সোমালি জলদস্যুদের ডেরায় জাফর ইকবালের আট মাস

২০১০ সালে জিম্মি হয়ে সোমালিয়ায় ২৩২ দিন বন্দি জীবন কাটিয়েছেন বাংলাদেশি নাবিক জাফর ইকবাল। দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক, চাপের মধ্যে দিন কাটত তার। এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদেরও এ পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হবে, বলছেন তিনি।

মিন্টু চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2024, 06:00 PM
Updated : 14 March 2024, 06:00 PM

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য পরিবহন কাজে গিয়ে সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে প্রায় আট মাস বন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে বাংলাদেশের জাফর ইকবালকে।

প্রায় ১৪ বছর আগে ভয়ংকর এক দুঃসময় দেখেছিলেন তিনি, প্রতিটা মুহূর্তে ছিল প্রাণ যাওয়ার ভয়। এডেন উপসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ার সেই লোমহর্ষক ঘটনার স্মৃতিচারণে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার।

চারপাশে ঘিরে থাকা অস্ত্রধারীদের মাঝে থেকে ধৈর্য আর বিচক্ষণতায় মনোবল ধরে রেখেছিলেন জাফর ও তার দল। এক পর্যায়ে ২৩২ দিন পর আঁধার ঘরে আসে আলো, প্রাণ ফিরে পান সবাই।

এক যুগের কিছু বেশি সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে দখল করে নিয়ে সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়ার পর অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সরকারও বলছে, সেসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই আগাতে চায় তারা।

এমভি আব্দুল্লাহর আগে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হন এমভি জাহান মনির নাবিক ও কর্মীরা। দুটি জাহাজই চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কোম্পানি এস আর শিপিংয়ের মালিকানাধীন, যারা কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। জাহান মণিতে নাবিক ও ক্রু ছিলেন ২৫ জন, এবার জিম্মি হয়েছেন ২৩ জন।

তবে সেখানে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া আরো একাধিক জাহাজে কাজ করেছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। জাফর ইকবাল যে জাহাজটিতে কাজ করতেন তার নাম ছিল ‘মারিডা মার্গারিটা’। সেটি ছিল জার্মান সমুদ্র যান। সেখানে চিফ অফিসার ছিলেন তিনি।

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে জাফর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা চরম মানসিক চাপে থাকবেন, তবে তাদের ধৈর্য ধরতে হবে। জলদস্যুরা তাদের নিয়মেই জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ দাবি করবে এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্তি মিলবে।”

২০১০ সালের ৮ মে এডেন উপসাগরে জলদস্যুরা মারিডা মার্গারিটার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ওই ছিলেন ২২ জন নাবিক। এর মধ্যে দুজন বাংলাদেশি, ১৯ জন ভারতীয় এবং একজন ছিলেন ইউক্রেনীয়।

সেই জাহাজে বাংলাদেশি অপর নাবিকের নাম ছিল গিয়াস উদ্দিন, ছিলেন সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজ ও নাবিকদের ছাড়া হয় ২০১০ সালের ২৮ ডিসেম্বর।

জাফর ইকবাল, “২৩২ দিনের মতো জিম্মি ছিলাম। বেশিরভাগ সময়ই আমি ও গিয়াস একসঙ্গে থাকতাম। বন্দিদশায় পরিবার এবং স্বজনদের নিয়ে খুবই খারাপ লাগত। দুশ্চিন্তা, আতঙ্ক এবং চাপের মধ্যে দিন কাটত। এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদেরও এ পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হবে।”

জাহান মনি ও আব্দুল্লাহর মত মারিডা মার্গারিটাও তখন সোমালিয়ার উপকূলে নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় নাবিকদের বন্দিদশা।

‘কঠিন সময়, শক্ত থাকতে হবে’

দস্যুদের আচরণ দেখা জাফর ইকবাল বলছেন, “আবদুল্লাহর নাবিকরা এখন কঠিন সময় পার করছে। জিম্মিদশায় সবার মানসিক পরিস্থিতি একই থাকে না। চাপ নেওয়ার ক্ষমতাও সকলের একই না। অনেকেই এ সময় ভেঙে পড়েন। কঠিন সময়ে তাদের শক্ত থাকতে হবে।”

জিম্মিদের মেরে ফেলার কোনো ‘ইচ্ছা’ জলদস্যুদের থাকে না জানিয়ে তিনি বলেন, “জিম্মি নাবিকরাই তাদের মূলধন। তাদের হুমকি দিয়ে, তবে বাঁচিয়ে রেখেই মুক্তিপণের টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াটা অনেকটাই দীর্ঘ হয়।”

জাফর ইকবাল চট্টগ্রামে বেড়ে উঠলেও জন্ম ফেনীতে। জিম্মি হওয়ার সময়ে তিনি অবিবাহিত ছিলেন। আর এখন পরিবার নিয়ে থাকছেন অস্ট্রেলিয়ার পার্থে। ইন্টারটেক অস্ট্রেলিয়া নামে একটি শিপিং প্রতিষ্ঠানের অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন।

অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “শুরুর দিকে তারা খুবই ভয়ভীতি দেখায়, বাড়িতে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে দিত না তেমন। নানাভাবে মানসিক চাপ দিয়ে টাকা আদায়ের জন্য মালিকপক্ষ বা পরিবারের সদস্যদের কথা বলতে বাধ্য করত। কখনো কখনো জিম্মিদের গায়ে হাতও তুলত।

“জলদস্যুরা সবাই সশস্ত্র অবস্থায় জাহাজে থাকত। সেখানে তাদের কথাই আইন। কিন্তু তাদের চিন্তা বা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা মিলত না।” 

এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজে ২০-২৫ দিনের খাবার মজুদ থাকার কথা এক অডিও বার্তায় জানিয়েছিলেন চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান।

খাবারের বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জাফর ইকবাল বলেন, “সেবার আমাদের জাহাজেও খাবারের সংকটও দেখা দিয়েছিল। এরপরে তারা (জলদস্যুরা) কিছু ব্যবস্থা করে। ভাত, আলু বা কখনো মাছ। আবদুল্লাহর ক্ষেত্রে তাই করবে।”

আবদুল্লাহর নাবিকদের পরিবারের সদস্যরা তাদের সাথে আর যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। তাদের মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয়া হয়।

এটি জলদস্যুদের একটা কৌশল উল্লেখ করে জাফর ইকবাল বলেন, “কয়েকদিন যাওয়ার পর আবার কথা বলতে দেবে, কিন্তু কম সময়ের জন্য। নাবিকদের তারা মুক্তিপণ আদায়ের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।”

জার্মান অয়েল ট্যাংকার ‘মারিডা মারগারিটা‘ জাহাজকে ২০১০ সালের ৮ মে গালফ অব এডেন থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২২ নাবিককে জিম্মি করা হয়।

তারা বন্দি থাকার সময়ই জাহান মনিকে জিম্মি করে উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৫ থেকে ২০টির মতো জাহাজ জলদস্যুদের অধীনে ছিল।

যেভাবে মুক্তি

নিজেদের মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জাফর বলেন, জলদস্যুদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মালিকপক্ষের যোগাযোগ হয় দফায় দফায়। মুক্তিপণ নিয়ে দরকষাকষি চলে এবং এক পর্যায়ে তা চূড়ান্ত হয়।

চুক্তি অনুযায়ী সি প্লেনের মাধ্যমে ওপর থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে ডলার ভর্তি থলে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। দস্যুরা তা সংগ্রহ করে যাচাই শেষে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করে দেয়।

আবদুল্লাহর ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ জন্য সময়ের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যোগাযোগ একটা গুরুত্বপূর্ণ। সকল ধরনের আতঙ্ক ও চাপ মাথায় রেখেই নাবিক এবং মালিকপক্ষ সকলকে ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।

Also Read: ১৪ বছর আগে জাহাজসহ অপহৃত নাবিকের মনে ‘অন্য এক ভয়’

Also Read: সোমালিয়া উপকূলে ফের ত্রাসের রাজত্ব

Also Read: ‘সেকেন্ড পার্টির’ মাধ্যমে নাবিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

Also Read: ‘ফোনটা নিয়া যাইবগা আর কথা কওন যাইব না, এইডাই শেষ কথা’

Also Read: ছিনিয়ে নেওয়া ইরানি ট্রলারে করে এসে এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ: টাকা না দিলে ‘একজন একজন করে মেরে ফেলার’ হুমকি দিচ্ছে জলদস্যুরা

Also Read: জলদস্যুর কবলে জাহাজ: এমভি আবদুল্লাহে জিম্মি যারা