আদালতের নিষেধ ভেঙে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনায় ভোররাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে বিমানবন্দরে পৌঁছান শারমিন ও তানিয়া, সেখান থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব।
Published : 24 Aug 2022, 02:32 PM
ভারতের কারাগারে বন্দি পি কে হালদারের যে দুই নারী ‘সহযোগীকে’ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় র্যাব গ্রেপ্তার করেছে, তারা অর্থ আত্মসাতে অভিযুক্ত বহুল আলোচিত প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক খবিরউদ্দীনের দুই মেয়ে।
পিপলস লিজিংয়ের পরিচালকের দুই মেয়ে শারমীন আহমেদ (৪২) ও তানিয়া আহমেদকে (৩৭) বুধবার ভোররাতে রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। একমাস আগে ঢাকায় এসে আত্মগোপনে থেকে তারা কানাডায় ‘পালিয়ে যাচ্ছিলেন’ বলে র্যাবের ভাষ্য।
র্যাব বলছে, প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের এই দুই সহযোগী ২০০৩ এবং ২০০৪ সাল থেকে কানাডায় বসবাস করেন। আদালতের নিষেধ ভেঙে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনায় ভোররাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে বিমানবন্দরে পৌঁছান শারমিন ও তানিয়া। আটকের পর তারা নাম পরিচয় গোপান করারও চেষ্টা করেন।
দুজনের মধ্যে শারমিন আহমেদের নামে ৩১ কেটি ও তানিয়া আহমেদের নামে ৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাত করার অভিযোগ আছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
বেসরকারি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার যে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন, সেগুলোর একটি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস। আর এ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক খবিরউদ্দী ছিলেন পি কে হালদার এর অন্যতম সহযোগী। তিনি কোম্পানির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পরিচালকের পদে ছিলেন।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “কোম্পানির পরিচালকরা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে বেনামে গ্রাহকদের অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়ে আত্মসাৎ করেন। খবিরউদ্দীন তিনিও নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। পরে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ওই পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।”
তিনি জানান, দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে দুবছরের মতো জেল খেটে এখন জামিনে বেরিয়ে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন খবিরউদ্দিন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২৮ জুলাই খবিরউদ্দীনের দুই মেয়ে দেশে আসেন বলে র্যাবের কাছে খবর আসে।এরপর থেকেই গোয়েন্দা ও র্যাব ৩ সদস্যরা তাদের সন্ধানে অভিযানে নামে।
কেন তারা ঢাকায় এসেছিলেন প্রশ্ন করলে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, একটি পারিবারিক প্রোগ্রামে অংশ নিতে তারা ঢাকায় আসেন। পুরোটা সময় তারা আত্মগোপনে ছিলেন।”
মঈন জানান, অর্থ আত্মসাতের মামলায় চলতি বছরের ৭ মার্চ কোম্পানির ঋণ খেলাপিদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। ওইদিন উপস্থিত না হওয়ায় গত ১৯ এপ্রিল তাদের গ্রেপ্তারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয় আদালত।
বিদেশে থাকা অবস্থায় তাদের (শারমিন ও তানিয়া) নামে কী করে ঋণ নেওয়া হল জানতে চাইলে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, “তারা হয়ত তখন ছুটিতে এসেছে বা তাদের বাবা হয়ত কোনভাবে ম্যানেজ করেছে। তবে যে যেটি (যে পরিমাণ টাকা) নিয়েছে সে সেটি ভোগ করেছে।”
আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে এই র্যাব কর্মকর্তা বলেন, “প্রায় ছয় হাজার আমানতকারী যেন অর্থ পেরত পায় এজন্য দেশে বিদেশে সবাই কাজ করছেন। ২০২১ সালের মার্চে হাইকোর্ট এ বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদ করেছেন যাদের দায়িত্ব হচ্ছে সমন্বয় করার।“
এর আগে পি কে হালদারের আরেক ‘ঘনিষ্ঠ’ সহযোগী অবন্তিকা বড়ালকে গত বছর রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে তার কয়েক ডজন সহযোগী এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
প্রশান্ত কুমার হালদার বেসরকারি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তার দুনীতির খবর আসে ২০২০ সালের শুরুতে। এরপর দুদক তদন্তে নেমে পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের ৩৪টি মামলা করে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।
এই চার কোম্পানি হল- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
এসব কোম্পানি থেকে পি কে হালদার ঋণের নামে বিপুল অংকের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।
এর মধ্যে আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে গত বছরের শুরুতে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর পর দুদক তার ২৭৫ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদের’ খবর দিয়ে মামলা করে। দুদক এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিলও করেছে।
দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, পি কে হালদার তার নিজের, আত্মীয়দের, বন্ধু ও কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে আটটি কোম্পানিতে ৬৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৯ টাকা বিনিয়োগ করেছেন, যার ‘বৈধ কোনো উৎস’ অনুসন্ধানে মেলেনি।
পি কে হালদার কানাডায় পালিয়েছিলেন বলে গুঞ্জন ছড়ালেও চলতি বছরের মে মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তার এবং সহযোগীদের সম্পদের খোঁজে অভিযানে নামে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।
সে সময় পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার মৃধা, প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার এবং তাদের সহযোগীদের নামে থাকা বাড়ি ও সম্পত্তিতে আভিযান চালায় ইডি।এদের সবাইকে বাংলাদেশের নাগরিক বলেও উল্লেখ করা করে ইডি।
এর পর গত ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার থেকে পাঁচ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন পি কে হালদার।।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট পি কে হালদারকে দুদফা রিমান্ডে নেয়। বর্তমানে ভারতের কারাগারে বন্দি আছেন পি কে হালদার।
পুরনো খবর
দেশত্যাগে চেষ্টা: পি কে হালদারের দুই নারী সহযোগী গ্রেপ্তার
পি কে হালদারের বিষয়ে জানতে ভারতকে বাংলাদেশের চিঠি
পি কে হালদারের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ‘হতভম্ব’ তার শিক্ষক
পি কে হালদারকে এখনই পাওয়া যাবে না, ধারণা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
পি কে হালদারের ‘৬২ সহযোগীর’ খোঁজ পেয়েছে দুদক
পি কে হালদারের ‘সহযোগী’ অবন্তিকা দুদকের রিমান্ডে
অর্থপাচার: পলাতক পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস