নির্বাচন কমিশন নিষেধাজ্ঞা দিয়েই খালাস। প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টারের কারণে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো খবর এখনও মেলেনি।
Published : 30 Dec 2023, 07:35 AM
ভোটের পোস্টারে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও শীতের মধ্যে শিশির থেকে বাঁচাতে সারা দেশেই নির্বাচনি পোস্টারে পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে।
আর নির্বাচন কমিশন নিষেধাজ্ঞা দিয়েই খালাস। প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টারের কারণে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো খবর এখনও মেলেনি।
প্লাস্টিক মোড়া এসব পোস্টার পরিবেশের ক্ষতি করছে। এসব পোস্টার নিষ্কাশন নালায় গেলে সমস্যা আরও প্রকট হবে। সে কারণে পোস্টার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আইনের আরও কঠোর প্রয়োগ চাইছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রায় সব প্রার্থীর পোস্টারই প্লাস্টিকে মোড়ানো। তবে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রার্থীর পোস্টারে প্লাস্টিকের ব্যবহার কম দেখা গেছে।
সেগুনবাগিচা এলাকায় ঢাকা-৮ আসনে নৌকার প্রার্থী আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের যেসব পোস্টার সাঁটানো হয়েছে, সেগুলো প্লাস্টিকে মোড়া। একই আসনে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী ডা. এসএম সরওয়ারের পোস্টারও প্লাস্টিকে মোড়ানো। সেগুনবাগিচা এলাকায় ঝুলতে দেখা গেছে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী এম এ ইউসুফের প্লাস্টিক মোড়ানো পোস্টার।
তেজগাঁওয়ের নাবিস্কো এলাকায় ঢাকা-১২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আসাদুজ্জামান খান কামালের যেসব পোস্টার দেখা গেছে, সেগুলোও প্লাস্টিকে মোড়ানো। তবে অনেক জায়গায় তার পোস্টারে প্লাস্টিক ব্যবহার হয়নি।
ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফেরদৌস আহমেদের নির্বাচনি পোস্টার ঝোলানো হয়েছে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে। ওই আসনে অন্যান্য প্রার্থীদের যে পোস্টার দেখা গেছে তারও বেশিরভাগ প্লাস্টিকে মোড়ানো।
কচুক্ষেত এলাকায় ঢাকা-১৫ আসনে জাসদের প্রার্থী মুহাম্মদ শামছুল ইসলামের মশাল প্রতীকের পোস্টার, জাতীয় পার্টির সামছুল হকের লাঙ্গল প্রতীকের পোস্টারগুলো লেমিনেট করা।
ঢাকা-১৭ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত আশওয়াদ ইসলামের প্রতীক বেলুন। এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে এ প্রার্থীর সব পোস্টার প্লাস্টিকে মোড়ানো।
আদাবরের বাসিন্দা কাজী মাহমুদুর রহমান বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তির এই যুগে নির্বাচনের প্রচারে পোস্টারের ব্যবহারই বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
“এসব পোস্টার মারাত্মক দৃষ্টিদূষণ করে। পাশাপাশি এসব পোস্টারের একটা অংশ ড্রেনেজ সিস্টেমে চলে যাবে, বৃষ্টির সময় এর কুফল আমরা পাব। আধুনিক এই যুগে এ ধরনের পোস্টারের কোনো দরকারই নেই। বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রার্থীরা সহজেই তাদের প্রচার চালাতে পারেন। সিটি করপোরেশন জায়গা নির্ধারণ করে দিতে পারে বিজ্ঞাপনের বোর্ডের জন্য। এখন যেভাবে চলছে সেটা স্মার্ট বাংলাদেশ না।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ফেরদৌস আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যেসব পোস্টার বানিয়েছি সেগুলোতে কোনো প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু আমার শুভানুধ্যায়ীদের কেউ কেউ পোস্টার করে দিয়েছেন, তারাই লেমিনেটেড পোস্টার বানিয়েছেন। কেউ কেউ তো রঙিন পোস্টারও করেছিল, পরে আমি সেগুলো সরিয়ে নিতে বলেছি।”
প্রতীক নিয়ে শুরু প্রচারযুদ্ধ: যা যা করতে মানা
প্লাস্টিকের আবরণে পোস্টার-লিফলেট নয়, নজরদারি বাড়াতে বিশেষ পরিপত্র
ঢাকা-৮ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাহাউদ্দিন নাছিমও দায় চাপিয়েছেন ‘অতি উৎসাহীদের’ ওপর; বলেছেন এসব কাজকর্মে তিনি ‘বিব্রত’।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে নাছিম বলেন, তিনি যে পোস্টার করেছেন, সেগুলো লেমিনেট করা হয়নি।
“আমি সব সময় আচরণবিধি মেনে চলার কথা বলি। কিন্তু অতি উৎসাহীরা ছবি দিয়ে এসব পোস্টার, ব্যানার বানিয়ে বিভিন্ন জায়গায় টানাচ্ছে। আমাকে খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। এখন ইলেকশন রেখে লোক নিয়োগ করতে হচ্ছে সেসব পোস্টার সরানোর জন্য।”
লেমিনেটেড পোস্টার ব্যবহারের প্রবণতা ঢাকার বাইরেও কম নয়।
রংপুর-১ আসনের চওড়ারহাট, বেনুঘাট, আমাশুকুকরুলসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী মসিউর রহমান রাঙ্গার ট্রাক, জাতীয় পার্টির আসিফ শাহরিয়ারের লাঙ্গল, স্বতন্ত্র প্রার্থী বাবলুর কেতলির যত পোস্টার আছে সবই লেমিনেট করা।
নরসিংদী-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন নজরুল ইসলাম হিরু। নির্বাচনি এলাকার মাধবদী ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় সব পোস্টারই লেমিনেটেড। একই অবস্থা স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলামের ঈগল প্রতীকের পোস্টারেও।
লেমিনেটিংয়ে ব্যস্ত কারখানাগুলো
ঢাকার আরামবাগ ও ফকিরাপুল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মুদ্রণ কারখানাগুলোয় বিভিন্ন প্রার্থীর পোস্টার ছাপানো হচ্ছে। ছাপানো পোস্টার আবার লেমিনেট করতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আরেকটি কারখানায়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই লাখ লাখ পোস্টার লেমিনেট করা হচ্ছে।
ইসলামিয়া স্পট লেমিনেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মচারীরা পোস্টার লেমিনেটিংয়ের কাজে ব্যস্ত।
ওই কারখানার মালিক অহিদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নির্বাচন আসার পর প্রতিদিনই কাজের চাপ যাচ্ছে। প্রতিটি পোস্টার লেমিনেট করতে ৩ টাকা করে নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত তিন লাখের বেশি পোস্টার লেমিনেট হয়েছে তার কারখানা থেকে।
“বিভিন্ন দলের প্রার্থীর পোস্টার আমরা লেমিনেট করছি, তবে নৌকার পোস্টারই বেশি। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, ঢাকা-১০, মুন্সিগঞ্জ-১, ঝালকাঠি, বরিশালসহ কয়েকটি জেলার বিভিন্ন আসনের প্রার্থীরা তাদের পোস্টার লেমিনেট করেছে আমার এখান থেকে।”
ওই প্রতিষ্ঠানে ঢাকা-১৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম তোফাজ্জল হোসেনের ট্রাক প্রতীকের পোস্টার লেমিনেট করা হচ্ছিল।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এস এম তোফাজ্জল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিশিরে ভিজে পোস্টার খুলে পড়ে যায় এজন্য লেমিনেট করা হয়েছে।
“পোস্টার লাগানোর দুয়েকদিন পরই সেগুলো ভিজে পড়ে যায়। এজন্যই লেমিনেট করা। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের বিধিনিষেধের বিষয়টি জানা নেই।”
পলিথিন দূষণ বাড়ার শঙ্কা
একটি পোস্টার লেমিনেট করতে কি পরিমাণ পলিথিন ব্যবহার হয় তার একটা ধারণা পাওয়া যায় ২০২০ সালের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় করা একটি গবেষণায়।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সে সময় প্রতিটি লেমিনেটেড পোস্টারে গড়ে ১৩ দশমিক ৪৭ গ্রাম প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছে।
ক্যাপস তাদের জরিপে দেখেছে, ২৩ ইঞ্চি বাই ১৮ ইঞ্চি আকারের একটি পোস্টার লেমিনেট করতে ৯ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৫ গ্রাম প্লাস্টিক ব্যবহার হয়।
ওই নির্বাচনের সময় ঢাকায় অন্তত ৫০ লাখ পোস্টার ছাপা হয়েছে ধরে নিয়ে ক্যাপস বলেছিল, সেসব পোস্টারে ৩৩ দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে।
ঢাকার আরামবাগ এবং ফকিরাপুল এলাকার লেমিনেশন কারখানার ব্যবসায়ীরাও পোস্টারে কি পরিমাণ পলিথিন ব্যবহার হয় তার একটি ধারণা দিয়েছেন।
অহিদুর রহমান বলেন, এক হাজার পোস্টারে প্লাস্টিক লেমিনেশন করতে সাড়ে সাত থেকে আট কেজি পলিথিন লাগে।একই তথ্য জানিয়েছেন বসুমতি লেমিনেশনের ব্যবস্থাপক মুসা আলী।
এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনে বিভিন্ন দলের ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। একজন প্রার্থী গড়ে ১০ হাজার পোস্টার ছাপালেও সারাদেশে প্রায় দুই কোটি পোস্টার ছাপানো হয়েছে।
এবারের নির্বাচনে কী পরিমাণ পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে জানতে চাইলে ক্যাপসের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার তারা বড় ধরনের কোনো গবেষণা করছেন না। তবে ঢাকার কয়েকটি এলাকায় ছোট পরিসরে জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, অন্তত ২৫ শতাংশ পোস্টার প্লাস্টিকে মোড়ানো।
“ঢাকায় মনে হয় প্লাস্টিকের ব্যবহার কমেছে। এটা হতে পারে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার পর প্রার্থীরা বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।”
কামরুল মজুমদার বলেন, এসব পলিথিনযুক্ত পোস্টার পলিথিন ব্যবহার পরিবেশ আইনে নিষিদ্ধ, এছাড়া নির্বাচন কমিশনের পরিপত্রেও এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তারপরও ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এসব পোস্টার ব্যবহারের কারণে প্রকৃতিতে তিন ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
“নির্বাচন শেষ হলে এসব পোস্টার নিচে ফেলে দেওয়া হবে। এগুলো সরাসরি নালা-নর্দমায় গিয়ে জলাবদ্ধতা তৈরি করবে। দ্বিতীয়ত, এগুলো মাটিতে মিশে গিয়ে জমির উর্বরতা নষ্ট করবে। তৃতীয়ত, অনেক সময় পোস্টারগুলো একত্র করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে মাটি, পানি, বাতাস দূষিত হয়।”
তিনি বলেন, পোস্টার পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে নির্বাচন কমিশনকে আরও কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচনের পর এসব পোস্টার প্রার্থীদের নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নিতে বাধ্য করতে হবে।
“কমিশন বলে দিতে পারে যারা পোস্টার টানিয়েছে তারা নির্বাচনের ২৪ ঘণ্টার পরে নিজ দায়িত্বে এগুলো সরিয়ে নিবে। এভাবে সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে।”
ইসি কী করছে?
ভোটের প্রচারে যত্রতত্র পোস্টার, ব্যানার, লিফলেটসহ নানা ধরনের প্রচার সামগ্রীতে প্লাস্টিক বা পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা নিতে গত সোমবার বিশেষ পরিপত্র জারি করে নির্বাচন কমিশন।
ওই পরিপত্রে বলা হয়, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে পরিবেশবান্ধব এবং একটি ‘সবুজ’ নির্বাচন করার লক্ষ্যে প্রার্থীগণ নির্বাচনি কার্যক্রমে বর্জ্য উৎপাদন কমানো নিরুৎসাহিতকরণ, প্রচারপত্রে প্লাস্টিকজাত Thermal Lamination film বা পলিথিনের আবরণ কিংবা প্লাস্টিক ব্যানার (পিভিসি ব্যানার) ব্যবহার বন্ধকরণসহ প্রচার কাজে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহার এবং প্রচার কাজে ব্যবহৃতব্য মাইকিংয়ে শব্দের মানমাত্রা ৬০ ডেসিবলের নিচে রাখতে হবে।”
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের আচরণবিধির বিষয়ে সতর্ক করতে নির্বাচনি এলাকায় নিয়োজিত ভিজিল্যান্স, অবজারভেশন ও মনিটরিং টিম এবং আইনশৃঙ্খলা সেলের সদস্যদের নিয়ে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিমদের যথাযথ নির্দেশনা দিতেও বলেছে ইসি।
তবে এখনও পর্যন্ত কোথাও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
ঢাকা-১০ আসনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা এখনও পর্যন্ত কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
“আমাদের কাছে কোনো প্রার্থী কোনো অভিযোগও দেয়নি। তবে বিষয়টি যেহেতু আপনি বলেছেন আমি কাল স্বপ্রণোদিত হয়ে দেখব। এরকম করে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”