নিয়ম না মেনে মাইক, লাউড স্পিকারে বাজানো ভোটের গান শব্দ দূষণের নগরী ঢাকায় এই দূষণের মাত্রা আরও বাড়াচ্ছে।
Published : 04 Jan 2024, 04:28 PM
ঢাকা মহানগরীর বেশির ভাগ আসনেই ভোটের মাঠের উত্তাপ না থাকলেও প্রচারে কমতি রাখতে চাইছেন না প্রার্থীরা। দিন-রাতের বড় অংশজুড়েই ভোটারদের দৃষ্টি কাড়তে চলছে মাইক, এলইডি মনিটর, লাউড স্পিকারের ব্যবহারও; উচ্চ শব্দের এমন প্রচারে অনেক স্থানেই যন্ত্রণায় পড়েছেন স্থানীয়রা।
নিয়ম না মেনে উচ্চ শব্দে নির্বাচনি প্রচারে মাইক, লাউড স্পিকারে বাজানো ভোটের গান শব্দ দূষণের নগরী রাজধানী ঢাকায় এই দূষণের মাত্রা আরও বাড়াচ্ছে।
যত্রতত্র বিকট শব্দে মাইকিং, নির্বাচন পরিচালনার জন্য গড়া ক্যাম্পগুলোতে লাউড স্পিকারে বাজানো নির্বাচনের গান তো বাজছেই, পথের ধারে লাগানো বিশাল মনিটরে প্রদর্শিত তথ্যচিত্রেও শব্দ নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলা প্রচারণায় শব্দ দূষণ বাড়ার সঙ্গে লঙ্ঘিত হচ্ছে নির্বাচনি আচরণবিধিও।
নির্বাচনি আচরণ বিধিমালায় বলা হয়েছে, মাইকের ব্যবহার করা যাবে দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত।
অথচ মঙ্গল ও বুধবার পরপর দুদিন ঢাকা-১৩ ও ঢাকা-১০ আসনের মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দিনব্যাপী উচ্চশব্দে মাইকিং ও নির্বাচনি গান বাজাতে শোনা গেছে।
এলাকাবাসী জানান, প্রচারকর্মীরা সকাল থেকে শুরু করে বেশ রাত পর্যন্ত মাইক ব্যবহার করছেন।
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় শেখেরটেক ১২ নম্বরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রচারণা ক্যাম্পে গিয়ে মাত্র একজন প্রচারকর্মীর দেখা মিলল। নির্ধারিত সময়ের আগেই উচ্চ শব্দে গান বাজানো হচ্ছিল সেখানে।
প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মী জানালেন, এটা যে আচরণবিধির লঙ্ঘন সেটিও তার জানা নেই।
সেখান থেকে বেরিয়ে আলাপ হলো এলাকাবাসী কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান, সকাল ১০টার পরেই শেখেরটেক ১ থেকে শুরু করে ১২ নম্বর রাস্তা, বিভিন্ন গলি এবং আদাবর এলাকায় নির্বাচনি প্রচারে সরগরম হয়ে ওঠে। এই এলাকায় রাত ১০টার পরে রিকশায় করে মাইকিং চলে।
একই দিন দুপুর ১২টার পরে আদাবর এলাকার কয়েকটি নির্বাচনি ক্যাম্প থেকে গান বাজাতে শোনা গেল। দুপুর ১টার মধ্যেই রিং রোড ও টাউন হল এলাকা নির্বাচনি প্রচারণায় জমজমাট হয়ে ওঠে। রিকশায় মাইক লাগিয়ে প্রচার করতে দেখা গেছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকেই মোহাম্মপুরের টোকিও স্কয়ারের সামনে বসানো হয়েছে বড় আকারের একটি মনিটর। মঙ্গল ও বুধবার দুদিনই সেখানে রাত সাড়ে ১০টার পরও প্রচারণার জন্য তৈরি নৌকার প্রার্থীর তথ্যচিত্র প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
ওই এলাকার লোকজন জানান, প্রচার শুরুর পর এটা এখন প্রতিদিনকার ঘটনা হয়ে পড়েছে। গাড়ির হর্ন এবং সেই সঙ্গে প্রচারণার শব্দ দূষণে এই সড়কে সাধারণের চলাচলই কষ্টদায়ক হয়ে উঠেছে।
আদাবর এলাকার এক বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারা দিনই থেমে থেমে চলে বিকট শব্দের গান ও মাইকিং। বাসাবাড়ির বাসিন্দারা শব্দ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে দিনের বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ রাখেন জানালা। তবে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন দোকানিরা।”
শেখেরটেক ১০ নম্বরের এক দোকানি বলেন, “তীব্র শব্দের মধ্যে লম্বা সময় দোকানে বসে থাকাই কঠিন।”
ওই দোকানির কাছে নাম জানতে চাইলে তিনি নাম জানাতে চাননি।
মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেখেরটেক, রিংরোড ও টাউনহল ঢাকা-১৩ আসনের অধীন।
সেখানকার কয়েকটি নির্বাচনি প্রচার ক্যাম্পের কর্মীদের কাছে আচরণবিধির লঙ্ঘন জানতে চাওয়া হলে তাদের প্রায় প্রত্যেকেই বললেন, নির্বাচনি প্রচারণায় মাইকিং, গান ও তথ্যচিত্রগুলোর প্রচার এক ধরনের আনন্দের আমেজ তৈরি করছে।
মাইক ও লাউডস্পিকার ব্যবহারে নির্বাচনি আচরণ বিধিমালা মানা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তারা জানান, এলাকা ভাগ করে দিনের দুই অংশে মাইকিং ও গান বাজানো হচ্ছে। অনেক এলাকায় সকাল থেকে বিকেল এবং অনেক এলাকায় বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত প্রচারণা চলে।
মোহাম্মদপুর থানা নির্বাচন অফিসার নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনি আচরণবিধি অমান্য করা হচ্ছে কিনা তা নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। কেউ আচরণ বিধি অমান্য করলে জরিমানা করা হচ্ছে।”
তবে সময় না মেনে মাইকিং ও লাউডস্পিকারে গান বাজানোর কারণে কাউকে জরিমানা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে এখনও আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।”
ঢাকা-১৩ আসনে নৌকার প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবীর নানকের পক্ষেই প্রচারণা বেশি। তবে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় অনেকটাই নির্ভার আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং এই আসন থেকেই আগে দুইবার নির্বাচিত এ সংসদ সদস্য। এরপরও প্রচারে কমতি রাখেননি তিনি।
মাইক বা সাউন্ড বক্সের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের পরেও প্রচারের বিষয়ে জানতে কয়েক দফা ফোন করলেও ধরেননি নানক।
তবে তার ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদুর রহমান বিপ্লব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “আমরা যে মাইকগুলো বাজাচ্ছি তা আচরণবিধিমালা মেনেই সময়মত চালু ও বন্ধ করা হচ্ছে। তবে কিছু অতি উৎসাহী কিছু মানুষ নিজেদের মতো করে মাইক বাজালে তা আমাদের জানার কথা নয়। নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আসলে আমরা ব্যবস্থা নেব।”
প্রায় একই চিত্র পাশের নির্বাচনি এলাকা ধানমন্ডিতেও। সেখানে সকালে শব্দ দূষণের চিত্র কিছুটা আলাদা, সাত সকালে এখানে মাইকিং শুরু হয় না। তবে আগের দিন মঙ্গলবার দেখা গেছে শেষ হয় রাত ১০টার পর।
বুধবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২ পর্যন্ত ধানমন্ডির এলাকার ২৭ নম্বর, ২৮ নম্বর, ৩২ নম্বর, সাত মসজিদ প্রধান সড়ক, ধানমন্ডি ১৫ নম্বর ও ১৯ নম্বরের বিভিন্ন গলি ঘুরে দেখা গেছে, প্রচারের জন্য মাইকিং শুরু হয়েছে দুপুর দেড়টার মধ্যে।
স্থানীয়রা অনেকেই অভিযোগ করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “সকালের দিকে খুব একটা প্রচার না হলেও গানবাজনা ও মাইকিং দুটিই চলে গভীর রাত পর্যন্ত। আর শব্দের মাত্রাও থাকে তীব্র।”
ঢাকা-১০ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ফেরদৌস আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর দিনই আমার সকল নেতাকর্মীদের বলেছি, প্রচারণা করতে গিয়ে যেন রাস্তায় জ্যাম না হয়। জনগণ যেন ভোগান্তি না পোহায়। সেটার ব্যাপারে সবাই যেন সজাগ থাকে। নিয়মের মধ্যে থেকেই আমরা প্রচারণা করছি।
“ভোটারদের কাছে গিয়ে ভোট চাইছি। এরপরও আপনি যেহেতু বলছেন, কোথাও কোথাও নির্ধারিত সময়ের পরও মাইক ব্যবহার করে গান বাজানো হচ্ছে। সেটা আমি খোঁজ নেব।”
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) সভাপতি ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় এবার নির্বাচনি প্রচারণায় শব্দ দূষণের মাত্রা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে আমরা এটি এখনও জরিপ করিনি।”
তিনি জানান, ২০২০ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে পরিবেশ দূষণ নিয়ে একটি জরিপ করেছিল ক্যাপস। সে সময়ে শব্দ দূষণ নিয়ে জরিপটি করা হয়েছিল রাজধানীর ২০টি এলাকায়। এর মধ্যে ১৪টি স্থানে ১২০ ডেসিবলের চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ পাওয়া গিয়েছিল।
ঢাকার রাস্তা-ফুটপাতে যেখানে সেখানে নির্বাচনি ক্যাম্প, তোরণ
প্রতীক বরাদ্দের আগেই পোস্টার-ব্যানারে ছেয়েছে ঢাকা
পোস্টারে প্লাস্টিকের আবরণ: যে নিষেধাজ্ঞা কেউ মানে না
সিটি নির্বাচনের তুলনায় সংসদ নির্বাচনে শব্দ দূষণ একটু কম হওয়ার কথা। তবে সেটাও মানুষের কানের সহ্য ক্ষমতার বেশি হয়ে থাকে।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় নির্বাচনি প্রচারণায় মাইক বা লাউডস্পিকার ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটি ঠিক হয়নি বলে মনে করেন পরিবেশবিজ্ঞানের এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, “প্রথমে আইনের সংশোধন দরকার। নির্বাচন কমিশনকেও বিষয়টি গুরত্বের সঙ্গে নিতে হবে। যদিও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে নির্বাচনি প্রচারে শব্দ দূষণের বিষয়টি মোটেও গুরুত্ব পায় না, অপরাধ করে কেউ সাজা পেয়েছে, এমনটা আমরা এখন পর্যন্ত শুনিনি।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের কনসালটেন্ট মোহসেনা খানম বলেন, “আমাদের কথা বলার সময় শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা থাকে ২৫ ডেসিবল। সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দের মাত্রা আমাদের কান সহ্য করতে পারে। সেক্ষেত্রে মাইক ও লাউড স্পিকারের শব্দের মাত্রা ১০০ ডেসিবলের বেশি। এই মাত্রা কানের মারাত্মক ক্ষতি করে। যাকে বলা হয় হিয়ারিং লস বা কানে শোনার ক্ষমতা হারানো। এ ধরনের ক্ষতি আর কোনোভাবেই সারানো সম্ভব হয় না।”