পি কে হালদার: এক মেধাবীর জালিয়াত হয়ে ওঠার গল্প

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনশেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
Published : 23 May 2022, 09:15 AM
Updated : 23 May 2022, 09:15 AM

ভদ্রলোক শুধু মেধাবী নন, মেধাবীদের মধ্যে মেধাবী। নাম প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার। তাকে ভদ্রলোক বলা কি ঠিক হচ্ছে? তবে ভদ্রলোক তো ছিলেন এক সময়ে। এখনও তিনি নিশ্চয়ই অভদ্র নন! তবে দুর্নীতিবাজ, ও আর্থিক কেলেংকারির যু্বরাজ বলা যেতে পারে। কে যে এই ব্যক্তির নাম প্রশান্ত রেখেছিলেন, আমি জানি না। এই প্রশান্ত আজ প্রবল অশান্তি তৈরি করেছেন বাংলাদেশ, ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। যদিও তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন পশ্চিম বঙ্গে, তবে আলোচনা, সমালোচনা, উৎকণ্ঠা, ও ভুক্তভোগীদের প্রতিকারের প্রত্যাশা বাংলাদেশেই বেশি। কেননা, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক, এবং প্রাথমিক প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন এই হালদার মহাশয়। তবে দুদক আইনজীবীর ভাষ্য, তার পাচার করা অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার কম হবে না।  

হালদার মহাশয় শুধু বাংলাদেশ, ও পশ্চিম বঙ্গেই অশান্তির হেতু তৈরি করেননি, তাকে গ্রেপ্তারের উত্তাপ ছড়িয়েছে কানাডা, দুবাই ও গ্রানাডাতেও যেখানে তার সম্পদ রয়েছে। এছাড়া লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, অস্ট্রেলিয়াসহ যে সকল জায়গায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের শক্তিশালী কমিউনিটি আছে, সেখানেও ঘটনাটি আলোচিত হচ্ছে। ফলে ঘটনাটি জাতীয় গণ্ডি অতিক্রম করে আংশিক আন্তর্জাতিক মাত্রাও পেয়েছে বটে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে সাধুবাদ। বাংলাদেশ সরকারের সদিচ্ছা, ও দুদকের তথ্যের ভিত্তিতে ফিউজিটিভ হালদার মহাশয়কে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট বা ইডি গ্রেপ্তার করেছে বলে কাগজে প্রকাশ। আমাদের প্রত্যাশা, পি কে হালদারকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। তবে মামলার সংখ্যা, ও ব্যাপকতা; 'অপরাধের ক্রস বর্ডার ইমপ্লিকেশন'স; বাংলাদেশ, ও ভারতের অপরাধের তথ্য আদান প্রদান বিষয়ক প্রটোকল; বন্দি-বিনিময় চুক্তি; তদন্ত, ও বিচার প্রক্রিয়ার অগ্রগতি; দুই দেশের স্বরাষ্ট্র, ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বোঝাপড়া, এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে পি কে হালদারকে কবে নাগাদ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করা হবে।  

এবার আমরা একটু নজর দিতে চাই সেই প্রক্রিয়ার দিকে, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অজ পাড়া গাঁয়ের অসম্ভব মেধাবী এক শিক্ষার্থী দুর্বৃত্ত হয়ে উঠলেন; সেই আর্থিক ব্যবস্থার দিকে যার ফাঁকফোকর গলে এক শিক্ষিকা, ও দর্জির কীর্তিমান পুত্র হয়ে উঠলেন এক কুখ্যাত খন্নাস, আর্থিক কেলেংকারীর (আংশিক) আন্তর্জাতিক যুবরাজ! শুধু প্রশান্ত কুমারই নন, তার সহোদর প্রীতিশ কুমার হালদারও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়তে এসেছিলেন পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রাম থেকে। বাবা প্রয়াত প্রণনেন্দু হালদারের পেশা ছিল দর্জিগিরি, মা লীলাবতী হালদার ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুই সহোদরই ছিলেন মেধাবী; ফলে, দুইজনই বুয়েট থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।   

পরে পি কে হালদাররা দুই ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করেন। পাশাপাশি প্রশান্ত কুমার চার্টার্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্টও (সিএফএ) সম্পন্ন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে প্রশান্ত কুমার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন, এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন। নিঃসন্দেহে মেধার জোরেই পি কে এ অবস্থান অর্জন করেছিলেন। কিন্তু বিপত্তি শুরু হয় এর পরে। ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ সালে তিনি অদৃশ্য আশীর্বাদে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন। এ দুই প্রতিষ্ঠানই এস আলম গ্রুপের। দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন ২০১৮ সালে। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাদের কার্যালয়। আর কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে, যার পরিচালক পি কে হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। কানাডা সরকারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার টরন্টোর ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাসাটি তাদের।

এমডি হওয়ার পরেই কি পি কে হালদার উচ্চাকাংখী হয়ে ওঠেন? উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাটি হওয়া উচিত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, ও (বৈধভাবে) পেশাগত, ও আর্থিক উন্নতির জন্য। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি যদি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়ে তার দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, ও দুঃস্থ মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসেন, সেটি তো তখন হয়ে ওঠে অনুকরণীয় এক আদর্শ। তবে পি কের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ইতিবাচক কিছু ছিল না। ছিল এক সর্বনাশা উচ্চকাঙক্ষা, যা নিশ্চিতভাবেই তার লোভ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার ভেতরের ভোগী, ও পশু সত্ত্বাকে উস্কে দিয়েছিল। টাকা ও সম্পদের নেশায় তিনি উম্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। শিক্ষা, নীতি, নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ- কোন কিছুই তার লোভী, ও লালসাকাতর উন্মাদনার রাশ টেনে ধরতে পারেনি। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও নজরদারী এড়িয়ে তিনি শত শত কোটি টাকা পাচার করেন কানাডা, দুবাই, ভারত, ও গ্রানাডাতে।  হালদার মহাশয় জাগতিক ভোগ-বিলাসের জন্য মূল্যবোধের ন্যূনতম পাঠ বিস্মৃত হয়ে এতটাই নিচে নেমে গিয়েছিলেন যে, নিজের মাকে জালিয়াতির সঙ্গে জড়াতেও তার বিবেক তাকে এতটুকু বাঁধা দেয়নি। 

ছাপা কাগজের খবর অনুযায়ী, কর কর্মকর্তাদের সহায়তায় পি কে হালদার প্রথমে মায়ের নামে জাল আয়কর ফাইল খোলেন এবং সেখানে বিপুল অঙ্কের নগদ অর্থ দেখানো হয়। পরে মায়ের ফাইল থেকে নিজের আয়কর ফাইলে 'দান' দেখানোর মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করা হয়। সম্পদ ও বিনিয়োগের তথ্য গোপন করে প্রায় ২৪ লাখ টাকা আয়কর ফাঁকি দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা চলমান আছে। ২০১৫ সালেই আয়কর গোয়েন্দাদের কাছে পিকে হালদারের জালিয়াতি ধরা পড়ে। ওই বছরের অগাস্টে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) কর্মকর্তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কর অঞ্চল-৫-এর সার্কেল-১০৩- এ অভিযান চালান (দৈনিক যুগান্তর, ১৮ মে, ২০২২)।

ওই অভিযানে করদাতাদের সম্পদবিবরণীতে প্রকৃত সম্পদের চেয়ে কমবেশি ও প্রকৃত আয় না দেখিয়ে কর ফাঁকিতে সহায়তা করার অভিযোগে এক সহকারী কর কমিশনারকে বরখাস্ত করা হয়। ওই সার্কেলে রিটার্ন দেওয়া ফাইলগুলোর মধ্যে একটি ছিল পিকে হালদারের মা লীলাবতী হালদারের। অশীতিপর এক বৃদ্ধার আয়কর ফাইলে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ দেখানোয় পুরো বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হয়। বিস্তারিত তদন্ত শুরু করলে পিকে হালদারের নাম বেরিয়ে আসে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই তদন্ত বেশিদূর এগোয়নি। কর কর্মকর্তাদের ভাষ্য হচ্ছে, জালিয়াতির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসাবে পিকে হালদার মায়ের নামে আয়কর ফাইল খোলেন। যে টিআইএন- এর বিপরীতে লীলাবতী রিটার্ন জমা দিয়েছেন, ওই সংখ্যার টিআইএন তখনকার ডাটাবেজে পাওয়া যায়নি। অথচ সেই টিআইএন- এর বিপরীতে ১৯৮৯-৯০ করবর্ষে ৮০ কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ লীলাবতীর ফাইলে দেখানো হয়। এই অর্থই ২০১৩-১৪ করবর্ষে পিকে হালদারের ফাইলে স্থানান্তর করা হয় (তথ্যসূত্র: প্রাগুক্ত)। 

গত এক দশকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বৃহৎ অবকাঠামো গড়ে ওঠা, ও মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা সত্ত্বেও দুর্নীতি বেড়েছে আশংকাজনক হারে, এবং সমাজের সর্বত্র মূল্যবোধের ভয়াবহ অবক্ষয় হয়েছে। নৈতিকতার এই অবক্ষয়, দুর্নীতি, ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে পি কে হালদারের মতো একজন সর্বোচ্চ মেধাবী হয়ে গেছেন এক মহাদুর্বৃত্ত। আয়কর গোয়েন্দা, ও দুদকের তৎপরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক, ও বাংলাদেশ সিকিউরিটি, ও এক্সচেঞ্জ কমিশন পি কে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ, ও টাকা পাচার আটকাতে পারেনি। বরং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা তাকে সহযোগিতা করেছেন। তার দেশ থেকে পালানোর পেছনেও ছিল প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহযোগিতা।  

এখন এই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, দুর্বৃত্ত হওয়ার প্রক্রিয়া, পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের নর্ম হয়ে ওঠা- এই সব কিছুকে বাদ দিয়ে শুধু পি কে ও তার পরিবারকে যদি কাঠগড়ায় তুলে দেই, তাহলে সেটি কি ন্যায্য হবে? অবশ্যই ব্যক্তিগত, ও পারিবারিক দায় তারা অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু তার অর্থ আত্মসাৎ, ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ গ্রহণ ও ঋণ খেলাপী হওয়ার প্রক্রিয়া যদি বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, ও ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট ঠেকাতে পারত, তাহলে কি হালদার মহাশয় শত কোটি টাকার মালিক হতে পারতেন? অবৈধ টাকার মালিক না হলে ওই টাকার নিরাপত্তার জন্য তার কি প্রয়োজন হত অর্থ বিদেশে পাচারের? 

প্রশ্ন হচ্ছে, সিস্টেমের যে দুর্বলতা, তার দায় কি সিস্টেম নেবে, নাকি সেটিও পি কে হালদারদের ওপর বর্তাবে? আর্থিক ব্যবস্থার ফাঁকফোকর ঠিক করা না গেলে এক পি কে ধরা পড়লেও নতুন করে এক ডজন পি কে হালদার তৈরি হবে। পি কে হালদার ও তার পরিবারের সদস্যদের অতি অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু এ আখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা তো এটিও পর্যবেক্ষণ করলাম যে, গ্রাম থেকে আসা একটি সাধারণ পরিবারের দু'জন মেধাবী শিক্ষার্থীর সম্ভাবনার মর্মান্তিক মৃত্যু হলো। মেধা, ও যোগ্যতা দিয়ে পরিবার, ও দেশের মানুষকে সেবার বদলে লোভ, ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার কারণে পি কে হালদার হয়ে উঠলেন ঘৃণিত এক দুর্বৃত্ত। বাংলাদেশের ব্যক্তি, পরিবার,সমাজ, ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে ভোগবাদ, অর্থ, ও ক্ষমতার জন্য যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে, সেটির অবসান না হলে, বা সেটিকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করা না গেলে, আমরা আর মানুষ থাকব না। আমরা পরিণত হব অর্থ, ও ক্ষমতার লোভে উন্মাদ এক একটি দানবে।