দুটি ঘূর্ণিঝড় ও লঘুচাপের কারণে বৃষ্টিতে আলু রোপনের সময় পিছিয়ে গেছে। অপরিপক্ক আলু নিয়ে আসছেন কৃষক। এতে সার্বিক উৎপাদন নিয়ে আছে শঙ্কা।
Published : 28 Dec 2023, 08:01 PM
আলুর দামে ক্রেতার পাশাপাশি বিক্রেতার ঘোরও কাটছে না। দুই পক্ষের বিস্ময়ের মধ্যে একাধিক জেলার চাষিরা জানিয়েছেন, এবার আলু পরিপক্ক হতে সময় লাগছে। তাই বাজারে সরবরাহ কম।
একজন উদ্যানতত্ত্ববিদও একই তথ্য জানিয়ে বলেছেন, আলু রোপনের সময় বৃষ্টি এ সমস্যার প্রধান কারণ।
আবার বছরজুড়ে আলুর দাম বেশি থাকার কারণে কৃষককে এবার বেশি টাকা খরচ করে চাষ করতে হয়েছে।
চাষিরা আলুর দাম বেশি পেয়ে অপরিপক্ক অবস্থাতেই তুলে ফেলছেন। এতে সার্বিক উৎপাদনে প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সেই বিশেষজ্ঞ।
কৃষকের মাঠের দর থেকে ঢাকায় খুচরা বাজার দরের মধ্যেও পার্থক্য খুব একটা বেশি নয়। ফলে কৃষককে ঠকিয়ে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করছেন, এই বিষয়টিরও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
চাষিদের কাছ থেকে তথ্য মিলেছে তারা ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করেছেন। সেটি পরিবহন করে নিয়ে এসে ঢাকায় পাইকারি বাজারে ৬০ টাকার কমে বিক্রি হচ্ছে, খুচরায় কোথাও ৭০, কোথাও কিছু বেশি চাইছেন বিক্রেতারা। দুই দিন ধরে দামটা পড়তির দিকে।
এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে সরবরাহ বাড়লে দাম কমে আসবে- এমন আশাবাদের কথাও বলছেন ব্যবসায়ী ও চাষিরা।
মাস ছয়েক ধরে আলু ও পেঁয়াজের দর নিয়ে নানা কিছুই ঘটেছে। ভারত রপ্তানি কার্যত বন্ধ করে দেওয়ার পর আগাম পেঁয়াজ দাম কমাতে পারছে না। আগের বছরের চেয়ে আড়াই থেকে তিন গুণ দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
আলু যে কোনো সময় চলে আসবে, এ কারণে অনুমতিপত্র নিয়েও সেভাবে আমদানি করেননি ব্যবসায়ীরা।
অন্যান্য সময় বছরের এ সময়ে আগাম আলু চলে আসলে কদর হারায় পুরানটা। কিন্তু এখনও বাজারে পুরান আলুর ‘রাজত্বই’ চলছে। দাম নির্ধারণ করছে গত বছরের উৎপাদন। নতুন আলু তুলনামূলক কম, থাকলেও আকারে ছোট।
রংপুর কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক এনামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নতুন আলুর দাম উঠলে পুরান আলুর দাম পড়ে যায়। এবার পুরান আলুর দাম পড়েনি। রংপুরে পুরান আলুই ৫০ টাকা, আর নতুন আলুর দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।”
গত বছর এই সময়টায় আলুর খুচরা দর ছিল ২০ টাকার আশেপাশে, সেটি এবার ৭০ টাকারও ছাড়িয়েছে। ক্রেতারা বিরক্ত, হতাশ, ক্ষুব্ধ আর হতভম্ভ। কী হচ্ছে আসলে?
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে খুচরা পর্যায়ে নতুন আলু ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে বেচতে দেখা গেছে। বিক্রেতারা জানালেন, দুইদিন আগে দাম ছিল ৮০ টাকা।
কৃষক ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
দাম কেন এবার এত চড়া?-সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বেশ কয়েকজন চাষি ও ঢাকায় সরবরাহকারীর সঙ্গে কথা বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর জানতে পেরেছে, আগাম আলু পরিপক্ক হতে এবার সময় লেগেছে বেশি। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টির কারণে মাঠ প্রস্তুতে বিলম্ব এর প্রধান কারণ।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় ৩০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছেন মো. ওয়াদুদ হোসেন। মঙ্গল ও বুধবারে তিনি মানভেদে কেজি প্রতি পেয়েছেন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে।
ব্যবসায়ীরা তার ক্ষেত থেকে আলু উঠিয়ে নিয়ে যায় জানিয়ে এই চাষি বলেন, “এখনো আলু পরিপক্ব না হওয়ায় সব ক্ষেত থেকে আলু নিতে পারছে না। পরিপক্ব হইতে আরো কয়টা দিন লাগবে।”
কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর ভান্ডারের আড়ৎদার মো. শামছুল হক বলেন, “বৃষ্টি হইছে আলু লাগাইতে পারে নাই। দেরিতে লাগানো হইছে, তাই পরিপক্ব হইতেও সময় লাগতাছে। রোপন করার পর ৬০-৭০ দিন লাগে আলু পরিপক্ব হইতে।”
অক্টোবরের শেষে ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে ঝড় বৃষ্টিতে আলুর ক্ষেত প্রস্তুতে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয় কৃষককে। নভেম্বরের শুরুতে মৌসুমি লঘুচাপ এবং মধ্যভাগে আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র কারণেও টানা বৃষ্টি হয়।
এরপর ডিসেম্বরের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবেও বেশ বৃষ্টি হয়। আলুর রোপন করা ক্ষেত ডুবে যায়।
নীলফামারীর সৈয়দপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া ও মুন্সীগঞ্জ থেকে আলু আসে কারওয়ান বাজারের পাইকারি দোকানি মো. বিল্লাল হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, “মানিকগঞ্জের আলু এখনো পরিপক্ব হয় নাই। চারদিন-পাঁচদিন পরেই হয়ত হইয়া যাইব। আমার এখানে বড় আলু ঠাকুরগাঁও থেকে আসছে। যতবড় আলু, দাম তত বেশি।”
যে পরিমাণ আলু আসছে, তা চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয় জানিয়ে বিক্রমপুর ভান্ডারের শামছুল হক বলেন, “পুরান আলু প্রায় শেষ। এখন অল্প কিছু আছে দুইদিন বাদে তাও থাকবে না। যখন সবাই দেখছে যোগান কম হচ্ছে, তখনই যে যে অবস্থাতেই ছিল দাম বাড়াইয়া দিছে।
আলু আসার এই বিলম্বে বাজারে এবার উল্টো দৌড়। তিন সপ্তাহ আগে নতুন আলু ঢাকায় খুচরা পর্যায়ে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় পাওয়া গেছে, সেটি এখন ৭০ টাকার বেশি।
বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারে পাইকারি দোকানে নতুন আলু মানভেদে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা আর পুরান আলু ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অথচ ১০দিন আগেও এসব পাইকারি দোকানে দেশি নতুন আলু ৪৪ থেকে ৪৬ টাকা ও পুরান আলু ৪৮ থেকে ৪৯ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।
দ্রুতই কমবে দাম, বলছেন ব্যবসায়ীরা
কারওয়ানবাজারের আড়ৎদার মো. চান মিয়া বলেন, “দুই দিন আলু আইছে কম তাই দাম বাইড়া গেছে। আস্তে আস্তে কইমা যাইব। দাম থাকব না বেশি।”
বগুড়া ও ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকদের থেকে আলু কিনে ঢাকার কারওয়ান বাজারে আড়ৎদারদের কাছে বিক্রি করেন হামিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, “চাষিদেরকে আমরা এই দুই-চারদিন দিয়েছি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কইরে। দুইদিন মাল উঠি নাই তাই দাম বাইড়ে গিয়েছিল, এখন মাল উঠতিছে এখন আবার কমি যাবে।”
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের দোকানি মো. মাসুদ বলেন, “দুইদিন আগে ৮০ টাকা করে কেজি হয়েছিল আলু। আজ নতুন আলু ৬০ টাকা আর লাল আলু ৭০ টাকা করে কেজি। আর আমার কাছে পুরান আলু নাই।”
ক্রেতারা অবশ্য বিক্রেতাদের এসব আশ্বাস আর উৎপাদনে বৃষ্টির প্রভাবের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে নারাজ। তারা ত্যক্ত-বিরক্ত।
মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে আলু কিনতে আসা মো. হাসানুজ্জামান এক বিক্রেতাকে বলছিলেন “মৌসুমেও আলুর দাম কমান না কেন? আমরা কি না খেয়ে মরব? সবকিছুর দাম বেশি, আলুর দামটা একটু ধারে কাছে ছিল। এখন এটারও দাম বেড়ে যাচ্ছে।”
‘শঙ্কায়’ উদ্যানতত্ত্ববিদ
যে বৃষ্টির কারণে সময়মতো আলু রোপন করতে পারেননি বলে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, সে বিষয়টি জানালে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রহিম বলেন, “এটা ঠিক। এবার আলুর বাজারে ঘাটতিতে বৃষ্টিটা বড় কারণ। উত্তরবঙ্গে আগাম যে আলুটা চাষ হয়, সেটি ৬০ থেকে ৭০ দিনে বাজারে চলে আসে।
“কৃষকরা মাটিটা সরিয়ে দিয়ে বড় আলু তুলে আবার গাছ ঢেকে দেয়। তারপর বাকি আলু পরিপক্ক হলে আবার তা তোলে। এবার যেহেতু দেরিতে লাগিয়েছে, তাই আলুটা বড় হতে সময় নিচ্ছে। বাজারে দেখবেন নতুন যে আলু এসেছে, তার আকার ছোট।”
এবার আলু চাষের খরচ বেশি ছিল বলেও জানান এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, “আলুর দাম বেশি থাকার কারণে বীজের দামও বেশি ছিল। এটিও দামে প্রভাব ফেলার কথা।”
বাজারে এই মুহূর্তে দাম বেশি হওয়াটা আগামী দিনের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, “দাম বেশি বলে চাষিরা মার্কেটে অপরিপক্ক আলু নিয়ে আসছে। এই আলুতে কিন্তু পানি বেশি। ফলে সেটা তিন দিনের বেশি মজুদ করা যায় না।
“তারপরও এখন যে দাম পাচ্ছে, পরিপক্ক হলে চার কেজিতেও সেই দাম পাবে না। এই চিন্তা থেকে প্রচুর আলু নিয়ে আসা হচ্ছে। সরকারকে এই বিষয়টি মাথায় রেখে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কৃষকদেরকে বোঝাতে হবে।”
আরও পড়ুন
ভরা মৌসুমে শীতের সবজির দাম এবার বাড়ছে
দুর্মূল্যের বাজারে তাদের ভরসা ‘ভাগার সবজি’