন্তিকা যেন এভাবে ঝরে না পড়ে’

Also Read: আত্মহত্যা: আমাদের বিপন্নতা ও পারস্পরিক দায়বদ্ধতা

Also Read: ‘অবন্তিকার আত্মহত্যা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’, জাবিতে বিক্ষোভ

Also Read: অবন্তিকার আত্মহত্যা: আম্মান ও দ্বীনের ‘খণ্ডিত সংশ্লিষ্টতা’ পেয়েছে পুলিশ

Also Read: কার কাছে বিচার দেব, অবন্তিকার মায়ের বিলাপ