পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রায় তিন ডজন মামলার মধ্যে এই প্রথম কোনো মামলা বিচার কাজ শুরু হল।
Published : 22 Sep 2022, 08:25 PM
গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ ও অর্থপাচারের মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে বাদীর জবানবন্দি শোনার মধ্য দিয়ে।
মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বৃহস্পতিবার ঢাকার ১০ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের আদালতে সাক্ষ্য দেন।
আর এর মধ্য দিয়ে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রায় তিন ডজন মামলার প্রথমটির বিচারকাজ শুরু হল।
দুদকের আইনজীবী মীর আহম্মেদ আলী সালাম জানান, বাদী সাক্ষ্যের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী ও শাহিনুর ইসলাম জেরার জন্য সময়ের আবেদন করেন। পরে বিচারক আগামী ১৩ অক্টোবর শুনানির পরবর্তী দিন ঠিক করে দেন।
দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন তার জবানবন্দিতে বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তারা পি কে হালদারের ২৮৩ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পান।
“এর মধ্যে ১২ কোটি টাকা তিনি (পিকে হালদার) দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন হিসেবে নেন। বাকি ২৭১ কোটি টাকা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় তার নামে মামলা দায়ের করা হয়। তবে তদন্তে দেখা যায়, তার অবৈধ সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪২৫ কোটি টাকা।”
তাছাড়া পিকে হালদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে মোট ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকার ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অস্বাভাবিক’ লেনদেন হয়েছে বলেও সাক্ষ্যে তথ্য দেন বাদী।
তিনি বলেন, “আসামি পি কে হালদার তার অর্জিত সম্পদের মধ্যে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা কানাডার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন। স্থানান্তরিত টাকার মধ্যে তার নিজের নামে ২৪০ কোটি ও মায়ের নামে ১৬০ কোটি টাকা রয়েছে। বাকি টাকা তার আত্মীয় স্বজন ও দুটি প্রতিষ্ঠান এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের নামে আছে।”
দুদকের আইনজীবী মীর আহম্মেদ আলী সালাম জানান, মো. সালাহউদ্দিন এ মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তা। সে হিসেবে তিনি আবারও সাক্ষ্য দেবেন।
আলোচিত এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকার আদালতের বেশ কয়েকজন ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ আইনজীবী এদিন এজলাস কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, দুদকের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন গত ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে এই ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন।
এরপর গত ৮ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামিদের বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক। ওইদিনই সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২২ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করা হয়।
সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কাঠগড়ায় থাকা আসামি সুকুমার মৃধা, তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা, শঙ্খ ব্যাপারী ও অবন্তিকা বড়ালকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
আসামিদের মধ্যে পি কে হালদার আছেন ভারতের কারাগারে। তাকেসহ দশজনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার কার্যক্রম চলছে।
বাকি নয়জন হলেন: পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রীতিশ কুমার হালদার, রাজিব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায়, স্বপন কুমার মিস্ত্রি।
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ
পি কে হালতার নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
এই চার কোম্পানি হল- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অংকের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
২০১৯ সালে দুদকের তদন্ত শুরুর পর পি কে হালদারের পালিয়ে যাওয়ার খবর মেলে। তখন শোনা গিয়েছিল, তিনি কানাডায় চলে গেছেন। কিন্তু গত ১৩ মে হঠাৎ করেই খবর আসে, পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে পশ্চিমবঙ্গে অভিযানে নেমেছে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। পরদিন আসে গ্রেপ্তারের খবর।
তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে নানা আর্থিক প্রতিষ্ঠান খুলে হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে ইতোমধ্যে ৩৪টি মামলা হয়েছে।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাটি করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী।
তদন্ত শেষে অভিযোগপত্রে বলা হয়, পি কে হালদার নামে-বেনামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬ হাজার ৭৯০ শতাংশ জমি কিনেছেন, যার বাজারমূল্য দেখানো হয়েছে ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা। বর্তমানে এর বাজার মূল্য ৯৩৩ কোটি টাকা।
এর মধ্যে নিজের নামে জমি কিনেছেন ৪ হাজার ১৭৪ শতাংশ, যার দাম দলিলে দেখানো হয়েছে ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা। অথচ এ সম্পদের বর্তমান মূল্য ২২৮ কোটি টাকা। এছাড়া রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পি কে হালদারের নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, পি কে হালদার তার নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন করেছেন, যার দাম ১২ কোটি টাকা। পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনেন, যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা।
নিজের কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে ২ একর জমির ওপর নির্মাণ করেন আটতলা হোটেল (র্যাডিসন নামে পরিচিত), যার আর্থিক মূল্য এখন ২৪০ কোটি টাকা। এছাড়া পি কে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ও অনঙ্গ মোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি, এর বর্তমান দাম ১৬৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও কানাডিয়ান ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যের বরাত দিয়ে দুদক প্রতিবেদনে বলেছে, পি কে হালদার ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভাই প্রীতিশ হালদারের কাছে ১ কোটি ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৬৪ কানাডীয় ডলার পাচার করেন; বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮০ কোটি টাকারও বেশি।