দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না, পরিবর্তিত অবস্থায় সে বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে নির্বাচন কমিশনকে।
অর্ধশতাধিক আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়ার মেশিন থাকলেও অর্থ জোগান সাপেক্ষে মেরামতের বিষয়টি আটকে যাওয়ায় ইসিকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
সাত মাস পর জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হবে; ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোও গুছিয়ে আনছে নির্বাচন কমিশন।
এরই মধ্যে ইভিএম ব্যবহার, নির্বাচনী আইন সংস্কার, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, গণমাধ্যমকর্মী নীতিমালার কাজও এগিয়ে চলছে। সেইসঙ্গে ভোটের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচন সারতে প্রস্তুতিও চলছে।
সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে সপ্তদশ কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার রয়েছে আলোচ্যসূচিতে।
জানতে চাইলে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে, ইভিএম নিয়েও কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে। ইসির নির্দেশনা পেলে পরবর্তী কাজও শুরু করতে হবে। সোমবার কমিশন সভায় আলোচনার পর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
এই কর্মকর্তা জানান, সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের কথা রয়েছে। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে কয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার সম্ভবপর হবে, ইভিএম মেরামত করার জন্য অর্থ চাওয়া হয়েছে, সংস্থান হবে কিনা এবং আদৌ ইভিএমে ভোট হবে কিনা, তা পর্যালোচনা হতে পারে সভায়।
“আদৌ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে কিনা- সে বিষয়টি এখন চূড়ান্ত হবে। হয় ইভিএম ব্যবহার করতে হবে, তাহলে অনেক কাজ শুরু করতে হবে। নতুবা ইভিএম ব্যবহার হবে না; তাহলে অন্যান্য প্রস্তুতির কাজও শুরু হয়ে যাবে।”
২০১৮ সালে দেড় লাখ সচল ইভিএম থাকার পরও মাত্র ছয় আসনে ইভিএম ব্যবহার হয়েছিল। পাঁচ বছরের মধ্যে বেশিরভাগ ইভিএম মেরামত উপযোগী হয়ে পড়ে, যার জন্য ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা অর্থসংস্থানের প্রয়োজন পড়ে।
মধ্য মার্চে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান দ্রুত সিদ্ধান্তে আসার বিষয়টি আভাসও দিয়েছিলেন। এ নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, “যদি অর্থ বিভাগ টাকা সংস্থান করে, তাহলে আমরা ইভিএমের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হব।
“(ইভিএম মেনটেইনেন্সের জন্য) যদি টাকা না পাওয়া যায়, তাতেও আমাদের সিদ্ধান্তে আসতে হবে- ব্যালটে কতটা করব বা ইভিএমে আদৌ করব কিনা। কাজেই সবটাই নির্ভর করবে অর্থ প্রাপ্তির উপর।”
নির্বাচন কমিশনার সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবিব খান জানান, ইসি ২০১৮ সালে ইভিএম প্রকল্পের অনুমোদন পায়। প্রকল্পে শুধু দেড় লাখ ইভিএম ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতির ক্রয় অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং প্রতিটি ইভিএম এর জন্য এক বছর গ্যারান্টি ও পাঁচ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি দেওয়া হয়। প্রকল্পে সংরক্ষণ সংক্রান্ত কোনো খাত অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
তিনি জানান, মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও সংরক্ষণ করার ব্যাবস্থা না থাকায় ইসির ইভিএমগুলো প্রাথমিকভাবে জেলা, উপজেলার বিভিন্ন স্কুল/কলেজ ও সরকারি স্থাপনায় রাখা হয়। এই সব স্থাপনার পরিবেশ ইভিএম সংরক্ষণের জন্য সহায়ক ও উপযুক্ত ছিল না।
“এর ফলে মাঠ পর্যায়ে সংরক্ষিত ইভিএম সমূহ ক্ষেত্র বিশেষে বিনষ্ট হয়। বর্তমানে ইসি জেলা পর্যায়ে বাসা ভাড়া করে ইভিএম সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।”
ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ এ বছরের জুনে শেষ হবে। আগামী সংসদীয় নির্বাচন প্রকল্পের মেয়াদ শেষে ২০২৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব বলেন, “ইভিএমগুলোর ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও এ বছরের জুনে শেষ, সেহেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএমটিএফ সার্বিক বিবেচনায় ইভিএম সংস্কারের প্রস্তাব ইসিকে জানিয়েছে।”
নতুন প্রকল্প স্থগিতের পর এবার অর্থ জোগান না পেলে মেরামতের অভাবে হাতে থাকা ইভিএম দিয়ে সংসদ নির্বাচন করা থেকেও সরে আসতে পারে ইসি। সেক্ষেত্রে বিরোধী অনেক দলের চাওয়াও পূরণ হতে পারে।
জানুয়ারিতে অর্থ সঙ্কটে ইভিএম কেনার প্রকল্প স্থগিত হলে দেড়শ আসনে মেশিনে ভোট করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ইসি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেসময় নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেছিলেন, “আমরা সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে নতুন ইভিএম কেনার প্রকল্প আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
“তবে এর মধ্যে দিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের ‘প্রত্যাশা পূরণ হল’।বিশিষ্ট নাগরিকদের যে ইচ্ছা ছিল, সেটাও বাস্তবায়িত হল। এখন আমরা মনে করি, দল মত নির্বিশেষে বর্তমান সিদ্ধান্ত পছন্দ করবে। আমরা আশা করি, সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে এবং সহযোগিতা করবে।”
রোডম্যাপ ধরে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সংলাপ বর্জন করা বিএনপি ও অন্যান্য দলগুলোর মতামত নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনারও ডাক দিয়েছেন সিইসি।
দলগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানের মধ্যে দেড়শ আসনে ইভিএমের পরিকল্পনা নিয়ে এগোলেও নতুন প্রকল্প নিয়ে সরকারের সায় না পাওয়ায় বড় পরিসরে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে ইসি। তবে কমিশনের হাতে থাকা দেড় লাখ ইভিএম দিয়ে যে অর্ধশতাধিক আসনে ইভিএমে ভোট করার কথা বলে আসছে কমিশন, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।
ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, সোমবার কমিশন সভায় প্রায় পাঁচটি আলোচ্যসূচি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সিটি করপোরেশন নির্বাচন, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম, নির্বাচনে সংবাদ সংগ্রহে সাংবাদিক ও গণমাধ্যকর্মীদের জন্য নীতিমালা, বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) এর সঙ্গে চুক্তি অনুমোদন এবং বিবিধ।