একজন ক্রেতা বলেছেন, এই পদক্ষেপের খবরে তিনি আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু এখন হতাশ। তবে টাস্কফোর্স সদস্যদের দাবি, তাদের পদক্ষেপে কমছে দাম।
Published : 11 Nov 2024, 01:31 AM
নিত্যপণ্যের দর যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা আর উৎপাদন, পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ের মধ্যে দামের পার্থক্য ন্যূনতম রাখার লক্ষ্য নিয়ে গঠন করা টাস্কফোর্স গত এক মাসে বাজারে আসলে কতটা প্রভাব রাখতে পারছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন ভোক্তারা।
মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দর বেড়ে চলার ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়েনি, উল্টো আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হচ্ছে ক্রেতাদের, ফলে টাস্কফোর্সের দৃশ্যমান কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।
কিছুটা কমে পাওয়া যায় বলে কারওয়ান বাজারে যেতে পছন্দ করেন মো. সাকিন হোসেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টাস্কফোর্স যখন গঠন হয়েছিল, তখন ব্যাপক প্রচার দেখতে পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সব জেলায় যেহেতু কমিটি কাজ করবে, সেহেতু দাম এবার কমবে। কিন্তু দাম তো কমে নাই।”
টাস্কফোর্সের একাধিক সদস্যের দাবি, এই উদ্যোগের সুফল মিলছে। পণ্য মূল্য কমে আসার দাবিও করছেন তারা।
তবে সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্রিফিং করে বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লেগে যাবে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, এ বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
টাস্কফোর্সের কী দায়িত্ব
গত ৭ অক্টোবর টাস্কফোর্স গঠনের আদেশে এর বেশ কিছু দায়িত্বের কথা বলা আছে।
এর মধ্যে আছে, নিয়মিত বিভিন্ন বাজার, বৃহৎ আড়ত/গোডাউন/কোল্ড স্টোরেজ ও সাপ্লাই চেইনের অন্যান্য স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন এবং পণ্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার বিষয়টি তদারকি করা;
উৎপাদন, পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ের মধ্যে যাতে দামের পার্থক্য ন্যূনতম থাকে, তা নিশ্চিত করা এবং সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা।
প্রতিদিন একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল এবং জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পাঠানো।
নতুন করে বেড়েছে যেসব পণ্যের দাম
বাজার নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্সের কাজ শুরু হওয়ার পর এই এক মাসে দাম বৃদ্ধির তালিকায় নতুন করে যোগ হয়েছে আলু, পেঁয়াজ, চাল আর খোলা সয়াবিন তেল।
এই এক মাসে আলুর দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা, চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ থেকে ১২ টাকা, পেঁয়াজের দাম ২৫ থেকে ৩৫ টাকা, রসুনের দাম ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে।
এসব পণ্যের দর বৃদ্ধি স্বল্প আয়ের মানুষদের জীবন আরও কঠিন করে তুলেছে। এর কারণ, স্বল্প আয়ের মানুষরা তাদের খাদ্যের পেছনে ব্যয়ের বেশিরভাগ করেন এসব পণ্য কিনতেই।
পাইকারি, খুচরা ও উৎপাদন পর্যায়ে এসব পণ্যের দামের পার্থক্য ন্যূনতম রাখার বিষয়ে কোনো ঘোষণা আসেনি, কোনো পর্যায়ে অযৌক্তিক মুনাফা করার বিষয়ে কোনো তথ্যও দেয়নি টাস্কফোর্স।
অথচ এই সময়ে সরকার চালের আমদানি শুল্ক শূন্যে নামিয়েছে, পেঁয়াজ, আলু আর ভোজ্যতেলের শুল্ক কমিয়েছে।
শীতের সবজির সরবরাহ বাড়ার পর সবজি বাজারে অস্বস্তি কাটলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দাম বেশি। সরকারি সংস্থা টিসিবির তালিকা বলছে, ডিম, ব্রয়লার মুরগির দামও বেশি। অবশ্য গত এক মাসে ডিমের দাম আগের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছে।
পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গত অগাস্টে খাদ্য খাতে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল, সেপ্টেম্বরে তা ছিল ১০ দশমিক ৪০; আর অক্টোবরে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি।
অর্থাৎ গত বছর খাদ্যের পেছনে খরচ ১০০ টাকায় হলে গত অক্টোবরে তা বেড়ে হয়েছে ১১২ টাকা ৬৬ পয়সা।
গত ২৫ অগাস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, “মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।”
তবে গত ৭ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ে এক বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বর্তমানে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি কমে আসতে দেড় বছরের মত অপেক্ষা করতে হতে পারে।
এত সময় কেন লাগবে, সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “বিশ্বের যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি বর্তমান বাংলাদেশের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে এই হারেই কমেছে।
“বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলছে মুদ্রানীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ (টাইটেনিং) করার পরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লেগে যাচ্ছে। সেজন্য আমাদেরকে ধৈর্য ধরতেই হবে। পলিসিগুলো বাস্তবায়নের সময়টা দিতে হবে। এটা দুই তিন মাসের ব্যাপার নয়।”
টাস্কফোর্স নিয়ে কে কী বলছেন
কারওয়ান বাজারের আলু-পেঁয়াজ বিক্রেতা মো. সেলিম হোসেন বলেন, “টাস্কফোর্স নাকি সেটা তো জানি না, এমনিতে অনেকদিন আগে অফিসারদের দেখছিলাম বাজারের অবস্থা দেখতে আইছিল। কাউকে নাকি জরিমানাও করছে। তারা আমাদের কাছে না আইসা যেখানে দাম বাড়ায় সেখানে যাওয়া উচিত। যারা কোল্ড স্টোরেজ করে, তাদের ধরা উচিত।”
কারওয়ান বাজারের পাইকারি কাঁচা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সুজন চৌধুরী বলেন, “টাস্কফোর্স তো একটা মিটিং করেছিল, এরপরে কার্যক্রমের ব্যাপারে আর জানি না। তারা তো আসলে সবার সাথে বসতে হবে।”
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের প্রাক্তন ডিন অধ্যাপক মো. আক্তারুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাঠ পর্যায়ে সে রকম তদারকি হচ্ছে না। আলু বাজারে আছে, কিন্তু এরপরও দাম বাড়ছে। বাস্তবিক কথা হচ্ছে যখন একটা প্রজ্ঞাপন হয় সেটা বাস্তবায়ন হতে একটু টাইম লাগে। আর এখানে কাজের সমন্বয়হীনতা আছে।
“ঢাকায় কয়েকটি জায়গায় তদারকিতে গেলেও বিভিন্ন জেলায় কিন্তু সমানভাবে যাওয়া হয় না। একদম প্রান্তিক পর্যায়ে যেতে হবে। তাহলে একটা পরিবর্তন সম্ভব। বিভিন্ন বাজার ব্যবস্থাপনার যে কমিটি আছে, তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে, যে কোনোভাবে তাদের যদি জবাবদিহি করা যায় তাহলে বেশি প্রভাব পড়বে।”
ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশনস অব বাংলাদেশ-ক্যাব এর ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, “টাস্কফোর্সের যে অনুযায়ী কাজ হওয়ার কথা সে অনুযায়ী তো হচ্ছে না। যেভাবে তদারকি করার কথা সেটা করছে না।
“দুয়েকটি দোকানে তারা অভিযান পরিচালনা করে, তাও আধা ঘণ্টা, ১৫ মিনিট বা ২০ মিনিট এ রকম। যদি এক্সট্রিম কোনো উদ্যোগ নেওয়া হত, জরিমানার হারও যদি উল্লেখযোগ্য হত, তাহলেও কাজে আসত।”
আগে ভোক্তা অধিদপ্তর জরিমানা ‘বেশি’ করত মত দিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু এখন ডিসিরা যখন টাস্কফোর্সের মাধ্যমে করছে, তখন জরিমানাও কমিয়েছে। ২ হাজার, ৫ হাজার টাকা জরিমানা করে কিছু হয় না। এখন অনেক কঠোর হতে হবে।“
তবু সাফল্যের দাবি
প্রত্যেক জেলায় ১০ সদস্যের এ বিশেষ তদারক কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ করছেন এডিসি এবং সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ক্যাবের পাশাপাশি দুইজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধিও কাজ করেছেন।
কুমিল্লার এডিসি মাহফুজা মতিনের দাবি, তারা ‘সফল’। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা কাজ করার কারণেই এখন দাম কমছে।… আমাদের তদারকির কারণেই দাম কমেছে সেটা বলতে পারি। বাজারে গিয়ে মূল্য তালিকা, মেয়াদ, রশিদ সব কিছু চেক দিয়ে কোনো সমস্যা পেলে জরিমানা করা হয়।”
টাস্কফোর্সের সদস্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আতিয়া ইসলামও বলেন, “৬৪ জেলায় প্রতিদিন টাস্কফোর্সের কার্যক্রম চলছে। একটা জেলায় একাধিক টিম বের হচ্ছে। এই কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চলছে বলেই দ্রব্যমূল্য এখন নিয়ন্ত্রণে আসতেছে।”
পণ্যমূল্য কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আসছে এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “ডিমের দাম এখন কমতির দিকে।”
গত সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ডিমের দাম বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ডজন ১৮০ টাকায় উঠে যায়। সেটি কমে এখন ১৫০ টাকায় নেমেছে।
আতিয়া ইসলাম বলেন, “সবকিছুর দাম যে হারে বেড়েছিল, শুধু টাস্কফোর্সের কারণে এটা অনেক নিয়ন্ত্রণে আসছে।
“চালের বাজারও হচ্ছে। আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে, এখন চাহিদা অনুযায়ী আমদানিও করবে।”
এই সরকারি কর্মকর্তা চালের দাম কমার দাবি কোন ভিত্তিতে করেছেন, সেটি স্পষ্ট নয়। কারণ টিসিবির হিসাব বলছে, গত এক মাসে ৪ টাকার মত দাম বেড়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (আইআইটি) মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম বলেন, “কাজ করছে, কার্যক্রম চলছে ঠিকঠাক মত।”
পুরনো খবর-
চালের দামকে ছাড়িয়েছে দেখে ক্রেতার প্রশ্ন, 'আলু কি বিলাস পণ্য?'
সবজির দাম কমছে, পেঁয়াজের কেজি ছুঁয়েছে ১৬০
চড়ছে পেঁয়াজ, ব্যবসায়ীরা বলছেন সরবরাহ সংকট
'ডিম কি আমি মেশিন দিয়ে তৈরি করব?' প্রশ্ন বাণিজ্য উপদেষ্টার
ফেইসবুকে নিত্যপণ্যের দাম কমার খবরে বাজারে গিয়ে 'ধোঁকা'
চালের দাম 'গতবারের চেয়ে কম', মূল্যস্ফীতি নিয়ে ১৮ মাস ধৈর্য ধরুন: গভর্নর