ঢাকার বাজারে গত কয়েক বছরে জীবিত মাছ আনার প্রবণতা বেড়েছে। দাম কেজিতে ১০০ টাকার মতো বেশি। তবু ক্রেতার অভাব নেই।
Published : 25 Dec 2023, 06:04 PM
শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের পাশের কাঁচাবাজারে ১০ থেকে ১২টি মাছের দোকানের মধ্যে যে কয়েকটি দৃষ্টি কাড়ে, সেগুলোর একটি সেলিম উদ্দিনের। সেখানে জ্যান্ত মাছ বিক্রি হয়।
তিনি বললেন, “কেউ বেচে মরা মাছ, বরফ দিয়া, আমি বেচি জ্যাতা মাছ। মরা মাছ অনেকে পছন্দ করে না। আমার এই মাছের আলাদা কাস্টমার। তারা জেতা মাছই খোঁজে, দাম যেমনই হোক। অনেকেই আমার মুখ চেনা।”
এই বাজারে আরও তিনটি মাছের দোকান রয়েছে যারা দোকানের গদির নিচে কনক্রিটের স্থায়ী চৌবাচ্চা নির্মাণ করেছেন। চৌবাচ্চার পানিতে একটি ছোট অক্সিজেন মেশিন বসিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাছ জীবিত রাখছেন।
স্থায়ী অবকাঠামো ছাড়াও বিক্রেতারা প্লাস্টিকের ড্রাম, প্লাস্টিকের বড় চৌবাচ্চা রেখেছেন দোকানে। এর মধ্যে রুই, কাতল, শিং, মাগুর, কই, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, পাবদা, শোল, টাকি, সরপুটিসহ হরেক রকমের মাছ রয়েছে।
বিক্রেতা সেলিম বলেন, জ্যান্ত মাছ আর মরা মাছের মধ্যে দামের পার্থক্য কেজিতে একশ টাকা পর্যন্ত। বাজারদরের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে তবু তারা বেশি দরের মাছ বিক্রিতে মন দিয়েছেন। এর কারণ, বাড়তি দরের এই মাছের ক্রেতার অভাব নেই।
গত কয়েক বছরে ঢাকায় ক্রেতাদের এই জ্যান্ত মাছ কেনার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এমনকি রিকশা ভ্যানে চৌবাচ্চা বসিয়ে জ্যান্ত মাছ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় যাওয়ার দৃশ্যও বিরল হয় এখন।
এই মাছগুলো ঢাকায় আনা হয় ট্রাকে চৌবাচ্চা বানিয়ে। সেই পানিতে যেন অক্সিজেনের ঘাটতি না হয়, সে জন্য সেখানেও বসানো থাকে মেশিন।
কেবল বড় মাছ নয়, গুলশা, পুঁটির মতো মাছগুলো আনা হয় আবার পলিথিনের ব্যাগে করে। জ্যান্ত না হলে চাষের পাঙ্গাশ আর টাকি মাছ কিনতেই চান না অনেকে।
চাষের মাছ জ্যান্ত এনে বিক্রি ঠিক কবে শুরু হয়, তা বলতে পারছেন না বিক্রেতারা। তবে শুরুটা পাঙ্গাশ ও রুই-কাতলা দিয়ে হয়েছিল-এটা বলেছিলেন তারা। ইদানীং তেলাপিয়া এবং আরও অনেক ছোট মাছও যোগ হয়েছে এই তালিকায়।
জীবিত মাছের দাম বেশি থাকার কারণ ট্রাকে করে পরিমাণে আনা যায় কম, ফলে খরচ পড়ে বেশি। পাইকারি বাজার থেকে স্থানীয় বাজারে আনার খরচও বেশি। সেগুলোকে জীবিত রাখার পেছনেও যায় টাকা। আবার এই মাছগুলো মরে গেলে দাম কমে যায়, এই ঝুঁকিও হিসাব করতে হয়।
“এই যে দেখেন আমার পেছনে ড্রামগুলোতে পানি। আমি মাছ কিনে এখনে রাখি। সেখান থেকে সামনে বড় বড় বোলগুলোতে রেখে রেখে বিক্রি করি। কয়েক ঘণ্টা পর পর পানি পাল্টাইতে হয়”, বললেন শেওড়াপাড়ার বিক্রেতা সেলিম।
ঢাকার মহাখালী কাঁচা বাজার, মিরপুর হযরত শাহ আলী মার্কেট, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ আরও কয়েকটি বাজার ঘুরে বরফের মাছের পাশাপাশি জ্যান্ত মাছ বিক্রির আলাদা আয়োজন দেখা গেল।
বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, মাঝারি আকারের (দেড় থেকে দুই কেজি) জীবিত রুই মাছের দাম ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা। আর মৃত রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। মাঝারি জীবিত পাবদার দাম ৫০০ টাকা, মৃত হলে তা চারশ টাকা।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি আড়তের বিক্রেতা পলাশ মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাগর-নদী থেকে ধরা মাছগুলো বরফ দিয়া বাজারে আনা হয়।
কুমিল্লা, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা অঞ্চলের হাওর ও খামারের মাছের একাংশ বরফ দিয়ে, একাংশ আনা হয় পানিতে রেখে জীবিত হিসেবে।
মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজারের বিক্রেতা মো. নিজাম বলেন, “দেশি জিওলগুলো ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জ ও নেত্রকোণা থেকে আসে আমার এখানে। আর চাষেরগুলো ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জসহ অনেক জেলা থেকেই আসে।”
মিরপুর-১ নম্বরে দ্য দিপু মৎস আড়ৎ এর মালিক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, “মাসের শুরুর দিকে জিওল মাছের চাহিদা বেশি থাকে, মাসের শেষের দিকে চাহিদা কম থাকে। সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা বেশি কিনে।”
বেশি দামে কেন কেনেন ক্রেতারা?
মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে বাজার করতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা হাসানুল মামুনকে বেছে বেছে জীবিত মাছের দোকানগুলোকেই ঢু মারতে দেখা গেল। তিনি একটু বেশি দাম দিয়ে এক কেজি গুলশা মাছ নিলেন ৬০০ টাকা দিয়ে।
‘দাম তো বেশি পড়ল’- এই মন্তব্যের জবাবে মামুন বললেন, “একটু টাটকা ও মান ভালো মাছ চাইলে জীবিত মাছ কেনাই ভালো। দাম একটু বেশি হলেও ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। এটা রান্না করে খেতেও একটু বাড়তি স্বাদ পাওয়া যায়।”
কই শিং মাগুর, টাকির মতো দেশি জিওল মাছের ক্রেতারও অভাব নেই।
এদের একজন আল হেলাল। তিনি বললেন, “জিওল মাছ শরীরের জন্য ভালো। আমার পরিবারের সবাই খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে আমার স্ত্রী মাঝে মাঝেই জিওল মাছ নিতে বলে।”
গৃহিণী অপর্ণা দেবনাথ বলেন, “জিওল মাছ কয়েকদিন জীবিত রেখে অল্প অল্প করে ইচ্ছানুযায়ী খাওয়া যায়। এজন্য এটা আমার কাছে ভালো লাগে। আর টাটকা হওয়ায় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে, স্বাদও বেশি।”
তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় জ্যান্ত মাছের চাহিদাও কমছে বলে জানালেন বিক্রেতা ফিরোজ হোসাইন। তিনি বলেন, “গরিব মানুষ চাষেরটা কিনে। যাদের আয় বেশি তারা দাম দিয়া দেশিটা কিনে।
“আগে অনেক পরিমাণে চলত, তখন দেশি মাছই ৪০০-৫০০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন তো দ্বিগুণেরও বেশি। তাই আগের চেয়ে কম চলে। এখন সব মাছেরই দাম বাড়ছে। আমাদেরও দাম দিয়ে কিনে আনতে হয়।”
বিক্রেতার জন্য ‘লোকসানের ঝুঁকি’
মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে দেশি জীবিত শিং মাছের দর দেখা গেল কেজিতে ৯০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। বিক্রেতা জানালেন, মরে গেলে দাম নেমে আসবে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
একই বাজারে জীবিত গুলশা বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা দরে, মরে গেলে দাম নেমে আসবে ৫০০ টাকায়।
এই বাজারের বিক্রেতা সুমন মিয়া বলেন, “আগে এই মার্কেটে জীবিত মাছের চাহিদা আরও বেশি ছিল। ইদানীং একটু কমে গেছে। মার্কেটে আগুন লাগার পরই এমন পরিস্থিতি হয়েছে।“
শুক্রবার নিউ ইস্কাটনে দিলু রোডের পাশে ফ্লাইওভারের নিচে দোকানে এক বিক্রেতাকে দুপুরের আগে আগে বিরস বদনে ক্রেতার জন্য ডাকাডাকি করতে দেখা গেল। তার আনা বেশিরভাগ মাছ বিক্রি হয়নি।
মাছ তো আজ বেশি বিক্রি হয়নি, এই মাছ কী করবেন?- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “বরফ দিয়া রাখব।”
‘দাম কমে যাবে না?’- তিনি বললেন, “কী আর করা? একদিন সাড়ে চাইর হাজার টাকাও লোকসান দিছি। মরলেই দাম কমে। বেচতে পারলে লাভ হয়।”
মিরপুর-১ এ হযরত শাহ আলী মার্কেটে বড় আকারের দেশি কই এক হাজার টাকা এবং শিং-মাগুর ১২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেল।
বিক্রেতা মো. রায়হান বলেন, “আমার এখানে একদিনে বিক্রি হয় ১২ থেকে ১৫ কেজি।”