সিইসির নয়, গাইবান্ধার ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত ইসির: হাবিবুল আউয়াল

গাইবান্ধা উপ নির্বাচনের অনিয়মগুলো তদন্তে একটি কমিটি করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ভোটের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়েছেন সিইসি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2022, 10:34 AM
Updated : 13 Oct 2022, 10:34 AM

গাইবান্ধার উপ নির্বাচনে মাঝপথে ভোটগ্রহণ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মধ্যে সাংবাদ সম্মেলনে এসে ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।

তিনি বলেছেন, “আমরা হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। এই সিদ্ধান্ত সিইসি গ্রহণ করেনি, কমিশন গ্রহণ করেছে। সিইসি কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে গ্রহণ করেন না; করতেও পারেন না।”

ঢাকা থেকে সিসিটিভিতে ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি দেখার পর ভোটকক্ষে নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপরও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ‘কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি’ বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান সিইসি। 

ওই পরিস্থিতিতে ‘সর্বসম্মত’ সিদ্ধান্তে ভোট বন্ধ করার কথা জানিয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “কমিশন সদস্যরা বসে আলাপ-আলোচনা করে চিন্তাভাবনা করে যৌথভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।“

ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের উপ নির্বাচন ছিল বুধবার। ১৪৫টি কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই ইভিএমে ভোটগ্রহণ চলছিল।

সবগুলো কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরা বসিয়ে ঢাকার নির্বাচন ভবনে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল ভোটের পরিস্থিতি। সেখানে নানা অনিয়মের ঘটনা সরাসরি দেখে দুপুরের মধ্যেই অর্ধশত কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধের নির্দেশ দেয় ইসি। বেলা আড়াইটার দিকে পুরো নির্বাচন স্থগিতের সিদ্ধান্ত জানান সিইসি আউয়াল।

সাত মাস বয়সী বর্তমান ইসির অধীনে এটাই ছিল কোনো সংসদীয় আসনের প্রথম নির্বাচন; আর সেখানেই মাঝপথে পুরো আসনের ভোট বন্ধের নজিরবিহীন ওই ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিএনপিবিহীন এই ভোটে অংশগ্রহণকারী জাতীয় পার্টি ইসির সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ দিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলে, গোলযোগহীন এই নির্বাচনে ভোট বন্ধ করার কারণ তাদের কাছে বোধগম্য নয়। 

এ পরিস্থিতিতে ‘বিভ্রান্তি’দূর করতে’ বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে আসেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীর তার সঙ্গে ছিলেন।

Also Read: গোপন কক্ষে ব্যাপক অনিয়ম, মাঝপথে বন্ধ হল গাইবান্ধার ভোটগ্রহণ

Also Read: গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচন: আওয়ামী লীগ ছাড়া সব প্রার্থীর ভোট বর্জন

Also Read: গাইবান্ধা উপ-নির্বাচনের পুনঃতফসিল দাবি জাতীয় পার্টির

গাইবান্ধার উপনির্বাচনে কেমন অনিয়ম হয়েছিল, ইসি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, কোন পরিস্থিতে, কীভাবে ভোট বন্ধ করা হয়েছে- তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন সিইসি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাবিবুল আউয়াল বলেন, “আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে হয়ত জনমনে কিছু বিভ্রান্তি থাকতে পারে। আমরা টকশোতে শুনেছি কেউ আনন্দিত হয়েছে, কেউ ব্যথিত হয়েছে, কেউ প্রতিবাদ করেছেন, কেউ সমবেদনা জানিয়েছেন। আমাদের মনে হয়েছে। এতে করে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। সেই বিভ্রান্তি অপলোপনের জন্য কিছু ব্যাখ্যা আমাদের দেওয়া দরকার।” 

তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন সমার্থক নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও একজন কমিশনার। একাধিক সদস্য নিয়ে এই কমিশন গঠিত হয়, একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার হন এবং তিনি এ সংস্থার চেয়ারম্যান হন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কোনো সিদ্ধান্তে এককভাবে গ্রহণ করেন না বা করতে পারেন না। 

“এ জন্যই আপনাদের মাধ্যমে, আমরা বলতে চাই যে আমরা কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিই নাই।… সকলকে বুঝতে হবে, এটা কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা নিগুঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তারপরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

সিসি ক্যামেরা কেন

লিখিত বক্তব্যে সিইসি বলেন, বুধবার উপ নির্বাচনটি যাতে অবাধ, নিরোপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়, সে জন্য ইসির পক্ষ থেকে সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর একজন নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনী এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বিষয়ক সভা করেন। সেখানে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্থানীয় প্রধান, সকল প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

“পরে আমি নিজে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রিটার্নিং অফিসারের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছি যাতে একটি অবাধ, নিরোপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা সম্ভব হয়।”

ইভিএম ও সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, তার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর যতগুলো নির্বাচন করেছে, সবগুলো নির্বাচনে ‘অত্যন্ত সফলভাবে’ ইভিএম ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে প্রত্যেক ভোট কেন্দ্রের প্রতিটি ভোট কক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল।

ইভিএমের গোপন ভোটকক্ষে অবৈধভাবে বাড়তি লোক প্রবেশ করে ভোটারকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে বাধ্য করার পুরনো অভিযোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সিসিটিভি স্থাপনের ফলে এই অপরাধ একেবারেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। তারই আলোকে গাইবান্ধা উপ নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ ও প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়।”

Also Read: উপ-নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত গাইবান্ধা, কেন্দ্র থেকে চোখ রাখবে ইসি

Also Read: গাইবান্ধায় ইসির রশি ছুটল, না বাঁধন কষল?

Also Read: গাইবান্ধায় ভোট স্থগিতে আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ, অন্যদের স্বস্তি

Also Read: সিসি ক্যামেরায় দেখে ভোট বন্ধ কতটা যৌক্তিক, প্রশ্ন কাদেরের

কী কী অনিয়ম হল

 সিইসি জানান, ভোট শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ঢাকার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে তিনটি কেন্দ্রে অনিয়মের দৃশ্য দেখতে পান।

 “ভোট কক্ষে প্রার্থীর পুরুষ এজেন্টরা একই রকম গেঞ্জি, বুকে ও পিঠে প্রার্থীর মার্কা ইত্যাদি প্রিন্ট করা… মহিলা এজেন্টগণ একই রকম শাড়ি পরা, যা আচরণ বিধিমালার ১০ (ঙ) ভঙ্গের মধ্যে পড়ে। এই সকল এজেন্ট ছাড়াও আরো অনেক অবৈধ লোকজন ভোটকক্ষে অবস্থান করে ভোটাদেরকে ভোট দিতে প্রভাবিত করছেন।”

 অনিয়মের ধরন তুলে ধরে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটাদের আঙুলের ছাপ দেওয়ার পরপরই এজেন্টগণ গোপন ভোটকক্ষে প্রবেশ করে ভোটারকে ভোট দানের সুযোগ না দিয়ে নিজেই ভোট দিয়ে দিচ্ছেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ একই কাজ করছেন।

“তখন কমিশন থেকে ফোন দিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারদের ভোট কক্ষের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ভোট কক্ষের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ তাদেরকে গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।”

সিইসি বলেন, “তখন ওই তিনটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করার নির্দেশনা কমিশন থেকে দেওয়া হয়। পরে একে একে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ৫০টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে দেখা হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের অবস্থা একই রকম দেখা যায়।

“ইতোমধ্যে রিটার্নিং অফিসার একটি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেন। আমি এবং নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা রিটার্নিং অফিসার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সাথে টেলিফোনে কথা বলি। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় নাই। অন্যান্য কেন্দ্রগুলোতেও সিসিটিভি দেখার সময় পেলে দেখা যেত যে ও কেন্দ্রগুলোতেও একই অবস্থা, তাই কমিশন মনে করে যে এই ধরনের একটি আইন বহির্ভূত ভোট কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”

সে কারণে বেলা আড়াইটায় কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন সম্পূর্নভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয় বলে জানান সিইসি।

তদন্ত কমিটি

সিইসি জানান, উপ নির্বাচনের অনিয়মগুলো তদন্ত করে আগামী ৭ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দিতে একটি কমিটি করা হয়েছে।

ইসির অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের এ কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর গাইবান্ধা ৫ আসনের নির্বাচন বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।