“জাহাজ পুরোপুরি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জলদস্যুরা ক্রুদের জাহাজের কেবিনে রেখেছে।”
Published : 13 Mar 2024, 12:29 AM
ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ থেকে দুজন নাবিক ও ক্রু ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজেদের অবস্থা জানিয়েছেন।
জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান এবং ক্রু মো. আসিফুর রহমান তাদের বার্তায় বলেছেন, জলদস্যুরা তাদের জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিলেও তারা সবাই সুস্থ আছেন। তাদের জন্য প্রার্থনা করতে অনুরোধ করেছেন সবাইকে।
কে এস আরএম গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি নৌপথে পণ্য পরিবহন করে। আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে সেটি জলদস্যুর কবলে পড়ে।
এসআর শিপিংয়ের সিইও মোহাম্মদ মেহেরুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে জাহাজ থেকে তাদের বার্তা পাঠানো হয়।
“জাহাজ পুরোপুরি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সেখানে আমাদের ২৩ জন নাবিক ও ক্রু আছেন। তাদের জিম্মি করেছে জলদস্যুরা। তাদের জাহাজের কেবিনে রেখেছে। আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।”
জাহাজে থাকা নাবিক ও ক্রুরা হলেন জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিনি ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিসিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ, ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্ম শ্মসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
জাহাজের ক্রু মো. আসিফুর রহমান তার বার্তার সঙ্গে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। জলদস্যুরা যখন ছোট ছোট বোটে করে এসে জাহাজের দখল নেয় সেই মুহূর্তের দৃশ্য ধরা পড়েছে সেখানে। কালো পোশাক পরা সশস্ত্র এক জলদস্যুকে জাহাজের রেলিং বেয়ে উপরে উঠে আসতে দেখা যায় ওই সংক্ষিপ্ত ভিডিওতে।
একটি মার্চেন্ট শিপের ক্যাপ্টেন আতিক ইউএ খান এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, তিনি ইনবক্সে কিছু মেসেজ পেয়েছেন, যেখানে বলা হচ্ছে আনুমানিক ৫০ জন সশস্ত্র জলদস্যু ওই জাহাজে অবস্থান করছে। জাহাজটি সোমালিয়ার আশপাশে আছে। জিম্মিদের মধ্যে সাতজন বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির সাবেক ক্যাডেট।
চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খানের মা শাহনূর বেগমের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর। সেখানে তিনি বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যখন তারা ইফতার করছিলেন, তখন ফোন করেন আতিক।
“বলতেছে চিন্তা না করতে, এখন, ওরা নাকি বন্দুক নিয়ে চারিদিকে পাহারা দিচ্ছে। শিপের ভিতর ওদের বসায় রাখছে কেবিনে।”
ওই আলাপের মিনিট দশেক পর আবারও ফোন করেন আতিক। সেই কথোপকথনের বিবরণ দিয়ে তার মা বলেন, “আমাদের আবার ১০ মিনিট পরে ফোন করছে। নিয়ে যাচ্ছে, মানে সবার মোবাইল নিয়ে ফেলতেছে। সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে। ‘আমাদের সোমালিয়া নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে আরেকদিন সময় লাগবে সোমালিয়া পৌঁছতে।’ সবাই দোয়া করতে বলতেছে।”
শাহনূর বেগম বলেন, “বলছে যে ওদের নাকি কোনো ক্ষতি করে নাই। এমনে সব কিছু নিয়ে ফেলছে আরকি। ডলার টলার যা ছিল, পুরা জাহাজ নিয়ে ফেলছে। মোবাইলটা ছিল, মোবাইলটাও নিয়ে ফেলছে। শুধু কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারছে।”
আতিকের মা জানান, তিনি অসুস্থ। তার ছেলের ছোট ছোট তিনটা মেয়ে। ছেলের বউ অন্তঃসত্ত্বা। আতিকের খবর পাওয়ার পর তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
“কিছুক্ষণ পরপর হুঁশ হারায়ে ফেলতেছে। শুধু কান্না করতেছে আর প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। এখন ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আর বাচ্চারা তো আমাকে জড়ায়ে ধরে ৫ মিনিট পরে এসে এসে কান্না করে। ‘আমার বাবা কোথায়, আমার বাবার কী হইছে। ওরা বুঝতে পারতেছে না। সবাই কান্নাকাটি করতেছে। এখন আমার পুরা পরিবারে কান্নার রোল পড়ে গেছে।”
শাহনূর বেগম বলেন, বিভিন্ন সময়ে জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণের খবর তিনি টিভিতে দেখেছেন, পত্রিকায় পড়েছেন। এর আগে আরেক বাংলাদেশি জাহাজ জলদস্যুর কবলে পড়েছিল ২০১০ সালে, সে কথাও শুনেছেন। কিন্তু নিজেদের পরিবার এরকম বিপদে পড়বে, সেটা কখনও কল্পনাও করেননি।
“এখন আমরা চাই যে আমাদের ছেলে সহি সুস্থভাবে যেন আমাদের কাছে ফেরত আসে। আমরা আর কিছু চাই না। আমাদের মাঝে ফেরত চাই আমাদের ছেলেকে। দেশবাসী দোয়া করবেন, সবাই আমার ছেলের জন্য।”
এর আগে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মণি। নিকেলভর্তি ওই জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের মাথায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা। পরে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
জাহান মণির মালিক প্রতিষ্ঠান ছিল চট্টগ্রামের ব্রেভরয়েল শিপিং ম্যানেজম্যান্ট লিমিটেডও কে এস আরএম গ্রুপের একটি সহযোগী কোম্পানি। মেহেরুল করিম তখন ব্রেভরয়েল শিপিং এর মহাব্যবস্থাপক ছিলেন।
সে সময় তিনি স্যাটেলাইট ফোনে দস্যুদের সঙ্গে দীর্ঘ দর ‘কষাকষির’ পর নাবিকদের মুক্তির বিষয়ে জলদস্যুদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ‘লিখিত চুক্তি’ করার কথা বলেছিলেন।
তবে তখনকার নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, "মুক্তিপণ দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। সর্বপ্রকার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জাহাজ ও এর নাবিকরা মুক্ত হয়েছে।"
পুরনো খবর