“পলিসিগুলো বাস্তবায়নের সময়টা দিতে হবে। এটা দুই তিন মাসের ব্যাপার নয়”, বলেন তিনি।
Published : 07 Nov 2024, 08:43 PM
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সচিবালয়ে এক সভা শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দাবি করেছেন বাংলাদেশে চালের দাম বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কেজি প্রতি ছয় টাকা কমে মানুষ চাল কিনতে পারছে- এমন দাবিও করেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এই সভা হয়, যে সভায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানও উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন অর্থ সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদারসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অন্তত নয়জন সচিব।
গভর্নর বলেন, “বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চালের দাম বেশি, কিন্তু গত বছরের চেয়ে ৫/৬ টাকা কম আছে এখন। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে দাম সস্তা আছে বাংলাদেশে।”
আমদানি শুল্ক শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার পরেও কেউ আমদানি করছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “ভারত থেকে চাল আমদানি করলেও খরচ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পড়ছে। এর মানে হচ্ছে চালের বাজারে দেশীয় জোগান খারাপ নয়; এখন চালের যেই দাম আছে সেই পর্যায়েই থাকবে।
“এবং বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে চালের দাম সর্বনিম্ন পর্যায়েই আছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও বর্তমান চালের বাজার সর্বোচ্চ পর্যায়ে নয়। গত বছরও প্রতিকেজি ৬৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।“
আরও পড়ুন: '৬০ টাকার নিচে কোনো চাল নাই'
কেজিতে ৩ টাকা বাড়িয়ে আমন সংগ্রহের লক্ষ্য
গভর্নর এই বক্তব্য রাখার দিন সরকারি সংস্থা টিসিবি চালের দামের যে হিসাব প্রকাশ করছে, তাতে দেখা যায় সরু চালের দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম ১৬ শতাংশ আর মোট চালের দাম এখন ৭ শতাংশ বেশি।
গভর্নর বলেন, “আমরাও চাই চালের দাম কমুক। কিন্তু কৃষকের কথাও ভাবতে হবে। চাষাবাদের উপাদানগুলোর দাম বেড়েছে, খরচ বেড়েছে, এসবও ভাবতে হবে। চালের দাম ভবিষ্যতে খুব যে কমবে এমন আশা করাও ঠিক হবে না।”
‘১৮ মাস ধৈর্য ধরতে হবে’
বর্তমানে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতি আসতে দেড় বছরের মত অপেক্ষা করতে হতে পারে বলেও জানিয়ে রাখেন গভর্নর। বলেন, “বিশ্বের যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি বর্তমান বাংলাদেশের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে এই হারেই কমেছে।
“বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলছে মুদ্রানীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ (টাইটেনিং) করার পরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লেগে যাচ্ছে। সেজন্য আমাদেরকে ধৈর্য ধরতেই হবে। পলিসিগুলো বাস্তবায়নের সময়টা দিতে হবে। এটা দুই তিন মাসের ব্যাপার নয়।”
মূল্যস্ফীতি বাড়ার এক কারণ ‘মজুরি বৃদ্ধি’
সচিবালয়ে এই বৈঠকের দিন পরিসংখ্যান ব্যুরো অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। এটি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ।
গভর্নর বলেন, “এটা অস্বাভাবিক কিছু না। দুটি বিষয়ের প্রতিফলনে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। যার একটি হচ্ছে বন্যার কারণে সরবরাহে বড় রকমের ব্যাঘাত হয়েছে। দ্বিতীয়ত. গত কিছু ‘ওয়েজ প্রেসার’ ডেভেলপ করেছে। নানা রকম আন্দোলনের ফলে অনেকের বেতন বেড়েছে। এর একটা প্রভাব বাজারে পড়েছে।“
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য তেমন বাড়েনি উল্লেখ করে একে ‘আশার দিক’ বলে মন্তব্য করেন আহসান মনসুর। বলেন, “মূল্যবৃদ্ধি ২/৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। জ্বালানির দাম ১৭ শতাংশ কমেছে; এলএনজির দাম কমছে। মুদ্রা বিনিময় হার বেশ ভালোভাবেই স্থিতিশীল রয়েছে। এগুলো আমাদেরকে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সহযোগিতা করবে। এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে আমদানি সংক্রান্ত মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য।”
অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করতে হবে মত দিয়ে তিনি বলেন, “সেটা আমরা করছি। নীতি সুদহার ও সুদহার এখন বাজারভিত্তিক আছে, এভাবেই থাকবে। নীতি সুদহার বাড়িয়েছি কিন্তু এর কারণে সুদহার বাড়েনি। এর মানে হচ্ছে ব্যাংক যে লাভটা করত, সেটা কম করবে।
“এটার মাধ্যমে ব্যাংকের লিকুইডিটি টাইট করে ফেলছি। আশা করছি এর মাধ্যমে বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রভাব পড়বে।”
রোজায় সরবরাহ বাড়াতে আমদানি সহজ করার নীতি
রোজায় বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়িয়ে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনতে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে আমদানি নীতিতে সহজীকরণের পথে হাঁটার কথাও আলোচনা হয় বৈঠকে।
আহসান মনসুর বলেন, “সরকার সাপ্লাই চেইন সহজ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের উপর শুল্ক শূন্যের কোটায় নিয়ে আসা হয়েছে। নিত্যপণ্যের এলসি মার্জিনের বাধ্যবাধকতা আগেই উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন নিত্যপণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো যেন কোনো এলসি মার্জিন না রাখে, সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে একটা নির্দেশনা দেব।
“ব্যাংকগুলোকে আমরা অনুরোধ করব, অন্তত আগামী রোজার আগ পর্যন্ত নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের এলসি মার্জিন যেন না আরোপ করে। বড় বড় আমদানিকারকদের জন্য সিঙ্গেল বরোয়ার লিমিট একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি, সিঙ্গেল বরোয়ার লিমিট ভায়োলেট করা উচিত নয়। তবুও রোজাকে সামনে রেখে বড় বড় আমদানিকারকদের জন্য সিঙ্গেল বরোয়ার লিমিট যেন কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেজন্য সাময়িকভাবে ২/৩ মাসের জন্য তুলে দেব।“
এটি নির্ধারিত কিছু পণ্যের জন্যই কার্যকর হবে বলেও জানান গভর্নর।
অর্থ সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, “সরকার ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড প্রোগ্রাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কার্ডের বাইরেও সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।
“গত একমাস ধরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুলভ মূল্যে শাক সবজি বিক্রি করা হয়েছে। বাজার মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। এর বাইরে রেশন কার্ডের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এখন যে ৫ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে সেটা অচিরেই ১০ কেজিতে উন্নীত করা হবে। এগুলোই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
আরও পড়ুন:
সবজির দাম কমছে, পেঁয়াজের কেজি ছুঁয়েছে ১৬০
চড়ছে পেঁয়াজ, ব্যবসায়ীরা বলছেন সরবরাহ সংকট
ডিম-সবজির দাম কমে এবার চড়ছে মুরগি