পি কে হালদারের মাসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করার অভিযোগ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও সাবেক সচিব ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এন আই খানসহ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Jan 2021, 09:24 AM
Updated : 5 Jan 2021, 12:20 PM

পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার ও দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যপারে অগ্রগতি জানার পর ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ আমানতকারীর আবেদনে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ আদেশ দেয়।

আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পরে সাংবাদিকদের বলেন, “ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচজন আজ হলফনামা করে আদালতকে একটি তালিকা দিয়ে বলেছেন যে, পি কে হালদারের সাথে এদের যোগাযোগ আছে। অর্থপাচারের সাথেও এই ২৫ জন জড়িত।

“এরা যাতে বিদেশ যেতে না পারে বা পালিয়ে যেতে না পারে এবং তদন্তে যাতে তাদের পাওয়া যায়, সে কারণে তারা একটি আবেদন করেছেন। সে মোতাবেক আমরা রাষ্ট্রপক্ষ তাদের সমর্থন দিয়েছি। পরে আদালত তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।”

যাদের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী, হারুনুর রশিদ (ফাস ফাইনান্স), পি কে হালদারের বন্ধু উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সামি হুদা, পি কে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অবন্তিকা বড়াল, শামীমা (আইএলএফএসএল ), রুনাই (আইএলএফএসএল), সাবেক সচিব ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এন আই খান, সুকুমার মৃধা (ইনকাম ট্রাক্স আইনজীবী), অনিন্দিতা মৃধা, তপন দে, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, অভিজিৎ চৌধুরী, রাজিব সোম, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক পরিচালক ইরফান উদ্দিন আহমেদ, অঙ্গন মোহন রায়, নঙ্গ চৌ মং, নিজামুল আহসান, মানিক লাল সমাদ্দার, সোহেল সামস।

এছাড়া পিকে হালদারকে `বিভিন্নভাবে তথ্য দিয়ে সহায়তাকারী’ মাহবুব মুসা, এ কিও সিদ্দিকী, মোয়াজ্জেম হোসেন ও পি কে হালদারের মা লিলাবতী হালদারের ক্ষেত্রেও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র সচিবকে এ নির্দেশ দিয়ে আদালত আদেশে বলেছে, “অগ্রধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল, যাতে তারা কোনোভাবেই দেশ ছাড়তে না পারেন। সেই সাথে তদন্তের প্রয়োজনে আইন অনুসারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে।”

ওই ২৫ জনের মধ্যে লীলাবতী হালদার, অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারী, ইরফান উদ্দিন আহমেদ ও উজ্জ্বল কুমার নন্দীর পাসপোর্ট উচ্চ আদালতের নির্দেশে জব্দ আছে।

গত বছর ১৯ জানুয়ারি বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক বেঞ্চ পি কে হালদারসহ ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিস লিমিটেড (আইএলএফএসএল) এর ২০ কর্মকর্তার পাসপোর্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছিল।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।

এই চার কোম্পানি হল- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।

এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অংকের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে তদন্তকারীদের ভাষ্য।

এর মধ্যে আইএলএফএসএল গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে গত বছরের শুরুতে পি কে হালদারের বিদেশ পালানোর পর দুদক তার ৩০০ কোটি টাকার ‘অবৈধ সম্পদের’ খবর দিয়ে মামলা করে।

বিদেশে থাকা পিকে হালদার গত ২৮ জুন আইএলএফএসএলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে তার দেশে ফেরার জন্য ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন।

আদালত তাতে অনুমতি দিলেও পিকে হালদার না ফেরায় ইন্টারপোলের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।

ঢাকার জজ আদালত ইতোমধ্যে পি কে হালদারের সব স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করারও আদেশ দিয়েছে। আর পলাতক অবস্থায় তার বক্তব্য বা সাক্ষাৎকার গণমাধ্যমে প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে হাই কোর্ট। 

পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইনানশিয়াল সার্ভিস লিমিটেডের চারজন ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারী গত রোববার তাদের আমানত ফিরে পেতে আদালতের কাছে আকুতি জানান।

এই চারজন হলেন- সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে নাশিদ কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক মো. শওকতুর রহমান, খালেদ মনসুর ট্রাস্ট্রের হিসাব শাখার কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম এবং গৃহিনী সামিয়া বিনতে মাহবুব।

আরেক আমানতকারী সাবেক রাষ্ট্রদূত রাজিউল হাসান সেদিন ভার্চুয়াল কোর্টে যুক্ত থাকলেও কোনো বক্তব্য দেননি। 

আমানতকারীদের বক্তব্য শোনার পর আদালত বিষয়টি মঙ্গলবার আদেশের জন্য রেখে এই পাঁচ আমানতকারীকে তাদের বক্তব্য হলফনামা আকারে দাখিল করতে বলে। সেই সাথে এ মামলায় তাদের পক্ষভুক্ত করা হয়।

আইনজীবী ছাড়াই এ মামলায় পক্ষভুক্ত পাঁচ আমানতকারীকে তাদের বক্তব্য ও যুক্তি তুলে ধরার পাশাপাশি আবেদন করার অনুমতি দেওয়া হয়।

সে অনুযায়ী মঙ্গলবার তারা পি কে হালদারের ‘সহযোগী’ ২৫ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন।

‘বাংলাদেশ ব্যাংক জবাব দিতে দায়বদ্ধ’

গত বছর ১৮ নভেম্বর দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘পি কে হালদারকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা চাইবে দুদক’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আসার পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেয় হাই কোর্টের এই বেঞ্চ।

প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)

পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বা গ্রেপ্তার করতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানকে ১০ দিনের মধ্যে তা জানাতে বলা হয়।

এছাড়া পিকে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কিংবা গ্রেপ্তারে কী যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা সে ব্যাখ্যা জানাতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। দুদক চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ও ঢাকা জেলা প্রশাসককে ১০ দিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

আদেশ অনুযায়ী দুদক গত ২ ডিসেম্বর একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপর গত ৯ ডিসেম্বর পি কে হালদারের খালাতো ভাই পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের সাবেক পরিচালক অমিতাভ অধিকারী ও পি কে হালদারের সাবেক সহকর্মী পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীকে এ মামলায় পক্ষভুক্ত করা হয়।

মঙ্গলবারের শুনানিতে আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে আদালত।

বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, “আমানতকারীদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এই কোম্পানি (পিপলস লিজিং) বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত। তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) কীভাবে চুপ থাকে! এত কিছু হচ্ছে, বিভিন্ন ব্যাংকে কত টাকা বিভিন্নভাবে ধ্বংস হচ্ছে, ক্রাইম হচ্ছে! বললেই হবে না আমরা কিছু জানি না! তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) জবাব দিতে দায়বদ্ধ। এ বিষয়ে পরে ধরব আমরা। ‘আমরা পারি না, পারব না, জানি না’- এ ধরনের কথা বলে তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) পার হতে পারবে না। এদেশের মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধ থাকতে হবে।”

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এ সময় বলেন, “আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কেন নীরব। আজকে কতদিন হল, কেন তারা কিছু বলছে না?”

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক তখন বলেন, “আবেদনকারী আমানতকারীরা কী পরিমাণ টাকা চান সেটা উল্লেখ করে এই কোর্টে আবেদন করেন। সেই সাথে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছেও আবেদন করবে।”

আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, “আমি অন্তবর্তী আদেশ চাচ্ছিলাম যে, বাংলাদেশ ব্যাংক অন্তত কিছু টাকা হলেও দিক। সেরকম একটা নির্দেশনা দেন।

বিচারক বলেন, “আমরা তো সে কথাই বলছি, একটা দরখাস্ত আমাদের কাছে, কোর্টে দরখাস্ত করেন। আমরা সেটা সেন্ড করব।”