দুর্মূল্যের বাজারে তাদের ভরসা ‘ভাগার সবজি’

“আগে অনেক বইসা থাকা লাগত, কেউ কিনতে আইত না তেমন। গরিব মানুষ আইত খালি। এখন সবাই-ই আসে, কম সময়ের মধ্যেই সব বেচাকেনা হয়ে যায়।”

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Dec 2023, 12:05 PM
Updated : 24 Dec 2023, 12:05 PM

সারা দেশ থেকে রাতে ঢাকার কারওয়ান বাজারে আসে সবজির ট্রাক; পরিবহনের সময় সেগুলোর কিছু নষ্ট হয়, ট্রাক থেকে নামানোর সময়ও পড়ে ভেঙে যায় কিছু।

খানিকটা নষ্ট, ভাঙা কিংবা আংশিক ছিলে যাওয়া সবজি কিনতে চান না খুচরা বিক্রতারা। অগত্যা পাইকাররা অল্প দরে তা বিক্রি করেন এক শ্রেণির বিক্রেতার কাছে; ভোর থেকে চট বিছিয়ে সেইসব সবজি বিক্রি হয় ভাগা হিসেবে।

কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁওয়ের আশেপাশে রাস্তার ধারে বিক্রি হয় এসব সবজি। দোকান ভাড়া দিয়ে বেশি দামের সবজি বিক্রির সামর্থ্য যাদের নেই, তারাই এসব দোকানের বিক্রেতা। আর বাজারে গিয়ে চড়া দামে যাদের সবজি কেনার সামর্থ্য নেই, তারাই ভাগা দরের সবজির ক্রেতা।

কেবল সামর্থ্যহীনরা নয়, টাটকা সবজির বাজারে গিয়ে এখন যাদের হা-হুতাশ কিংবা পকেটে টান পড়ছে, তাদের অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঝুঁকছেন এসব বিক্রেতাদের কাছে।

শনিবার সকালে কারওয়ান বাজারে এসব সবজি নিয়ে বসেছিলেন বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ। নষ্ট বা পোকায় খাওয়া সবজি কেটে চটের ওপর ভাগ ভাগ করে বিছিয়ে রেখেছিলেন তারা।

তাদেরই একজন শানু বেগম ভোরবেলায় পাইকারদের কাছ থেকে শিম ২৮০ টাকা, আলু ১৫০-২৮০ টাকা আর পেঁয়াজ কলি ১৮০ টাকা পাল্লা দরে কেনেন। এরপর চট বিছিয়ে ভাগ করে সেগুলো বিক্রি করতে বসেন।

প্রতি ভাগায় তার সবজির পরিমাণ আড়াইশ গ্রামের আশেপাশে, বিক্রি করছিলেন ২০ টাকা করে। সবজির ভাগার পরিমাণ নির্ধারিত হয় সেগুলোর কেনা দামের ওপর নির্ভর করে।

ষাটোর্ধ্ব শানু বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিন কুলে আমার কেউ নাই যে করে খাওয়াইব। টেহা-পয়সাও নাই। এ কারণে এই বয়সেও এগুলা করে খাইতে হয়। টেহা থাকলে আরও ভালা জিনিস কিনে বেচতে পারতাম।”

প্রতিদিন বিক্রি শেষে দুই-তিনশ টাকা লাভ থাকে জানিয়ে শানু বলেন, “হাইট্টা হাইট্টা হেগোর থেকে কিন্না আনি। কম টেহায় যেইডা কিনতে পারি, সেটার ভাগার মধ্যে বেশি সবজি দেই। বেশি টাকায় কিনলে ভাগায় কম রাখি। পরতা করতে হইব তো।”

বেগুনবাড়ির এই বাসিন্দা প্রায় তিন কেজি শসা তিন ভাগায় বিক্রি করেন ৫০ টাকায়। পেঁয়াজ কলি বিক্রি করেন ২০ টাকায়। বাজারের দোকান থেকে কিনতে প্রতি কেজি শসার দাম পড়বে ৫০ টাকা। কম দামে মেলায় সকালে কারওয়ান বাজারে ভাগা দরের ভাসমান দোকানগুলোতে বেশ ভিড় দেখা যায়।

ভাগা সবজির এ বাজার শেষ হয় বেলা ১২টার দিকে। একেক জন বিক্রি করেন ৫০ থেকে ৬০ কেজি সবজি। দিন শেষে লাভের হিসাবে থাকে তিন থেকে চারশ টাকা।

বাজারে শীতের সবজির সরবরাহ বাড়লেও দাম এখনও বেশি। সে কারণে অল্প আয়ের মানুষ এসব ভাসমান দোকানে ঝুঁকছেন বলে জানান বিক্রেতারা।

শানু বেগম বলেন, “আগে অনেক বইসা থাকা লাগত। কেউ কিনতে আইত না তেমন। গরিব মানুষ আইত খালি। এখন সবাই-ই আসে, কম সময়ের মধ্যেই সব বেচাকেনা হয়ে যায়।

“জিনিসগুলা একটু ভাঙ্গা তো, এ কারণে ঘরে যারা (দোকান) বসে তারা কিনে না। তহন আমরা কিন্না আনি।”

শানু বেগমের মত অনেকে ভাগা দরে কিনে বিক্রি করলেও, অনেকে আবার কারওয়ান বাজারে সবজি টুকিয়েও সকালে বিক্রি করেন। সেসব সবজির অবস্থা ভালো না হলেও তারা কেটে কেটে অল্প টাকায় বেচেন।

ভাগা দরের শসার দামাদামি করছিলেন হালিম বিক্রেতা সবুজ মিয়া। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বর্তমানে জিনিসপত্রের যে দাম, এখন আমরা একটু সাশ্রয় করার জন্য এখান থেকে কিনতে আসছি। অন্য জায়গা থেকে কিনলে চলতে পারি না।”

কারওয়ান বাজারে কিছু কাঁচা কলা আর পেঁপে নিয়ে বসেছিলেন জহুরা খাতুন। তার ভাষায়, “টোহায় টাহায় এনে বিক্রি করি। এগুলা বেচে সংসার কোনোরকমে চলে। দিনে খাইয়া লইয়া তিন-চারশ টাকা থাকে আরকি।”

কুড়িয়ে আনা সবজি ভাগা দরে বিক্রি করতে গেলেও ৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয় জহুরা খাতুনকে। সেই চাঁদা তুলতে আসেন এক নারী, জহুরা যাকে চেনেন না।

‘যা বেচি তাই লাভ, জীবন চলে গেলেই হইল’

অনেক বছর আগে সবজি টুকিয়ে এনে তেজগাঁওয়ের বাউলবাগ রেললাইনের পাশে এবং তেজকুনি পাড়া ফ্লাইওভারের নিচে বিক্রি করতেন কয়েকজন নারী। তাদের কাছে সবজি মাপার পাল্লা না থাকায় বিক্রি করতেন ভাগা দরে। এরপর থেকেই বাজার দুটির নাম ‘ফকিন্নি বাজার’ হয়ে ওঠে বলে জানান এখনকার বিক্রেতারা।

কারওয়ান বাজার থেকে নিম্নমানের সবজি কিনে কিংবা টুকিয়ে আনা সবজি এখনও বিক্রি হয় ওই বাজারে।

তেজকুনি পাড়ার ফ্লাইওভারের নিচে বসা বিক্রেতা মালেক মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাতে ঘুরে ঘুরে টোকায় আনি সবজিগুলা। সেগুলা দুপুর পর্যন্ত বেচে যে টাকা পাই, সেইটা দিয়ে পরিবারের খাওয়ার ব্যবস্থা করি। তা ছাড়া আমাগোর চলার কোনো অবস্থা নাই।

“কোনো জমিজমা নাই, নদী ভাইঙ্গা নিয়ে গেছে ঘরবাড়ি। বুড়া বয়সে আর কী করমু কন?

১০ টাকা ভাগায় সবজি বিক্রি করতে বসা মালেক বলেন, “এর চেয়ে বেশি টেহায় বেচতে গেলে কেউ নিব না, তাই কম টেহায় বেচি। যা বেচি তাই লাভ। জীবন চলে গেলেই হইল।”

এই বাজারে বসার জন্য কোনো চাঁদা দিতে না হলেও বাজার কমিটিকে জায়গার ভাড়া বাবদ প্রতিদিন ১০০ টাকা দিতে হয় বলে জানান মালেক মিয়া।

তেজকুনি পাড়ার ফ্লাইওভারের নিচ থেকে সবজি কিনতে আসা মুক্তার মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভালোই জিনিসগুলো, খারাপ না। কিন্তু একটু ভাঙ্গা আরকি। এখানে একটু কমে বিক্রি হয় তাই আসি, অন্য বাজারে গেলে পোষাইতে পারি না এখন আর।”

তেজগাঁওয়ের গোলাপবাগ রেললাইনের পাশে ফকিন্নি বাজারে এমন সবজি বিক্রি চলে সারাদিনই। বিক্রেতা সাবিনা খাতুন বলেন, “কারওয়ান বাজার থেহন নিয়ে আয়ি। ওইগুলা ৫০ টেহা, ২০০ টেহার কিনি।”

বিক্রি কেমন হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আল্লাহ তো কমবেশি দেয়, নাইলে চলি কেমনে। একদিন কম হয়, একদিন বেশি আয় হয়। এভাবেই চলি।”

আরেক বিক্রেতা জামিল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটু কম দামে কিন্না আনি। কাটাকোটা, দাগিদোগি, পচা থাকে, এজন্য কম দামে আনতে পারি। এগুলারে পরে কেটে-কুটে সাইজ করে আমরা কম দামে বিক্রি করি।”

প্রতি ভাগায় আড়াইশ গ্রামের মত বরবটি জামিল বিক্রি করছিলেন ১০ টাকায়। অন্য বাজারে বরবটি ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।

জামিল বলেন, “ভালোটা এখানে এনে ভাগা দিলে আমাদের পোষাবে না। ওইটার দাম বেশি আর ওইটা তো এখানে খাবে না। এখানে তো সব গরীব ক্রেতা।”