১৩ বছর আগে ওই ঘটনায় সোমালি জলদস্যুরা ‘এমভি জাহান মণি’র ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করে। নানাভাবে দেনদরবার ও দরকষাকষি শেষে দস্যুদের সঙ্গে সমঝোতায় ১০০দিন পর মুক্তি মিলেছিল তাদের।
Published : 13 Mar 2024, 10:22 AM
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ ভারত মহাসাগরে সোমলি জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর ফিরে আসছে ‘এমভি জাহান মণি’র স্মৃতি।
১৩ বছর আগে ওই ঘটনায় সোমালি জলদস্যুরা ‘এমভি জাহান মণি’র ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করে। নানাভাবে দেনদরবার ও দরকষাকষি শেষে দস্যুদের সঙ্গে সমঝোতায় ১০০দিন পর মুক্তি মিলেছিল তাদের।
এবার জলদস্যুর কবলে পড়া ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ২৩ নাবিককে মুক্ত করার চেষ্টার ক্ষেত্রে জাহান মণির অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে বলে মনে করছে মালিকপক্ষ।
সোমলি জলদস্যুরা মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে ভারত মহাসাগরে ‘এমভি আবদুল্লাহ’ নামের ওই কয়লাবাহী জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ২৩ নাবিককে জিম্মি করে। এমভি জাহান মণি’র মত এমভি আবদুল্লাহও বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজ।
ওই সময়ে কবির গ্রুপের ব্রেভরয়েল শিপিংয়ের মহাব্যবস্থাপক ক্যাপ্টেন মেহেরুল করিম ‘জাহান মণি’ জাহাজের নাবিকদের উদ্ধারের জন্য জলদস্যুসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা চালিয়েছিলেন। সফল দরকষাকষির পর তিনি সেসময়ে ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মেহেরুল করিম এখন ‘এমভি আবদুল্লাহ’র মালিক প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনিই জিম্মি জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে প্রথম কথা বলেন। নাবিকদের মুক্ত করার কাজটি এবারও তিনিই দেখছেন।
জিম্মি মুক্তির ক্ষেত্রে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জলদস্যুদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা এবং মুক্তির বিভিন্ন শর্ত নির্ধারণ করে মুক্তিপণের বিষয়টির সুরাহা করা।
২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর জাহান মণির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জলদস্যুরা সেটিকে ছয়দিন পর সোমালিয়ার উপকূলীয় এলাকা গারাকোডের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
স্মার্টফোন বা ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন যোগাযোগ যতটা সহজ, তখন এতটা ছিল না। জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সাত দিনের মাথায় জলদস্যুরা স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে মালিক পক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়।
ধারাবাহিক আলোচনার পর ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দরকষাকষি শেষ হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি জিম্মি মুক্তির বিষয়ে লিখিত চুক্তি হয় জলদস্যু প্রতিনিধির সঙ্গে।
চুক্তির ১৪ দিনের মাথায় জলদস্যুরা ২৫ নাবিককে জাহাজসহ ছেড়ে দিলে ২১ মার্চ ওমান হয়ে দেশে ফেরেন তারা।
তবে মুক্তিপণের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ওই সময় দেশি বিদেশি বিভিন্ন সংস্থাও জাহাজ কোম্পানিকে নানাভাবে সহযোগিতা করে। তবে তার বেশিরভাগ তথ্য গোপন রাখা হয়।
নাবিকদের উদ্ধারের জন্য সেসময় জলদস্যু প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ও চুক্তির ক্ষেত্রে তৃতীয় একটি পক্ষের সহযোগিতা নিতে হয়েছিল। সে বিষয়েও কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এবারে নাবিকদের মুক্তির বিষয়টি কীভাবে হতে পারে জানতে চাওয়া হয়েছিল ক্যাপ্টেন মেহেরুল করিমের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “এখনো মাত্র তাদের জিম্মি করেছে। ক্যাপ্টেনের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়েছে, তারা সুস্থ আছেন। আগে সোমালি দস্যুরা যোগাযোগ করুক, তারপর বোঝা যাবে।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “জিম্মি মুক্তির ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় আছে। আগেরবার ১০০ দিনের মধ্যে জলদস্যুদের সাথে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ অনেক বিষয়ে কথা হয়েছে। তারপর ফল এসেছে।
“পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে এবারও বিভিন্নভাবে কথা বলতে হবে। আর শেষ পর্যন্ত কীভাবে কাজটা করা হবে, সেটাও আমাদের বের করতে হবে। এখনো মাত্র ক্যাপচার করেছে।অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো ওপেন হলে জিম্মিদের সমস্যা হতে পারে। সে কারণে সতর্কতার সাথে আমাদের এগোতে হবে।”
এমভি আবদুল্লাহয় পর্যাপ্ত খাবার, পানি এবং জ্বালানি আছে জানিয়ে মেহেরুল করিম বলেন, “জাহাজটি উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জেনেছি। নাবিকরা সবাই সুস্থ আছেন।”
মোজাম্বিকের মাপুতু বন্দর থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে ভারত মহাসাগর হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছিল বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। সোমালীয় উপকূল থেকে ৪০০ নটিক্যাল মাইল দূরে হাইস্পিড বোটে করে ১৫ থেকে ২০ জন সশস্ত্র জলদস্যু এসে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নাবিকদের জিম্মি করে।
এস আর শিপিংয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যে ২৩ জন নাবিক জিম্মি হয়েছেন, মাস দুয়েক আগে ওই জাহাজে উঠেছিলেন তারা।
কবির গ্রুপের মিডিয়ার দায়িত্বে থাকা মিজানুল ইসলাম বলেন, “জলদস্যুরা জিম্মি নাবিকদের ওপর কোনো হামলা করেনি। তারা ভালো আছেন। তাদের জাহাজের কেবিনে রাখা হয়েছে। জলদস্যুরা এখনো আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি।বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের (দস্যুদের) সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।”
জাহাজের ক্রু মো. আসিফুর রহমান এই ভিডিও ফেইসবুকে পোস্ট করেছেন। জলদস্যুদের জাহাজের ওঠার মুহূর্ত ধরা পড়েছে ভিডিওতে।
নাবিকদের দোয়া প্রার্থনা
সোমালি জলদস্যুর কবলে পড়া ‘এমভি আবদুল্লাহ‘র চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান জিম্মি হওয়ার আগে হোয়াটসআপের মাধ্যমে মালিকপক্ষের কাছে বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি নিজেদের জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন এবং পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা জানানোর জন্য অনুরোধ করেন।
স্থানীয় সময় (সোমালীয়) সকাল সাড়ে ১০টা এবং গ্রিনিচ মিন টাইম সাড়ে ৭টার দিকে একটি হাই স্পিড বোটে করে সোমালি জলদস্যরা জাহাজে উঠে আসে বলে ওই বার্তায় জানান আতিক উল্লাহ খান।
তিনি বলেন, “পাইরেটসরা জাহাজে উঠে আসার পর জাহাজের ক্যাপ্টেন ও সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে। এরা সংখ্যায় ১৫-২০ জন ছিল। হাই স্পিড বোটের পর আরেকটি ফিশিং ট্রলারে করে অন্যরাও আসে। ইরানিয়ান ট্রলারটি একমাস আগে তারা ক্যাপচার করে। এটি তারা ছেড়ে দেবে, সেখানে জ্বালানি নাই। তাদের জন্য আবদুল্লাহ থেকে জ্বালানি দেওয়া হবে।”
আতিক উল্লাহ খান জানান, জাহাজে ৫৫ হাজার টন কয়লা আর ২০০ টন খাবার পানি আছে।সবাই ভয়ে থাকলেও নাবিকদের কোনো ক্ষতি হয়নি।
আক্রান্ত হওয়ার পর জাহাজের আরেক নাবিক আসিফুর রহমান ফেইসবুকে লেখেন, “আমরা সোমালি জলদস্যুর কবলে পড়েছি। আলহামদুলিল্লাহ আমরা সুস্থ ও নিরাপদে আছি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
জিম্মি যারা
জাহাজে থাকা নাবিক ও ক্রুরা হলেন– জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিসিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ, ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুর উদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।