“ইরানি ওই ফিশিং বোট আমাদের জাহাজের সাথে বাঁধা আছে। ওই ফিশিং বোট থেকেই মূলত ওরা আমাদেরকে অ্যাটাক করছে।”
Published : 13 Mar 2024, 11:57 AM
মাসখানেক আগে একটি ইরানি মাছ ধরা ট্রলার ছিনতাইয়ের পর ভারত মহাসাগরে নতুন জাহাজের খোঁজ করছিল সোমালি জলদস্যুরা; সেই দস্যুদেরই কবলে পড়েছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ।
জাহাজটির চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান মালিকপক্ষের কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় বলেছেন, “এখন ওই ইরানিয়ান ফিশিং বোটকে ওরা রিলিজ করে দেবে। সেটির ফুয়েল শেষ হয়ে গেছে। আমাদের থেকে ওরা ডিজেল নিচ্ছে।”
এমভি আবদুল্লাহর এক ক্রু আরেক অডিও বার্তায় বলেছেন, “ইরানি ওই ফিশিং বোট আমাদের জাহাজের সাথে বাঁধা আছে। ওই ফিশিং বোট থেকেই মূলত ওরা আমাদেরকে অ্যাটাক করছে।”
মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ নাবিককে জিম্মি করে জলদস্যুরা। কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি নৌপথে পণ্য পরিবহন করে। আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে সেটি দস্যুদের কবলে পড়ে।
পরে এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান জাহাজের মালিকপক্ষকে পাঠানো এক অডিও বার্তায় দস্যুদের আক্রমণের ঘটনার বর্ণনা দেন।
অডিও বার্তায় আতিক বলেন, “আমি চিফ অফিসার বলছি, আবদুল্লাহ জাহাজ থেকে। আজকে (মঙ্গলবার) সকালে জাহাজের সময় আনুমানিক সাড়ে ১০টা এবং জিএমটি (গ্রিনিচি মান সময়) সময় ৭টা ৩০ এর সময় একটা হাইস্পিড স্পিড বোট আমাদের দিকে আসতেছিল। সাথে সাথে অ্যালার্ম দিছিল। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ওখান থেকে পরে সিটি টেলে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর সেকেন্ডার অফিসার ব্রিজে ছিল।
“তখন ওই জিগজ্যাগ করলাম। এসওএস (বিপদে পড়লে জীবন রক্ষায় জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকেএমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনস) ট্রাই করছিলাম। বাট ইউকেএমটিও তখন ফোন রিসিভ করেনি। ওরা চলে আসল, পাইরেটসগুলা। চলে আসার পরে ক্যাপ্টেন স্যার আর সেকেন্ড অফিসারকে ক্যাপচার করল।”
ফাঁকা গুলি ছোড়ে দস্যুরা
এমভি আবদুল্লাহ দস্যু কবলে পড়ার যে ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দেখা যায়, কাঁধে বন্ধুক নিয়ে এক জলদস্যু জাহাজের রেলিং বেয়ে উঠছে।
জাহাজে ওঠার পরই নাবিকদের সবাইকে জাহাজের ব্রিজে জড়ো করে সেখানে ফাঁকা গুলি করে জলদস্যুরা।
আতিক উল্লাহ খান অডিও বার্তায় বলেন, “আমাদেরকে ডাকল। আমরা সবাই আসলাম। ওরা কিছু কিছু গোলাগুলি করল। আমরা সবাই ভয় পাইছিলাম। সবাই ব্রিজে বসেছিল। এমনি কারো গায়ে হাত তোলেনি। সেকেন্ড অফিসারকে হালকা একটু ইয়ে করছে।
“তারপরে ওরা আরেকটা স্পিডবোট করে আরো কয়েকজন লোক চলে আসল। এভাবে প্রায় ১৫-২০ জন চলে আসছে। কতক্ষণ পর একটা বড় ফিশিং ভেসেল (মাছ ধরার নৌযান) আসল। ওটা হচ্ছে একটা ইরানিয়ান ফিশিং বোট, যেটা নাকি ওরা এক মাস আগে ক্যাপচার করছিল এই সোমালি পাইরেটসগুলা।”
ইরানি ওই জাহাজ নিয়ে সাগরে ঘুরে ঘুরে দস্যুরা নতুন জাহাজ খুঁজছিল বলে জানান আতিক।
“ওরা ওইটাতে ছিল। ওইটাতে ঘুরে ওরা এক মাস ধরে সার্চিং করতেছিল। কোনো জাহাজ খুঁজতেছিল। তো আনফরচুনেটলি আমাদের জাহাজে ওরা আসল। এখন ওই ইরানিয়ান ফিশিং বোটকে ওরা রিলিজ করে দিবে। ওই ফিশিং বোটে ফুয়েল শেষ হয়ে গেছে। আমাদের থেকে ওরা ডিজেল নিচ্ছে। ওয়েলডেন পাম্প দিয়ে দিচ্ছি আরকি। কারণ ওদের কোনো সিস্টেম নেই নেওয়ার।”
দস্যুদের জাহাজ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরের পরিস্থিতি জানিয়ে তিনি বলেন, “তো তারপর ওরা জাহাজ স্টপ করাল। সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার আর থার্ড ইঞ্জিনিয়ার ইঞ্জিন রুমে গেল। গিয়ে সিস্টেমেটিক্যালি স্টপ করছে। জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি এখনো আল্লাহর রহমতে হয়নি। আমাদেরও তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। বাট ভয়ে আছে আরকি সবাই একটু ভয় পাচ্ছে। ভয় দেখাচ্ছে।”
এমভি আব্দুল্লাহয় থাকা একজন ক্রু বিদেশি জাহাজে কর্মরত আরেক বাংলাদেশি নাবিককে কয়েকটি ছোট অডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। এমভি আবদুল্লাহর ওই ক্রু আসলে কে, সেটি জানা যায়নি।
অডিওতে তিনি বলেন, জলদস্যুরা যে ইরানি ফিশিং বোটে করে এসেছে, সেটি জাহাজের সঙ্গে বাঁধা আছে।
“ওই ইরানি ফিশিং বোটটাকে এখন ওরা ছেড়ে দেবে। এটারে ওরা দুই মাস ধরে আটক করে রাখছিল। এটারে আমরা ডিজেল অয়েল দিলাম। ডিজেল দেওয়া শেষ হলে ওটা ছেড়ে দিবে। তারপর আমাদের নিয়ে হয়ত সোমালিয়ান কোস্টে ওদের আস্তানায় চলে যাবে আরকি।”
‘খাবার আছে ২০-২৫ দিনের’
এমভি আব্দুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ অডিও বার্তায় বলেন, “আমাদের জাহাজে ২০-২৫ দিনের প্রভিশন আছে অ্যাপ্রক্সিমেটলি। আর হল ২০০ মেট্রিক টন ফ্রেশ ওয়াটার আছে। আমরা অলরেডি সবাইকে বলছি ফ্রেশ ওয়াটার সেইফলি ইউজ করতে। আর প্রভিশনও আমরা সেভাবে হ্যান্ডেল করব।
“একটা প্রবলেম হচ্ছে আমাদের জাহাজে কোল কার্গো আছে অ্যাবাউট ৫৫ হাজার, যা ডেঞ্জারাস। ওটার ফায়ার হ্যাজার্ড (অগ্নি ঝুঁকি) আছে। তারপরে মিথেন কনসেনট্রেনশনও বাড়ে। লাস্ট অক্সিজেন লেভেল ৯-১০ পারসেন্ট এরকম ছিল। এটা একটু রেগুলার মনিটর করতে হয়। আবার বেড়ে গেলে বিভিন্ন এক্সপার্টের পরামর্শ নিতে হবে।”
দুস্যদের হাত থেকে বাঁচতে আকুতিও জানান আতিক। দেশে পরিবারের সদস্যদের দেখে রাখতে কোম্পানির কাছে আবেদন জানান তিনি।
অডিওতে তিনি বলেন, “এটা একটু ব্যবস্থা করেন স্যার কাইন্ডলি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন স্যার। আমাদের পরিবারকে একটু দেখবেন স্যার। ওদেরকে সান্ত্বনা জানাবেন।”
বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ জলদস্যুদের কবলে পড়া নিয়ে যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকেএমটিও) তাদের ওয়েবসাইটে দুটি বার্তা প্রকাশ করে মঙ্গলবার।
ওই বার্তা দুটিতে বলা হয়, সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্ব দিকে বাংলাদেশি জাহাজ ছিনতাইয়ের এই ঘটনা ঘটেছে। একটি বড় ও একটি ছোট নৌযানে করে বেশ কয়েকজন লোকজন জাহাজে উঠে সেটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ওই অঞ্চলে চলাচলকারী জাহাজকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে ইউকেএমটিও’র বার্তায়।
এর আগে চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ আইএনএস সুমিত্রা অভিযান চালিয়ে ৩৬ জন ক্রুসহ দুটি ইরানি ফিশিং বোট সোমালি জলদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার করে।