এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। গত বছরের তুলনায় দাম বেশি ৪৩ শতাংশ।
Published : 08 Nov 2024, 10:04 PM
‘ভাতের বদলে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান’- এক সময় দেওয়া এমন স্লোগানের বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে এখন। ‘আলুর ওপর চাপ কমাতে’ ভাত খাওয়ার মত দশা তৈরি হয়েছে।
ঢাকার বাজারগুলোতে এখন খুচরায় আলুর দর ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। পাড়া-মহল্লায় এই দর ঠেকেছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়।
পাইজাম, ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের চালের দাম লাফ দিলেও পাওয়া যাচ্ছে ৬৫ টাকা কেজি দরে, প্রতি কেজি মিনিকেট পাওয়া যাচ্ছে ৭৫ টাকায়।
চালের এ দরও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে জাত ও মানভেদে টিসিবির হিসাবেই ৭ থেকে ১৬ শতাংশ বেশি। সরকার চাল আমদানিতে শুল্ক কমালেও কোনো প্রভাব পড়েনি বাজারে।
তবে আলুর দামের বাড় বাড়ন্ত আরও বেশি। টিসিবি বলছে, গত বছর একই সময় আলু পাওয়া গেছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়, এক বছরে বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।
আলুর দাম নিয়ে গত বছরও হুলুস্থুল হয়েছিল, এক পর্যায়ে সরকার কেজিপ্রতি ৩৭ টাকা বেঁধে দিয়ে কোল্ড স্টোরেজ ও বাজারে অভিযান চালিয়েও বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি করা যায়নি।
তবে এবারের পরিস্থিতি আরও খারাপ। ভারত থেকে টনকে টন আলু এনেও বাজার ঠান্ডা করা যাচ্ছে না, টিসিবির হিসাব বলছে, এক সপ্তাহেই দাম বেড়েছে ১০ টাকা, এক মাসে ১৫ টাকা।
বিজয় সরণির কলমিলতা কাঁচা বাজারে আসা জাহেদুল ইসলাম বলেন, “আলু আর চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে গেছে। না হয় নিম্ন আয়ের মানুষেরা ফুঁসে উঠবে। তারা মাছ-মাংস চায় না, কোনো রকমে বাঁচতে চায়।”
মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় মুদি দোকান ভাই ভাই জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা মো. আবুল খায়ের বলেন, “আড়তদাররা আমাদের কাছে রিকোয়েস্ট করে বলছে, চালে সরকার ভ্যাট-ট্যাক্স কমাইছে। আবার আমদানিও হবে। আপনারাও দাম কমায়া দেন। এসব বইলা পরে বস্তা প্রতি চালে আড়তদাররা ১০ টাকা করে কমাইছে৷
“এক বস্তায় ৫০ কেজি চাল থাকে। এখন আমরা যদি এই ৫০ কেজির মধ্যে ১০ টাকা কমাইতে যাই তাহলে কি হিসেবে বিক্রি করব? পয়সা হিসেবে? এগুলো তো প্রহসন।”
মধ্য বাড্ডার মুদি দোকানি আবুল খায়েরের দোকানে দাম শুনে এলাকার বাসিন্দা ইসলাম শেখ প্রশ্ন রাখলেন, আলু ও চালের মধ্যে কোনটির দাম বেশি?
বিক্রেতা বললেন, “এখন তো চালের চেয়ে দেখা যায় আলুর দামই বেশি। দুইটা পাল্লাপাল্লি করে দাম বাড়ছে।”
ইসলাম শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষের কাছে টাকা না থাকলে আলু আর চালের উপরে থাকে শেষ ভরসা। ভালো খাবার না জুটলেও আলু কেনা সহজসাধ্য ছিল। কিন্তু এখন আলু বিলাস পণ্যের দিকে যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন- আলু কি বিলাস পণ্য?”
শুক্রবার কারওয়ান বাজারে খুচরায় বগুড়ার লাল আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে ও মুন্সিগঞ্জের আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকা কেজি দরে। তবে পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৪ টাকায়।
কারওয়ান বাজারে পাইকারি দোকান বিক্রমপুর বাণিজ্যালয়ের মো. হানিফের আশঙ্কা দাম আরও বাড়বে। কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এখন আলুর শেষ সময় চলছে। নতুন আলু আসতে সামনে। তখন দাম কমবে। কৃষকের কাছে আলু নাই। যা আছে কোলেস্টরেলে (কোল্ড স্টোরেজ) আছে।”
কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা মো. সেলিম হোসেন বলেন, “যারা ‘কোলেস্টেরল’ করে তাদের ধরা দরকার। তাদের ধরলেই সব বের হবে, দামও কমবে।”
পলিথিন নিষিদ্ধে খরচ বাড়ল?
পলিথিন নিষিদ্ধ করার প্রভাবে পণ্যমূল্য আরও বাড়ার আশঙ্কার কথাও বললেন এই বিক্রেতা। তিনি বলেন, “এখন নতুন নিয়ম করছে পলিথিনে দিওন যাইব না। তাই কাগজের ঠোঙা কিনছি। প্রত্যেকটা ঠোঙার দাম দুই টাকা করে পড়ছে। এটার খরচ কি এখন আমি দিব? এটা তো চাল বিক্রি করেই আমার লাভ করতে হবে।”
শুক্রবার গুদারাঘাট ও কলমিলতা কাঁচা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হতে দেখা গেছে ৭০ টাকা কেজিতে।
তবে মধ্য বাড্ডার মুদি ব্যবসায়ী আবুল খায়ের বিক্রি করছেন ৭৫ টাকা করে।
উত্তর বাড্ডা থেকে পাইকারিতে কেনা আর যাতায়াত ভাড়া মিলিয়ে প্রতি কেজি পড়েছে ৬৬ থেকে ৬৭ টাকায়। আর কাগজের ঠোঙ্গায় দুই টাকার মতো খরচ পড়ে। বিক্রয় মূল্য নির্ধারণে এটিও হিসাব করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, “আলুর যেভাবে দাম বাড়তাছে এটারও লাগাম টানা উচিত। ১০ দিনের মত সময়ের ভিতরে আলুর দাম ১০ টাকার মত বাড়ছে।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিসিদের বলা হয়েছে কোল্ড স্টোরেজে আলু মজুদের হিসাব বের করতে। আর যারা ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়ানো চেষ্টা করছে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হবে।
“চালের দাম কমাতেও আমরা কাজ করেছি, তবুও কেন চালের দাম বেশি সেটা আমরা দেখছি।”
হাজেরা বিবি আর পারছেন না
মধ্য বাড্ডার আদর্শ নগরে থাকেন হাজেরা বিবি। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েই চলেন। জানালেন, চালের যে দাম তাই চাল আর কিনতে পারেন না। আবার আলুর দামও বাড়ার কারণে আলুও কিনেন না।
তিনি বলেন, “টাকা তুইল্যা চাউল-আলু কিনতে পারি না। তাই এহন মাইনষের কাছ থেকে যেটুকুন দরকার হেইটুকু চাইয়া খাই।”
রান্নার আরেক উপকরণ পেঁয়াজের দর যে এলাকার বাজারে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা ছুঁয়েছে, সেখান থেকে আর কমেনি। তবে এক সপ্তাহে দাম বাড়েনি, এটিই এখন ক্রেতার সন্তুষ্টির কারণ।
ভারতীয় পেঁয়াজ অবশ্য কিছুটা কমে ১১০ থেকে ১২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
দাম বেড়েছে আদার। সপ্তাহ দুয়েক আগেও পণ্যটি পাওয়া গেছে ২২০ থেকে ২৪০ টাকার ভেতরে। এখন চায়না আদা বিক্রি হচ্ছে ২৮০ টাকায়, কেরালার আদার দাম ২২০।
কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা মো. সেলিম হোসেন বলেন, “আগের আদা নরমাল ছিল। এখন আদার মান অনেক ভালো। তাই দাম আগের চেয়ে একটু বেশি।
কারওয়ান বাজারের আব্দুল আওয়াল ব্রয়লার হাউসের বিক্রেতা মো. সুজন বলেন, “গত সপ্তাহের চেয়ে আজ ব্রয়লার মুরগিতে ৫ টাকা কম। আবার সোনালি মুরগিরও দাম কমছে।
“ব্রয়লার বেচি ১৮৫ টাকায়, আর সোনালি যেইটা হাইব্রিড সেটা ২৮০ টাকা, আসলটা ৩১০ টাকা কেজি।”
অস্থিরতা কমলেও ‘হতাশ’ করছে সবজিও
বাজারে আগের চেয়ে কিছুটা কমে পাওয়া যাচ্ছে সবজি। তবে শীতকালীন আগাম সবজির দামও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি বলছেন ক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারে দর নগরীর অন্যান্য বাজারের তুলনায় কিছুটা কম, তবে সেটি দেখেই হতাশ সোমাইয়া আক্তার। তিনি বলেন, “শিম. ফুলকপিসহ শীতকালীন অনেক পণ্য বাজারে আসতেছে। কিন্তু সেই হিসেবে দাম কমছে না।
“হ্যাঁ, কয়েকদিন আগের মত অস্থিরতা এখন নেই। কিন্তু আমি মনে করি, একটা পক্ষ চায় না যে দাম কমুক। অধিক লাভের চিন্তা করে। সাপ্লাই চেইন ঠিক আছে কি না, এখানে সরকারের কাজ করা দরবার।”
কারওয়ানবাজারে বাজারে শিম বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি দরে, লম্বা বেগুন, করলা ও ঢ্যাঁড়স ৬০ টাকা, টমেটো ১৪০ টাকা, গোল বেগুন ও বরবটি ৮০ টাকা, শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকায়।
লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি ও পেঁপে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে মরিচের দর কেজিতে ৫০ টাকার কম কমে বিক্রি হয়েছে দেড়শ টাকায়।
কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, “মালের সরবরাহ অনেক। তবে সেইভাবে দাম এতটা কমেও নাই।
“আর কাঁচামাল তো, তাই কিছু মালের দাম বাড়ে, আবার কিছু মালের দাম কমে। ঢ্যাঁড়সের দাম গতকাল ছিল ৫০ আজ ৬০ টাকা। আবার পটলের দাম কমছে।”
আরও পড়ুন
চালের দাম 'গতবারের চেয়ে কম', মূল্যস্ফীতি নিয়ে ১৮ মাস ধৈর্য ধরুন: গভর্নর
সবজির দাম কমছে, পেঁয়াজের কেজি ছুঁয়েছে ১৬০
'ডিম কি আমি মেশিন দিয়ে তৈরি করব?' প্রশ্ন বাণিজ্য উপদেষ্টার