“আগামীকাল ওরা পৌঁছাবে। সেখানে আরেকটা গ্রুপও হয়ত হামলা করতে পারে, ওদের কাছ থেকে জাহাজটি নেওয়ার জন্য।”
Published : 13 Mar 2024, 10:42 PM
প্রায় দেড় দশক আগে মহাসাগরে জাহাজ থেকে অপহরণের শিকার এক নাবিক জানিয়েছেন, সোমালীয় জলদস্যুরা অপহৃতদেরকে ‘নির্যাতন বা দুর্ব্যবহার করে না’। তবে এক ধরনের আশঙ্কা থাকে, সেটি হল ‘জলদস্যুদের একাধিক দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব।’
মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর একটি জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২৩ জন নাবিককে জিম্মি করে সোমালিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করেছে।
২০১০ সালে একই ধরনের ঘটনার শিকার হয় বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাহান মণি। সে বার অপহরণের শিকার হন ২৫ জন। প্রায় সাড়ে তিন মাস পর মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরেন তারা।
সেই জাহাজের নাবিক মো. ইদ্রিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, জলদস্যুদের এই দলটিকে নিয়ে তিনি শঙ্কিত নন, তবে ভয়ের অন্য একটি কারণ আছে।
তিনি বলেন, “আগামীকাল ওরা পৌঁছাবে (সোমালিয়ায়)। সেখানে আরেকটা গ্রুপও হয়ত হামলা করতে পারে, ওদের কাছ থেকে জাহাজটি নেওয়ার জন্য।
“সোমালীয় দস্যুদের হাতে অস্ত্র আছে। একে-৪৭ এর নিচে কোনো অস্ত্র নেই তাদের।”
এই দ্বিতীয় পক্ষ হাজির না হলে অবশ্য দুশ্চিন্তার কিছু নেই বলে মনে করেন ইদ্রিস। সোমালিয়ায় মাস তিনেক বন্দি জীবন কাটিয়ে আসার অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, “পরিবারগুলোকে বলব, এখানে টেনশনের কিছু নাই। ওরা (জলদস্যুরা) মুক্তিপণ পেলে এদেরকে (নাবিকদের) ছেড়ে দেবে।
“ওরা কোনো নির্যাতন করবে না। জাহাজে পর্যাপ্ত প্রভিশন মানে খাবার ও পানি আছে। এদিক দিয়েও চিন্তার কিছু নেই।”
২০১০ সালে অপহরণের শিকার জাহাজটি সিঙ্গাপুর থেকে মালামাল নিয়ে যাচ্ছিল গ্রিসে। ভারত মহাসাগর থেকে অপহরণ করে সোমালিয়ায় নিয়ে যেতে সময় লেগেছে সাড়ে তিনদিন।
জলদস্যুরা ইংরেজি ও আরবিতে কথা বলতে পারে জানিয়ে মো. ইদ্রিস বলেন, “আমাদের কথা বলতেও সমস্যা হয়নি। আর এস আর শিপিং যথেষ্ট সহযোগিতা করে। আমাদের ফ্যামিলিকে যতটুকু গাইড দেয়া দরকার দিয়েছে। যতটুকু সাপোর্টিং দরকার করেছে।”
ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর এমভি জাহান মণি নামে বাংলাদেশি সমুদ্রযানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জলদস্যুরা সেটিকে ছয়দিন পর সোমালিয়ার উপকূলীয় এলাকা গারাকোডের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
সে সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মত এতটা ছিল না। সাত দিনের মাথায় জলদস্যুরা স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়।
জলদস্যু প্রতিনিধির সঙ্গে লিখিত চুক্তি হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। ১৪ দিনের মাথায় জলদস্যুরা ২৫ নাবিককে জাহাজসহ ছেড়ে দেয়। পরে ২১ মার্চ ওমান হয়ে দেশে ফেরেন তারা।
তবে মুক্তিপণ বা সমঝোতা নিয়ে কোনো তথ্যই প্রকাশ করা হয়নি।
১৪ বছর পর জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার আগেই এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা সব কিছু জানাতে পেরেছেন স্বজনদের।
জাহাজটির মালিকপক্ষ এস আর শিপিং; যারা কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের একটি প্রতিষ্ঠান। তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ হয়েছে নাবিকদের।
ইদ্রিস এখন অবশ্য এস আর শিপিংয়ে আর চাকরি করছেন না। তিনি চাকরি পাল্টে যোগ দিয়েছেন ভ্যানগার্ড শিপিংয়ে। তবে এস আর শিপিং তাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, এবারও কোম্পানি নাবিকদের পাশে থাকবে। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে কেএসআরএম কার্যালয়েই কথা হয় তার সঙ্গে।
যে শঙ্কার কথা বলেছেন আবদুল্লার নাবিক
এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান তার স্ত্রীর কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় বলেছেন, “এই মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিও। আমাদের থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে আরকি। ফাইনাল কথা হচ্ছে যে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদেরকে একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলছে।
“এদেরকে যত তাড়াতাড়ি টাকা দিবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলছে। এই মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিও। এখন মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে।”
তবে ইদ্রিস মনে করেন, এই মেরে ফেলার আশঙ্কা কম। তিনি বলেন, “জলদস্যুরা আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো আচরণই করেছে। কাউকেই নির্যাতন করেনি। টাকা পাওয়ার পরই ছেড়ে দিয়েছে।”
এই সময়ে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অস্ত্রের মুখে থাকায় আমরা আতঙ্কে ছিলাম। তখন কিন্তু আমরা ফ্যামিলির সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারিনি। এবার নাবিকরা পরিবারের সঙ্গে শর্ট টাইমে যোগাযোগ করতে পেরেছে। আমরা মিনিমাম ৫ দিন পর ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলছিলাম।
“তবে আমরা মোটামুটি ভালোই ছিলাম। কোনো সমস্যা ছিল না।”
কী করছে কবির গ্রুপ
এস আর শিপিং এর মূল কোম্পানি কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পারসন মিজানুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন তারা জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। এখনো কোনো যোগাযোগ স্থাপন হয়নি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “তাদের একটা কৌশল হলো জাহাজ ক্যাপচার করার পর তারা সেফ জোন তৈরি করে। তারপর সেখান থেকে নিজেদের ডিমান্ড জানায়। আমাদের অগ্রাধিকার হল নাবিকদের মুক্ত করা। তারপর জাহাজ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা।”
এক দশকেরও বেশি সময় আগে জাহান মনি উদ্ধারের ঘটনা উল্লেখ করে মিজানুল ইসলাম বলেন, “ যেহেতু তাদের কাছ থেকে জাহাজ ও নাবিকদের নিরাপদে উদ্ধারে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। আশা করি এবারও সফল হব।”
আরো পড়ুন:
জাহান মণি থেকে আবদুল্লাহ: ২৩ নাবিকের মুক্তি মিলবে কীভাবে
নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর: নৌ প্রতিমন্ত্রী
এমভি আবদুল্লাহ: টাকা না দিলে ‘একজন একজন করে মেরে ফেলার’ হুমকি দিচ্ছে জলদস্যুরা
ছিনিয়ে নেওয়া ইরানি ট্রলারে করে এসে এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি