“আমার আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ছিল। আল্লাহ আমার কাছ থেকে তোরেই নিয়ে গেল!”
Published : 16 Mar 2024, 01:46 PM
গত বছর রোজার সময় স্বামীকে হারিয়েছিলেন কুমিল্লা নগরীর বাসিন্দা তাহমিনা শবনম। আর এবার একই সময়ে চলে গেল একমাত্র মেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা। স্বামী-সন্তানকে হারানো এই নারীর বিলাপ থামবেই বা কীভাবে?
ফেইসবুক পোস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও এক সহপাঠীকে দায়ী করে শুক্রবার রাতে আত্মহত্যা করেন অবন্তিকা (২৪)। তারপর থেকে মেয়ের জন্য বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন শবনম।
শনিবার নগরীর বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন বাসায় বিলাপ করতে করতে শবনম বলছিলেন, “আমি জীবনে কারও ক্ষতি করিনি। কুমিল্লা শহরের কেউ বলতে পারবে না আমি কারও ক্ষতি করেছি। ওরা আমার এতো বড় ক্ষতি কেন করল?”
“একটা বিধবা নারীর এটাই প্রাপ্য ছিল? আমি এখন সন্তানহারা। আমি এর বিচার কার কাছে দেব?”
ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার বাবা মো. জামাল উদ্দিন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ ও কুমিল্লা সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। ২০২৩ সালের ১২ এপ্রিল রোজার সময় তিনি মারা যান।
মৃত্যুর আগে তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা শহরতলির শাসনগাছা মহাজন বাড়ি এলাকায়।
অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম কুমিল্লা পুলিশ লাইনস উচ্চ বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন। অবন্তিকার ছোট ভাই অপূর্ব আগামীতে এসএসসি পরীক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী অবন্তিকা নানা সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানালেন মা।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শবনম বলেন, “শুক্রবার ইফতারের পর মেয়েকে বিষণ্ন দেখেছিলাম। তখন মন খারাপ কেন জানতে চাইলে অবন্তিকা শুধু বলেছিলেন- এমনি।”
তবে মেয়ে যে আত্মহত্যা করবে তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি জানিয়ে তিনি বলেন, “রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমাকে পানি দিয়ে গেল এক গ্লাস। এর কিছুক্ষণ পর ওর রুমে ফ্যানের শব্দ না পেয়ে ডাকাডাকি করি। কোনো সাড়া মেলেনি।”
পরে তার ছেলে দারোয়ানকে নিয়ে মই দিয়ে পূর্ব পাশের জানালা খুলে ফ্যানের সঙ্গে অবন্তিকাকে ঝুলে থাকতে দেখে।
তিনি বলেন, এরপর পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা পুলিশের একজন সদস্যসহ মেয়েকে নামিয়ে প্রথমে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ও পরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসক অবন্তিকাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শবনমের অভিযোগ, সহপাঠী আম্মান নানাভাবে তাকে উৎপীড়ন করতে থাকলে অবন্তিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে নালিশ করেছিলেন।
তিনি বলেন, “কিন্তু সহকারী প্রক্টর ঘটনার বিচার করেননি, উল্টো মেয়েকে ডেকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন। ওই ছেলের পক্ষ নেন তিনি। তখন আম্মান সিদ্দিকী আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন। আপত্তিকর মন্তব্য করতেন, হুমকি দিতেন। এসব ঘটনার বিচার চেয়ে না পেয়ে আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।”
এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন শবনম।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, “হায় রে অবন্তিকা তুই আমারে কত বলছিলি মা একটা জিডি করো, মা একটা জিডি করো। আমি বলেছি মা এগুলা করব না। আল্লাহ বিচার করবে। আমার আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ছিল। আল্লাহ আমার কাছ থেকে তোরেই নিয়ে গেল! তোরে নিয়ে গেল অবন্তিকা? ”
এক বছরের মধ্যে স্বামী ও মেয়েকে হারিয়ে দিশেহারা এই নারী বলেন, “মেয়ে আমার বিচারক হতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা তাকে বাঁচতে দিল না। আবন্তিকা সাহসী মেয়ে ছিল। কিন্তু বিচার না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল।”
অবন্তিকাকে মানসিক নিপীড়েনের বর্ণনা দিয়ে শবনম বলেন, “ঢাকায় মেয়েটা কলতাবাজারে ছিল। ইউনিভার্সিটির ছেলেগুলা ওই বাসা পর্যন্ত গিয়ে জানাইছে যে- ওর নামে জিডি আছে। ওই বাসার মেয়েরা তো এসব জানার কথা না। আমার মেয়ে এসে বলছে- মা ওরা তো আমাকে এইভাবে মেন্টাল টর্চার করতেছে। আমি পড়তে পারছি না।”
“পুলিশ দিয়ে আমাকে ফোন দিয়েছে। শুনেছি পুলিশ তাদের এলাকার ভাই। পরে আমি আমাদের পরিচিত এক ডিআইজিকে ফোন দিয়েছি। উনি বলেছেন- ভাবী আপনি আমাকে বলতেন আমি ব্যবস্থা নিতাম।”
বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানের কাছেও গিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “চেয়ারম্যানকে ১০টা নাম দিয়ে আসছি আমি। চেয়ারম্যান আমার সামনেই প্রক্টরকে ফোন দিয়েছে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলল। প্রক্টর কী ব্যবস্থা নিল?”
বাবার মৃত্যু নিয়েও অবন্তিকাকে হয়রানি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “মেয়েটাকে বলে তোর বাবার কাছে তুই যাস নাই? তোর বাবা হাসপাতালে ছিল তুই প্রোগ্রাম করিস। আর দেখলেই বাবা নাই মানসিক সমস্যা হচ্ছে না? আহারে বাবাটা মরে গেল, মানসিক সমস্যা হচ্ছে? মানে সর্বদিকে মেয়েটাকে মেন্টাল টর্চারে রাখছে। তাহলে এই টর্চারের উত্তর আমি কী চাইব? কার কাছে চাইব?”
শনিবার দুপুরে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ হোসেন বলেন, “এ ঘটনায় এখনো থানায় কোনো মামলা হয়নি। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি।”
বিক্ষোভ কুমিল্লায়
এদিকে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার মৃত্যুকে ‘হত্যা’ দাবি করে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে কুমিল্লার সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জোট।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের পূবালী চত্বরে ঘণ্টাব্যাপী এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
এ সময় বক্তারা জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীসহ অবন্তিকার মৃত্যুর নেপথ্যে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।