বুদ্ধ হয়ে গেলেন ভারতীয় বিজ্ঞতার শীর্ষবিন্দু, স্বীকৃত হলেন গান্ধী থেকে নেহরু হয়ে সাভারকার থেকে আম্বেদকার সবার কাছে।
Published : 26 May 2024, 11:03 PM
মূল প্রবন্ধ: দেবদত্ত পট্টনায়েক
অনুবাদ: ইমন রায়
বুদ্ধের প্রতিকৃতি আধুনিক ঘর ও হেলথ স্পা-তে জনপ্রিয়। এটি শান্তি, প্রশান্তি এবং চাপ থেকে মুক্তি আহ্বান করে। যেসকল সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ খুব বেশি উদার নয় কিন্তু চিরকাল কৃতজ্ঞতার অবস্থায় থাকে, তারা এ ধরনের শিল্পকর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। তবে এর পাশাপাশি বুদ্ধের প্রতিকৃতি আরো অনেক বাস্তবতাকে আহ্বান করত।
এর সবটাই শুরু হয়েছিলো ঊনবিংশ শতকে যখন ইউরোপীয়রা বৌদ্ধ ধর্মকে পুনরাবিষ্কার করেছিলেন। তারা শ্রীলংকার বিভিন্ন পালি গ্রন্থের অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তারা এতেই উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন পূর্ব এশিয়া জুড়ে সন্ন্যাসীদের যে রহস্যময় বিশাল প্রতিকৃতি তারা খুঁজে পেয়েছিলেন, সেগুলো আসলে একই ব্যক্তির প্রতিকৃতি। এগুলো ছিলো গৌতম শাক্যমুনি নামক এক যুবরাজের কল্পমূর্তি। তিনি বেঁচেবর্তে ছিলেন ২৫০০ বছর আগে।
ইউরোপিয়ানরা একই সময়ে ভারতেরও ইতিহাস লিখে রাখছিলেন। তারা ইউরোপীয় ইতিহাসকে ভারতীয় ইতিহাসের একটি ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ইউরোপ যদি বহু-ঈশ্বরবাদ (রোমান সাম্রাজ্য) থেকে একেশ্বরবাদ (খ্রিস্ট ধর্ম) হয়ে যুক্তির বিপ্লব (প্রোটোস্ট্যান্টবাদ) থেকে বিজ্ঞানে যেতে পারে তাহলে তারা ভেবেছিলেন ভারত একই পথে রয়েছে। তাই বেদকে বহু-ঈশ্বরবাদী পর্যায়ের সাথে সমতুল্য করা হয়েছিলো। গীতাকে করা হয়েছিলো একেশ্বরবাদী পর্যায়ের সাথে। এর পরে রয়েছে অগ্নি উপাসনা, গো-উপাসনা ও মূর্তি পূজার আচার-অনুষ্ঠান যার অধোগতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন যৌক্তিক ও শান্ত বুদ্ধ। ভারতের এই বোঝাপড়া সবার কাছে আবেদন রেখেছিলো– বুদ্ধ হয়ে গেলেন ভারতীয় বিজ্ঞতার শীর্ষবিন্দু, স্বীকৃত হলেন গান্ধী থেকে নেহরু হয়ে সাভারকার থেকে আম্বেদকার সবার কাছে।
কিন্তু এখন আমরা উপলব্ধি করি যে, এটি বৌদ্ধ ধর্মের খুব সরল বোঝাপড়া। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য ও পূর্ব এশিয়াতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারের সাথে রাজনীতি ও অর্থনীতির অনেক সম্পর্ক রয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বিস্তার লাভ করার দরুণ বৌদ্ধ ধর্ম নাটকীয়ভাবে বিবর্তিতও হয়েছে। তিনটি জিনিস এতে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
স্তূপ, বলয় ও মহাকায়
সবচেয়ে পুরনো বৌদ্ধ স্থানগুলোতে বৃহদাকার দরজা ও রেলিং সহকারে স্তূপ দেখা যায়। অশোক ও কনিষ্কের মত মহান রাজারা এগুলো নির্মাণ করেছিলেন। স্তূপের কাছে একটি বিহার, একটি মঠ ছিলো যেখানে সন্ন্যাসীরা থাকতেন। এসকল আশ্রমের পৃষ্ঠপোষকতা রাজাদের মহত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করত। এসকল আশ্রম, বিশ্ববিদ্যালয় ও পাথর কেটে বানানো গুহা প্রায়শই ছিলো বাণিজ্যপথের মধ্যে, যা এসকল রাজার সুরক্ষাধীন ছিলো। তাই আমরা রাজার ক্ষমতার প্রতীক বজ্রপানি দ্বারা সুরক্ষিত বুদ্ধের প্রতিকৃতিগুলো খুঁজে পাই। এসব জায়গা থেকে লেখার উদ্ভব হয়েছিলো, যেখানে রাজারা বৌদ্ধ বিষয়াদির ওপর বিতর্ক ও আলোচনা করতে সন্ন্যাসীদের নিমন্ত্রণের কথা বলে। এগুলো বৃহৎ বৌদ্ধ পরিষদ নামে পরিচিত ছিলো। এটি বৌদ্ধ বিদ্যায়তন ও রাজার সুখ্যাতিতে মর্যাদা বৃদ্ধি করত।
তবে অষ্টম শতকে, আমরা বৌদ্ধ মূর্তিতত্ত্বে একটি নাটকীয় মোড় দেখতে পাই। পুরনো রাজারা প্রাথমিকভাবে ছিলেন পথশুল্ক কর আদায়কারী। কিন্তু নতুন রাজারা ভূমি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং আমরা এমনকি বুদ্ধের শিল্পকর্মে একটি সামন্ততান্ত্রিক ধারণার উত্থান দেখতে পাই। বিশেষত ভারতের পূর্বাঞ্চলে, তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের শক্ত ঘাঁটিতে, আমরা মাঝখানে উপবিষ্ট এক বুদ্ধের চিত্রকর্ম দেখতে পাই, যেখানে আরো অনেক বুদ্ধ তাঁকে ঘিরে রয়েছেন। তাঁরা চার দিকে মুখ করে রয়েছেন। তাই একজন জ্যেষ্ঠ বুদ্ধ ও একজন কনিষ্ঠ বুদ্ধ আছেন। জ্যেষ্ঠ বুদ্ধ তাঁর আপন রাজ্যে তাঁর আপন জগতে বাস করেন। তিনি কনিষ্ঠ বুদ্ধদের ওপর মাথা উঁচু করে রয়েছেন, যাদের নিজেদেরও জগত রয়েছে। এগুলো হলো বুদ্ধ ক্ষেত্র (এলাকা)। এই পাঁচ জন বুদ্ধের চারদিকে আরেকটি বলয়ে বোধিসত্ত্বগণ রয়েছেন। তাঁরা মানব জাতির সাথে জড়িত হয়ে দুঃখ দূর করতে সাহায্য করেন। বুদ্ধের এই বলয় ধর্মশাস্ত্রের রচনায় বর্ণিত রাজাদের বলয়ের (রাজ-মণ্ডল) অনুরূপ। আপনি রাজার রাজধানী শহর থেকে যত দূরে যাবেন, তত সম্পদ আহরণের প্রণালীগুলো স্থানান্তরিত হয় ভাড়ার উপার্জন থেকে করের উপার্জনে, সেখান থেকে সামন্ত প্রভুদের রাজস্বে, সেখান থেকে মিত্রদের দেওয়া উপঢৌকনের দিকে। এখানে, প্রশাসকদের পুরো বাস্তুতন্ত্র এক জন রাজার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পরিবর্তে আমরা বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্য পাই, যেগুলো রাজস্ব পরিশোধ করে একজন প্রতাপশালী কেন্দ্রীয় চক্রবর্তীর কাছে, যার ক্ষমতা বৃত্তাকার দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত।
তৃতীয় যে জিনিসটি দশম শতাব্দী থেকে উদ্ভূত হতে শুরু করেছিলো, সেটি হচ্ছে বিশাল বুদ্ধের প্রতিকৃতি। এগুলো বিশেষত মধ্য এশিয়াতে ও চীনে জনপ্রিয়। এখানে, আপনি এসব মহাকায় বুদ্ধকে দণ্ডায়মান কিংবা উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পান, বিশেষ করে বাণিজ্যপথের ওপর। এই হচ্ছে দিগন্তের ওপর আধিপত্য বিস্তারকারী ঈশ্বরের ধারণার বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত প্রধান বুদ্ধ, আদি বুদ্ধ। এই প্রতিকৃতিগুলো অনেক সময় একাত্ম করা হয় ভবিষ্যৎ বুদ্ধ, মৈত্রেয়র সাথে এবং অতীন্দ্রিয় বুদ্ধ, বৈরোচনের সাথে যিনি সমগ্র মহাবিশ্বে ব্যাপৃত। এটি চীনা সম্রাটের ধারণাকে নকল করে, যার প্রতি সকলেই বাধিত। তাং শাসনের পর কনফুশিয়ান এবং তাও-পন্থী সভাসদবৃন্দের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকে বশীভূত করার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ধর্ম মুখ্য পালন করেছে। অনেক টানাপোড়েনের পর বৌদ্ধ মঠগুলো চীনা কার্যপ্রণালীতে এক প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে উদ্ভূত হয়েছিলো। এসকল মঠ ব্যাংকিং চর্চা প্রবর্তন করেছিলো যা তখনকার চীনে অজ্ঞাত ছিলো এবং সম্ভবত কাগুজে মুদ্রার উত্থানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। চীনের আগে, ভারতীয় বাণিজ্যপথ ধরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ত্যাগের প্রতীক হিসেবে জনপ্রিয় হওয়া বুদ্ধ আদতে ছিলেন ২৫০০ বছরের অধিক সময়ের দীর্ঘ ইতিহাসে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক। যে সকল রাজা পথশুল্ক আদায় করতেন, যে সকল সামন্ত প্রভু রাজস্ব আদায় করতেন এবং যে সকল সম্রাট ভূমির ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে ভালোবাসতেন, তারা তাঁর প্রতিকৃতিকে সুনজরে দেখতেন। এ কারণে প্যাগোডায়, মণ্ডলে এবং সবশেষে বাণিজ্যপথের ওপর ছায়া হয়ে থাকা মহাকায় হিসেবে বুদ্ধকে দেখা যেত। বৌদ্ধ ধর্ম যেখানেই গিয়েছিলো, সেখানেই বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক গিয়েছিলো এবং মুদ্রার ব্যবহার বিস্তার লাভ করেছিলো। প্রদর্শনমূলক আধ্যাত্মিকতা সবসময় বস্তুগত প্রাচুর্যের নির্দেশক। ক্ষুধার্ত গরীবের কাছে ধনীরা তাদের সম্পদ হারানোর ভয় করে। আর তারা কৃতজ্ঞ থাকে যখন বুদ্ধ এটি নিয়ে তাদেরকে খুব বেশি মাথা ঘামাতে বিরত করেন।
(মূল লেখাটি ইকোনমিক টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিলো)