পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঢাকার নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনকে করে তুলেছে কঠিন। মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় তাদের জীবনের চাপ আরও বেশি।
Published : 23 Dec 2023, 06:26 PM
“কোরবানির ঈদ ছাড়া গরুর মাংস খাইতে পারি না। মুরগি দূরের কথা, মাসে একবার মাছও কিনা অয় না। ডাইল, আর শাকসবজি দিয়াই আমাদের ক্ষুধা মেটে। সবজির দাম বাড়লে অনেক বেলায় ভাতের লগে লবণ আর পোড়া মরিচ মাইখ্যা খায়া নেই।”
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে চলতি বছর আলু-পেঁয়াজ আর সবজির উচ্চমূল্য প্রান্তিক মানুষদের খাদ্যাভ্যাসে কী প্রভাব ফেলেছে, তার উদাহরণ হতে পারেন ঢাকার আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ কাঞ্চন মিয়া।
গত একটি বছরে পণ্যবাজারে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশে ছুঁই ছুই। তবে সবজি, মাছ-মাংস আর পেঁয়াজ আলু ও মসলাম দাম বেড়েছে আরও বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে তা হয়েছে দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি। ফলে কাঞ্চন মিয়াদের মতো মানুষদের জীবনে ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি আসলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি চাপ তৈরি করেছে।
মিরপুর, কালসী, আগারগাঁও ও মোহাম্মদপুরে নিম্ন আয়ের অন্তত ১০টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র জানতে পেরেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। এসব পরিবারের মাসিক আয় ১২ হাজার টাকা থেকে ২২ হাজার টাকার মধ্যে, পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪ থেকে ৬ জন পর্যন্ত।
ধীরে ধীরে ঋণের চক্রে পড়ে যাওয়া, ২/১ বেলা না খেয়ে থাকা, সন্তানদের কাছে রাখতে না পেরে নানি বা দাদি বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়াসহ জীবনের কঠিন বাস্তবতা উঠে এসেছে এসব আলাপচারিতায়।
শীত পড়ার আগে আগে কমে আসছিল সবজির দর। কিন্তু অবাক হয়ে ক্রেতারা দেখছেন, শীতের ভরা মৌসুমে শিমের কেজি ৭০ থেকে ৮০, ফুলকপি ৫০ টাকা, আর নতুন আলুর কেজি যে সময়ে ক্রমে কমার কথা, সেই সময় উল্টো বাড়ছে। আগের সপ্তাহেও যে আলু পাওয়া গেছে ৫০ টাকায়, সেটি এখন চড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়, ক্ষেত্র বিশেষে তার চেয়ে বেশি। গত বছর এই সময়ে নতুন আলুর কেজি ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা।
অন্য কিছু না থাকলে একটু পেঁয়াজ আর মরিচ ডলে আলু ভর্তা দিয়ে কম পয়সায় ভাত খেয়ে নেওয়া যাবে, সেই উপায়ও নেই।
গত বছরের এই সময়ে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজ এবার ১০০তে কিনতে পারলেই বর্তে যাচ্ছে মানুষ।
‘চাইরটা জিনিসের দাম কমান’
এক সময় রাজমিস্ত্রীর কাজ করা কাঞ্চন মিয়া এখন বয়সের কারণে নিয়মিত কাজে নেই। মাঝে মধ্যে ছুটা কাজের সুযোগ পেয়ে তিনি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। নিজের দুই ছেলে নিয়মিত কাজে যোগ দেওয়ায় পরিবারে ৩০ হাজার টাকার মতো আয় করার একটা ব্যবস্থা আছে। তবে ইতোমধ্যেই বড় ছেলেটি বিয়ে করেছেন, আছে এক নাতনি।
কাঞ্চন বলেন, “কবে যে ভালো খাবার খেয়েছি মনেও নেই। মাঝে মধ্যে শাক সবজিও জোগাড় করতে পরি না। অনেক বেলায় শুকনো মরিচের ভর্তা দিয়েও ভাত খেতে হয়।”
আগারগাঁওয়ে বিএনপি বাজারে তালাচাবি সারাই করেন সালাউদ্দিন। তিনি বলেন, “চাউল, ডাইল, তেল লবণ এই চারটা জিনিসের দাম কমায়ে দিলে সরকারের কাছে আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই। সবজি আমরা টোকায়া খাইতে পারুম। সাধারণ মানুষের গরুর গোস্ত আর মাছের দরকার নাই।”
মোহাম্মদপুরে এক ব্যাচেলর মেসে চুক্তিভিত্তিক রান্না করেন সুফিয়া আক্তার। তার পরিবারে স্বামী-সন্তান ও ছোট বোন মিলিয়ে চারজন। তার স্বামী কামাল হোসেন গাড়ি চালিয়ে মাসে আয় করেন ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা এবং তিনি আয় করেন চার হাজার টাকা।
সুফিয়া বলেন, “জামাই-বউ দুইজনে কাম করি। তাও ভালো খাইতে পারি না। এখন গরুর মাংসের দাম একটু কমছে। এখানেই একটু স্বস্তি পাইছি। কিন্তু কতদিন কম থাকব? আবার তো বাড়বই।”
ঋণের জালে
তিনটি ছেলে ও দুইটি মেয়ে সন্তান আছে সালাউদ্দিনের। বড় এই সংসার মাসে ২২ হাজার টাকা আয়ে চলে না। বিপরীতে সংসারের খরচ ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। বাকি অর্থ কীভাবে আসে?
জবাব মিলল তার বক্তব্যেই।
“ঋণে ঋণে জর্জরিত। ঋণের চাপে কিছুদিন আগে গ্রামের জমি বিক্রি করেছি। এখনও দোকানে চারটা সমিতির পাশ বই। প্রতিদিন চাইরটা ঋণের কিস্তি দিতে হয়। দুইটা পোলারে তাদের নানার বাড়ি পাঠায়া দিছি।”
এক ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার কেয়ারটেকার মুন্নার। থাকেন মিরপুরের বেগমটিলায়। মাস শেষে বেতন ৯ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, “অবস্থা আগের মতো আর নাই। আগের চেয়ে অনেক খারাপ। দাম অনেক বাইড়া গেছে। আগে খরচ কইরা চার-পাঁচশ টাকা জমাইতে পারতাম। এখন ধার কইরা চলতে হয়।
“ধার করা টাকা পরিশোধ করার জন্যও চাপ আসে, কিন্তু দিতে পারি না। এমনও দিন যায় আমরা খালি ডাল-ভাত খাই। দিনে সব বেলা খাওয়াও হয় না।”
মাছ-মাংস না কেনার যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন, “যে টাকা দিয়ে মাংস কিনব- দুই বেলা খায়াই শেষ হয়া যাবে, সেই টাকা দিয়ে তিন-চার দিনের কাঁচা বাজার করতে পারব। গরুর মাংস, মুরগির মাংস গরিবের লাগি না।”
মোহাম্মদপুর টাউনহলের আশেপাশে রিকশা চালান মো. লিটন। তার কাছে জানা গেল, আর্থিক চাপের কারণে এখন যাত্রী পাওয়া যায় কম। যে পথ আগে রিকশায় চলত মানুষ, সেই পথ এখন চলে হেঁটে।
তিনি বলেন, “আমাদের রিকশার বাজারও ভালা না। দিনে ৮/৯ ঘণ্টা চালাইলে পাঁচশ টাকার মতো থাকে। বাসা ভাড়া, মাইয়ার পড়ালেহার খরচ, খাবারের খরচ সবকিছু মিইল্যা চাপে আছি।
“এমন একটা অবস্থায় আছি প্রতি মাসেই ঋণ নিতে হইতাছে। মানুষজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়া কোনো রকমে মাস পার করি। আগে চলতে পারতাম কোনোরকমে, কিন্ত এখন পারতাছি না।”
সংসারে অশান্তি
বাজারদরের কারণে সংসারে শান্তিও উবে গেছে সালাউদ্দিনের।
তিনি বলেন, “সংসারে প্রতি মুহূর্তেই ক্যাচাল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ক্যাচলের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ৫০০ টাকা দিয়ে বাজার করতে পাঠালে বলে, ‘আপনি বাজার করে নিয়ে আসেন। এই টাকার বাজার হবে না।‘
“সব কিছুর দাম বাড়ছে, খালি গরুর গোস্তটার দাম কমেছে। তবুও আমরা গরুর গোস্ত কেনার চিন্তা করিনি।”
প্রাইভেটকার চালক আমির হোসেনের মাসিক বেতন ১৭ হাজার টাকা। তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষের অবস্থা খুব খারাপ। দিনমজুরের কাজ করলে ৫০০ টাকা ৬০০ টাকা পায় সত্য। কিন্তু এই টাকা দিয়ে জীবন চলে না। করোনার আগে আমরা আরেকটু ভালো ছিলাম। গত দুই বছর ধরে একেবারেই ভালো নাই। আগে যেখানে আধা কেজি কিনছি এখন আড়াইশ গ্রাম কিনতে হয়।”
তিনি বলেন, “দাম বাড়লে খুবই কষ্ট হয়ে যায় আমাদের। মাসে একটা মুরগি কিনে খাইতে পারি না। গত দুই এক মাসে তরকারির অভাবে ২/১ বেলা না খেয়েও ছিলাম। কিন্তু কারো কাছে হাত পাতি নাই “
চার সন্তান নিয়ে গৃহকর্মী সুরমা বেগমের পরিবার। এক ছেলের বয়স দুই বছরের কাছাকাছি। বাড়ি বাড়ি কাজ করে মাসে সাড়ে ৭ হাজার টাকা আয় করেন মিরপুরের এই বাসিন্দা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাচ্চারে আলাদা খাওয়াতে হয়। তার জন্য দুধ কিনতে হয়, মিছরি কিনতে হয়। একটা কিনতে গিয়ে দেখি আরেকটা কেনার টাকা নাই।
“বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। এটা খাব, সেটা খাব করে বাচ্চা। কিন্তু ক্ষুধা মেটানোর জন্য খাবারই তো কিনতে পারি না; এই আবদার কেমনে রাখব?“
নিত্যপণ্যের দাম কেমন
চলতি বছর বাজারে সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল সবজির দাম। শীত শুরুর পর দাম কিছুটা কমে আসলেও তা এখনও গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
গত বছরের এই সময়ে পেঁয়াজের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে থাকলেও এবার ভোক্তাদের তা ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় কিনে খেতে হচ্ছে।
রসুনও গত বছরের চেয়ে আড়াইগুণ বেশি দামে ২২০ টাকা থেকে ২৪০ টাকায় প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে। হলুদ বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় যা এক বছর আগে ২২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকায় পাওয়া যেত।
অধিকাংশ শীতের সবজির দাম এখনও ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। যদিও গত বছর এমন ভরা মওসুমে শীতের সবজির দাম প্রতিকেজি ৩০ টাকা থেকে ৪০ টাকার মধ্যে ছিল।
বাজারে দুই বছর ধরে সয়াবিন তেলের দাম প্রতিলিটার ২০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। যদিও দীর্ঘদিন ধরে মানুষ ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় সয়াবিন তেল খেয়ে অভ্যস্ত।
দুই বছর আগে কভিড মহামারীর মধ্যেও মানুষ ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা কেজিতে চিনি খেয়ে অভ্যস্ত ছিল। গত বছর এই পণ্যটির দাম ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকায় ছিল। এ বছর তা আরও বেড়ে প্রতিকেজি ১৪০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকায় উঠেছে।
বাজারে চালের দাম এখন প্রতিকেজি সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৭০ টাকার মধ্যে।
ইউক্রেইন রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে আটার দাম দ্বিগুণ বেড়েছে প্রতিকেজি ৭০ টাকায় উঠেছিল। এক বছর পর বিশ্বব্যাপী গমের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে, দামও কমে আগের জায়গায় এসেছে।
তবে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপদনে আটার দাম আগের মতো প্রতিকেজি ৩০ টাকা থেকে ৩২ টাকায় না এসে এখনও বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকার মধ্যে।
[এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ফয়সাল আতিক, নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল বাশার সাজ্জাদ ও সাবিকুন্নাহার লিপি]
নতুন আলু-পেঁয়াজের দর এবার ‘দ্বিগুণ’
সেপ্টেম্বরে সামান্য কমেছে মূল্যস্ফীতি, খাদ্যে ১২ শতাংশের বেশিই