সোমালিয়া উপকূলে ফের ত্রাসের রাজত্ব

সমুদ্রের এ পথজুড়ে গত তিন মাসে আগের ছয় বছরের চেয়ে অনেক বেশি দুস্যুতার ঘটনা ঘটেছে।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2024, 07:43 PM
Updated : 13 March 2024, 07:43 PM

বছর ছয়েক শান্ত থাকার পর হর্ন অব আফ্রিকাজুড়ে ফের আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সোমালি জলদস্যুরা; যার শিকার হয়েছে এবার বাংলাদেশি এক জাহাজ, জিম্মি করা হয়েছে নাবিকদের।

ভারত মহাসাগরের পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে গত কয়েক মাসে পণ্যবাহী জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণের ঘটনা দ্রুত বেড়েছে। এসব ঘটনা বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিক, জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানি এবং সরকারগুলোর মাথাব্যাথার বড় কারণ হয়ে উঠেছে।

সোমালি জলদস্যুদের সবশেষ শিকার বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। কয়লাবাহী ওই জাহাজের ২৩ নাবিক এখন তাদের হাতে জিম্মি।

জাহাজ কোম্পানির পাশাপাশি সরকারের তরফ থেকে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এখনও তাদের সাড়া মেলেনি। ফলে দেশে উৎকণ্ঠার প্রহর গুণছে পরিবারগুলো।

সবশেষ খবরের তথ্য বলছে, জিম্মি নাবিকদেরসহ জাহাজটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সোমালি উপকূলের দিকে।

ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথ?

গাজা যুদ্ধের মধ্যে গত নভেম্বর থেকে লোহিত সাগরে পণ্যবাহী জাহাজে হামলা শুরু করে হুতিরা। এরপর ওই পথ এড়িয়ে সমুদ্রের ভিন্ন পথে জাহাজ পরিচালনা করছে শিপিং কোম্পানিগুলো।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর ১৯ নভেম্বর হুতি আক্রমণ শুরু হওয়ার পর গত তিন মাসে দুই হাজারের বেশি জাহাজ লোহিত সাগরের পরিবর্তে অন্য পথ্য ব্যবহার করেছে।

জলদস্যুরা সাম্প্রতিক সময়ে এ‌ সুযোগই নিয়েছে হর্ন অব আফ্রিকাজুড়ে। রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই) এর বরাতে মার্কিন বাণিজ্য সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি বলছে, এ পথজুড়ে গত তিন মাসে আগের ছয় বছরের চেয়েও অনেক বেশি দুস্যুতার ঘটনা ঘটেছে।

আফ্রিকার দেশ সোমালিয়ার পূর্বে ভারত মহাসাগর। উত্তরে সোমালিয়া, জিবুতি ও ইথিওপিয়ার সীমান্ত এডেন উপসাগরের তীরের যে শিং আকৃতির ভূখণ্ড ঘেঁষা; সেই অংশটির নাম ‘হর্ন অব আফ্রিকা’।

সোমালিয়ার সীমান্তজুড়ে তাই বিশাল সমুদ্র সীমা। এডেন উপসাগরের কূলের ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ খ্যাত অংশের বিপরীত পাশেই ইয়েমেনের অবস্থান।

ভৌগলিক অবস্থান এবং এডেন উপসাগর হয়ে আরও উত্তরের লোহিত সাগরের বর্তমান পরিস্থিতিতে জাহাজের সংখ্যা বাড়ায় তা এতদিন নিস্ক্রিয় সোমালি জলদস্যুদের আবার দস্যুতায় টেনে আনছে বলে মনে করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এ খাতের বিশ্লেষকরা।

২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা ছিল ব্যাপক। এরপর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, জোট ও দেশের নিরাপত্তা বাহিনী জোট বেধে বা এককভাবে জলদস্যুদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হলে তা কমতে শুরু করে। সবশেষ ২০১৭ সালের পর একেবারেই কমে গিয়েছিল তাদের তৎপরতা।

তবে ২০২৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর সোমালিয়ার বোসাসো শহর থেকে প্রায় ৭০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে একটি বাল্ক ক্যারিয়ার (পণ্যবাহী জাহাজ) ছিনিয়ে নিয়ে আবার স্বরূপে আর্বিভূত হয় জলদস্যুরা। এরপর জাহাজ ছিনিয়ে নেয়ার আরও একাধিক ঘটনা ঘটেছে।

সবশেষ ১২ মার্চ বাংলাদেশের শিল্পগোষ্ঠী কেএসআরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এস আর শিপিং লাইনের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ দখল করে ২৩ নাবিককে জিম্মি করে সোমালি জলদস্যুদের একটি দল।

আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে সেটি দস্যুদের কবলে পড়ে।

এর আগেও সোমালি জলদস্যুদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশি এক জাহাজ। সেবার অবশ্য আরব সাগরে ঘটেছিল সেই ঘটনা। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশি জাহাজ ‘জাহান মণি’ আটকে নাবিকদের জিম্মি করা হয়। নিকেল ভরতি ওই জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে করা হয়েছিল জিম্মি ।

নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের মাথায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা। পরে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

১৪ বছর আগে একইভাবে জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাহান মণির মত এমভি আবদুল্লাহও বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ।

এমভি আবদুল্লাহ কোথায়?

ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এমভি আবদুল্লাহ এবং জিম্মি ২৩ নাবিককে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এসআর শিপিংয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর জলদস্যুরা সেটিকে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

বুধবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬ টা ৪০ মিনিটে জাহাজটি সোমালিয়ান উপকূল থেকে ১৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল বলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন তথ্য দেন।

জিম্মি জাহাজ এবং নাবিকদের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এস আর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মেহেরুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জিম্মিকারীদের পক্ষ থেকে কেউ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

“এমভি আবদুল্লাহ এখনও স্টপ হয়নি। এটিকে উপকূলের দিকে নেওয়া হচ্ছে বলে ধারণা করছি।“

যোগাযোগ নেই ২৪ ঘন্টারও বেশি

জাহাজের মালিকপক্ষ গত ২৪ ঘন্টায় সেখানকার নাবিকদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেননি। সোমালি জলদস্যুরাও জাহাজের বাংলাদেশি মালিকের প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

এস আর শিপিংয়ের সিইও ক্যাপ্টেন মেহেরুল বলেন, বলা যায় গত ২৪ ঘণ্টায় জাহাজের কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। মঙ্গলবার মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিল।

Also Read: এমভি আবদুল্লাহকে সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দস্যুরা

Also Read: ‘সেকেন্ড পার্টির’ মাধ্যমে নাবিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

Also Read: ‘ফোনটা নিয়া যাইবগা আর কথা কওন যাইব না, এইডাই শেষ কথা’

Also Read: মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে আকুল ছিলেন ডেক ক্যাডেট সাব্বির

জিম্মি মুক্তির ক্ষেত্রে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জলদস্যুদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা এবং মুক্তির বিভিন্ন শর্ত নির্ধারণ করে মুক্তিপণের বিষয়টির সুরাহা করা।

এ বিষয়ে কথাবার্তা শুরু না হওয়ায় এবং গত ২৪ ঘণ্টায় যোগাযোগ না হওয়ায় জিম্মি নাবিকদের স্বজনরা উৎকণ্ঠিত।

তারা জিম্মিদের মুক্তির প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করতে এমভি আবদুল্লাহ এর মালিক কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং এবং প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করেছেন।

এস আর শিপিংয়ের পক্ষে বলা হচ্ছে, তারা জলদস্যুদের কাছ থেকে যোগাযোগের অপেক্ষায় আছেন।

এর আগে মঙ্গলবার জিম্মিদশা অবস্থাতেই জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানসহ বিভিন্ন নাবিক তাদের পরিবারের সদস্য এবং মালিকপক্ষকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে খুদে বার্তা এবং ভয়েস মেইল পাঠায়। মুক্তিপণ না দিলে নাবিকদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে জলদস্যুরা বলে বার্তায় বলেন নাবিকরা।

সোমালি জলদস্যুতার শুরু কখন

গত ফেব্রুয়ারিতে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এক দশকেরও কিছু সময় পর সম্প্রতি আগের মত সোমালিয়া উপকূলে আবারও জলদস্যুতা বেড়েছে। তবে মাঝে কয়েক বছর এ প্রবণতা বন্ধ ছিল।  

স্পেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাতে রয়টার্স ১৯ ডিসেম্বর সোমালিয়া উপকূলের অদূরে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর দেয়। আবার ৩০ জানুয়ারি ভারতীয় নৌবাহিনী একই দিনে সোমালি জলদস্যুদের কবল থেকে দুটি মাছ ধরার ট্রলার উদ্ধার করে।

এসব ঘটনা দীর্ঘদিন পর আবার সোমালি দস্যুদের সদলবলে ফিরে আসার কথা জানান দিচ্ছে।

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ: ‘বাবা দোয়া করো, কী হবে জানি না'

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ: উৎকণ্ঠায় তারেকুলের পরিবার, থামছে না মায়ের কান্না

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ: উৎকণ্ঠায় নাবিকদের স্বজনরা

Also Read: ছিনিয়ে নেওয়া ইরানি ট্রলারে করে এসে এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি

১৯৯১ সালে বিবদমান সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে সোমালিয়ার সামরিক একনায়কের পতন হলে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। এর পরের প্রায় দুই দশক নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সক্রিয়তা ও অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে বিপর্যস্ত ছিল সোমালিয়া। এ সুযোগে জলদস্যুতাও বাড়তে থাকে।

সেসময় বিশাল জলসীমার নিয়ন্ত্রণে দেশটির কোনো কার্যকর নিরাপত্তা বাহিনী ছিল না। তখন ওই অঞ্চলে বিদেশি মাছ ধরার জাহাজের উপস্থিতি বাড়তে থাকে।

বিবিসি’র ওই প্রতিবেদন অনুসারে, তখন সেখানকার সাগরে বিদেশি ট্রলারের অবৈধ মাছ শিকারের কারণে সোমালিয়া উপকূলের কিছু জেলে তাদের পেশা হারিয়ে জলদস্যুতে পরিণত হয়েছিল।

পূর্ব আফ্রিকান উপকূলের দেশগুলোর একটি সংগঠন ইন্ডিয়ান ওশান কমিশন (আইওসি) বলছে, বর্তমানে সোমালিয়ার মৎস্য নীতি বিদেশি মাছ ধরার জাহাজের সংখ্যা আবার বাড়াচ্ছে, যা আবার উপকূলীয় সোমালিদের জলদস্যুতায় ঠেলে দিতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকা হিসেবে পরিচিত সোমালিয়া উপকূল ঘেঁষা এ সমুদ্রপথ বিশ্ব বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পথগুলোর একটি। ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই এ পথে বছরজুড়েই পণ্যবাহী জাহাজ চলে। এর মধ্যে লোহিত সাগরে হুতিদের আক্রমণে এ পথে আরও বেশি জাহাজ চলাচল শুরু হয়। এখন জলদস্যুদের ফিরে আসায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

আবারও বাড়ছে

ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স অপারেশন আটলান্টা এর তথ্য অনুসারে, সোমালিয়া উপকূলে ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে এডেন উপসাগর ও সোমালি সমুদ্র এলাকায় ১৯টি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়েছে।

মার্কিন বাণিজ্য বিষয়ক সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি এক প্রতিবেদনে রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই) এর বরাতে সাম্প্রতিক সময়ে সোমালি জলদস্যুদের জোরালোভাবে ফিরে আসার তথ্য দিচ্ছে।

বাণিজ্যের এ পথকে সোমালি জলদস্যুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে ২০১১ সালে। ওই বছর সর্বোচ্চ ২১২টি আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এরপর বিভিন্ন দেশ ও জোটের নিরাপত্তা বাহিনী তৎপর হলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কমতে শুরু করেছিল।

ওই বছরগুলোতে ঘটনা এত বেড়েছিল যে সোমালিয়ার জলদস্যুতা প্রতিরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (ইউএনএসসি) ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সাল মার্চ পর্যন্ত সাতটি রেজল্যুশন পাস করে। যাতে বিভিন্ন দেশের নৌ ও বিমান বাহিনীকে সোমালি জলসীমায় প্রবেশ ও টহল দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়

পাশাপাশি ওই অঞ্চলে সমুদ্রে জলদস্যুতা এবং সশস্ত্র ডাকাতি দমনে সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স অপারেশন আটলান্টাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্সের সঙ্গে কাজ করার অনুমোদন দেওয়া হয়।

২০২২ সালের মার্চ মাসে জলদস্যুতা বিরোধী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ম্যান্ডেটের মেয়াদ শেষ হয়।

Also Read: জিম্মি হওয়ার আগে এমভি আবদুল্লাহ থেকে দুই নাবিকের বার্তা

Also Read: এমভি আবদুল্লাহ: টাকা না দিলে ‘একজন একজন করে মেরে ফেলার’ হুমকি দিচ্ছে জলদস্যুরা

Also Read: ছিনিয়ে নেওয়া ইরানি ট্রলারে করে এসে এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি

আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো (আইএমবি) এর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে সমুদ্রে জলদস্যুতা ও সশস্ত্র ডাকাতির ঘটনা ঘটে ১২০টি, যা ২০২২ সালে ছিল ১১৫টি। এ বছর জিম্মি নাবিকের সংখ্যা ছিল ৭৩ জন, আগের বছর ২০২২ সালে তা ছিল ৪১ জন।

আন্তর্জাতিক নানামুখী পদক্ষেপের পরও সোমালি জলদস্যুদের একেবারে থামানো যায়নি। জলদস্যুতার অভিযোগে ২০০৫ সালের পর থেকে ১ হাজার ৩০০ জন বিদেশের কারাগারে আটক আছে। এদের বেশির ভাগ দোষী প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে বলে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে ২০১৫ সালে আল জাজিরা জানায়, ২১ দেশের কারাগারে তারা দণ্ড খাটছে।

শিপিং বিষয়ক সংবাদ প্রকাশকারী ট্রেডউন্ডস এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের মার্চ মাসে জলদস্যুতা বিরোধী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ম্যান্ডেটের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছিলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলদস্যুতা বিরোধী পদক্ষেপগুলি কমে যাচ্ছে এবং তাতে আরও আক্রমণের দরজা খুলেছে।

লোহিত সাগরে হুতিদের আক্রমণ থামাতে আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো বেশি ব্যস্ত থাকার সুযোগে ভারত মহাসাগর এবং এডেন উপসাগরে সোমালি জলদস্যুরা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

কাড়িকাড়ি অর্থ

সোমালি জলদস্যুতা সবচেয়ে বেশি ঘটে ২০১১ সালে। এর পরের থেকে তাদের দমনে আন্তর্জাতিক তৎপরতা বাড়ার আগে বছরে বিশ্ব বাণিজ্যের ৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে।

২০১৩ সালের নভেম্বরে বিশ্ব ব্যাংক, ইউনাইটেড নেশান অপারেশান অ্যান্ড ক্রাইসিস সেন্টার (ইউএনওসিসি) এবং ইন্টারপোল এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০০৫-২০১২ সালের মধ্যে সোমালিয়া এবং হর্ন অব আফ্রিকার উপকূলে জাহাজ ছিনতাই থেকে প্রায় ৩৩৯ মিলিয়ন থেকে ৪১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমানের মুক্তিপণ আদায় হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে সাবেক জলদস্যু, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংকার এবং জলদস্যুতা প্রতিরোধে জড়িত অন্যান্যদের সঙ্গে সাক্ষাত্কারের তথ্য ব্যবহার করা হয়। এসব মুক্তিপণের অর্থের বেশির ভাগই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে বিশ্ব ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

Also Read: জাহান মণি থেকে আবদুল্লাহ: ২৩ নাবিকের মুক্তি মিলবে কীভাবে

Also Read: জলদস্যুর কবলে জাহাজ: এমভি আবদুল্লাহে জিম্মি যারা

২০১০ সালে বাংলাদেশের পতাকাবাহী কেএসআরএম গ্রুপের জাহাজ ‘জাহান মনি’ সোমালীয় জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল সেটি প্রায় ১০০ দিন পর মুক্তি পায়।

তখন মুক্তিপণের বিষয়টি প্রকাশ্যে উল্লেখ করা না হলেও লেনদেনের ভিত্তিতেই নাবিক ও জাহাজটি মুক্ত হয়েছিল। সেসময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে প্রায় সাড়ে ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তখন জাহাজটি মুক্ত করা হয়েছিল দুস্যুদের কবল থেকে।

প্রয়োজন নিরাপত্তা

শিপিং বিষয়ক সংবাদ প্রকাশকারী ট্রেডউন্ডস এর প্রতিবেদনে শিপিং সেইফটি অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভাইজরি গ্রুপ সেফ সিসের ডিরেক্টর কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান বুয়েগার বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জলদস্যুতা বিরোধী পদক্ষেপগুলি কমে যাচ্ছে, যা আরও আক্রমণের দরজা খুলেছে।“

শুধু ভারতীয় নৌবাহিনী এই অঞ্চলে জলদস্যুতা বিরোধী অভিযান সক্রিয় রেখেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। আর সম্মিলিত আন্তর্জাতিক জলদস্যুতা বিরোধী টাস্ক ফোর্স ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্স এর কাছে বর্তমানে শুধু একটি জাহাজ আছে।

চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আইএনএস সুমিত্রা অভিযান চালিয়ে ৩৬ জন ক্রুসহ দুটি ইরানি ফিশিং বোট সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করে।

অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান বুয়েগার সোমালীয় জলদস্যুতা মোকাবেলায় ভারতীয় নৌবাহিনীকে সহায়তা করতে চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর শক্তিশালী নৌ উপস্থিতির বাড়ানোর পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন প্রয়োজন। তাদের দ্রুত সাড়া দেওয়া জলদস্যুতা কমাতে পারে।