পি কে হালদারের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ‘হতভম্ব’ তার শিক্ষক

ছেলেবেলা থেকেই মেধাবী পি কে হালদারের অর্থ লোপাটের ঘটনায় ‘হতভম্ব’ তার স্কুল জীবনের শিক্ষক, স্বজনসহ গ্রামের প্রতিবেশীরা।

পিরোজপুর প্রতিনিধিমো. হাসিবুল ইসলাম হাসান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2022, 01:56 PM
Updated : 16 May 2022, 03:59 PM

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার অজপাড়াগাঁ দীঘিরজান গ্রাম থেকেই উঠে আসা পি কে (প্রশান্ত কুমার) হালদারের পরিবারের কেউ আর এখন সেখানে থাকেন না। ২০ বছর আগেই গ্রামের পাট চুকিয়ে মা ও তিন ভাই ভারতে চলে যান। জমি-জিরাত না থাকলেও ভিটেটুকু এখনও আছে।

দীঘিরজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুল শুরু পি কে হালদারের; সেই স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন তার মা লীলাবতী হালদারও। আর বাবা প্রণবেন্দু হালদারের দর্জির দোকান ছিল গ্রামেরই বাজারে। তাদের তিন সন্তান।  

পি কে দীঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর চলে আসেন বাগেরহাটের পি সি কলেজে। পরে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে।

দীঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মনিন্দ্য মজুমদার সোমবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওরা তিন ভাই আমার ছাত্র ছিল। ছোটবেলা থেকেই দেখছি। ওদের তিন ভাই, প্রত্যেকে তুখোড় মেধাবী।

“প্রশান্তর অর্থ লোপাটের ঘটনায় আমি হতভম্ব। ওকে যখন দেখতাম তখন কখনও ভাবিনি যে, সে ভবিষ্যতে এগুলো করবে।”

সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় দেশের আর্থিক খাতে ২০২০ সালে আলোচনায় আসে পি কে হালদারের নাম। তারপরই তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তাকে গ্রেপ্তারের পর আবারও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

সোমবার সকালে দীঘিরজান গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পি কে হালদারের পৈত্রিক ভিটেতে গাছগাছালির মধ্যে বসতঘরের মেঝের দেয়ালটি এখনও টিকে আছে। তবে ওপরে কোনো কাঠামো নেই। উঠানজুড়ে কেবল আগাছা আর শেওলায় ভরা। পেছনের দিকে থাকা টিনের রান্নাঘরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। বোঝাই যায়, অনেক দিন সেখানে মানুষের পদচারণা পড়েনি।

পি কে হালদারের মেজ ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন এবং ছোট ভাই প্রাণেশ কুমার হালদার ভারতে আছেন। দেশ ছাড়ার পর তারা আর কোনোদিন সেখানে আসেননি।

গ্রামে এখনও পি কে হালদারের চাচাত ভাই তপন হালদার বসবাস করেন; আছেন আরও কয়েকজন নিকটাত্মীয়।

তিনি বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামের বাড়ির যে জমি আছে তা প্রীতিশ কুমার হালদারের নামেই আছে। তাদের মা লীলাবতী হালদার আশপাশের ফসলি নাল জমি স্থানীয় হারুন হাওলাদারের কাছে বিক্রি করে গিয়েছিলেন।”

প্রীতিশ কুমার হালদারও তার বড় ভাইয়ের মতো বুয়েট থেকেই পাস করেন। পরে দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করেন। এরপর চার্টার্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট (সিএফএ) সম্পন্ন করে পি কে হালদার চাকরিতে ঢুকেন।

পি কে হালদারের মামা শশোধর ব্যাপারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০০২ বা ২০০৩ সালের দিকে প্রশান্ত একবার বাড়িতে এসেছিলেন। বাড়ির মূল ঘরটি আর ফসলের নাল জমি বেচে দিয়ে ওই সময়ে তার মা ভারতে চলে যান। ভিটেটা ছিল, আছে। সেই সময়ে শেষ দেখা হয় আমার সঙ্গে।

পি কে হালদারকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও এসেছে সোশাল মিডিয়ায়।

“বিদেশে প্রচুর সম্পদ গড়লেও গ্রামে কোনো সম্পদ নেই পি কে হালদারের।"

শিক্ষাজীবন শেষে পি কে হালদার যোগ দেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে; ২০০৮ সাল পর্যন্ত উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন। ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন।

দীর্ঘদিন গ্রামের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলেও টাকা লোপাটের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তাকে নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়।  

দীঘিরজান গ্রামের বাসিন্দা ও প্রতিবেশী মানিক শেখ বলেন, তারা জানতেন পি কে হালদার অনেক বড় ব্যবসায়ী ও বড় কোম্পানিতে চাকরি করেন। এলাকার মানুষদেরও নানা সহযোগিতা করতেন মাঝে মাঝে।

“কিন্তু বর্তমানে পি কে হালদারের প্রতারণার কথা জানতে পেরে সবাই অবাক হয়েছেন। তার মতো প্রতারকের বিচার হওয়া উচিত।”

স্থানীয় দীপ্তেন মজুমদার বলেন, “প্রশান্ত হালদারকে একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে এলাকাবাসী চিনত। দীর্ঘদিন ধরে এলাকার সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। মানুষ জানত প্রকৌশলী পেশায় তিনি অনেক বড় চাকরি করেন। কুষ্টিয়ায় একটি জুট মিলসহ তার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা ছিল বলে মানুষ জানে।”

“১৫-১৬ বছর আগে এক মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছেন বলে গ্রামে প্রচার হয়। তিনি ধর্মত্যাগী হয়েছেন এরকম খবর ছিল। তার জীবনযাপন রহস্যজনক মনে হতো মানুষের কাছে।”

পি কে হালদারের চাচাত ভাইয়ের ছেলে সিদ্ধার্থ হালদার বলেন, “মুসলিম নারীকে বিয়ে করে তিনি ধর্মত্যাগী হয়েছেন এরকমও খবর ছড়িয়েছিল ১৫-১৬ বছর আগে।"

পি কে হালদারের অর্থ লোপাটের ঘটনায় গ্রেপ্তার আইনজীবী সুকুমার মৃধা ও তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধার বাড়িও পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শেখমাটিয়া ইউনিয়নের বাকসি গ্রামে। তারাও পি কে হালদারের মতোই সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা বলে স্থানীয়রা জানান। 

তারা আরও জানান, সুকুমার মৃধার বাবা ছিলেন গ্রাম্য চৌকিদার।

আরেক সহযোগী গ্রেপ্তার অবন্তিকা বড়ালের গ্রামের বাড়ি নাজিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের আমতলা গ্রামে। পিরোজপুর শহরের খুমুরিয়া এলাকায় তাদের একটি বাড়ি রয়েছে। অবন্তিকার বাবা প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা অরুণ কুমার বড়াল ছিলেন পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রভাষক।

আরও পড়ুন: