বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাসের বিবরণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই ইতিহাসের নির্মাতা। মানে নায়কের বয়ানে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি আমরা জানতে পারি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে।
Published : 23 Jun 2024, 12:45 AM
পাকিস্তানের জন্মকে আজানের ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে এই শুভ সময় তথা আজানের ধ্বনি মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। মাত্র ২২ মাস পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাঙালির ইতিহাসে তাৎপর্যময় একটি দিনে জন্ম লাভ করেন পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম বিরোধী দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরে সেই দলের নাম পরিবর্তন করে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস আর আওয়ামী লীগের ইতিহাস প্রায় সমার্থক। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেওয়া এই বিরোধী দলের হাত ধরেই ২৩ বছর পর পাকিস্তানের মানচিত্র ভেঙে জন্ম নেয় নতুন একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আর যিনি এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাসের বিবরণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই ইতিহাসের নির্মাতা। মানে নায়কের বয়ানে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি আমরা জানতে পারি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। পাকিস্তানের প্রথম কার্যকর কোনো বিরোধী দল হিসেবে সংগঠনটির কার্যক্রমের বিবরণও এতে পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাত ধরে। আরো স্পষ্ট করে বললে অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে। চল্লিশের দশকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ অভ্যন্তরীণভাবে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক ধারার নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। অন্য ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দীন। একদিকে মধ্যবিত্ত, অন্যদিকে অভিজাত-জমিদারি স্বার্থের দ্বন্দ্ব। নবাব পরিবার তথা অভিজাতদের মুখোমুখি দাঁড়ায় সাধারণ জনগণ। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ও দৈনিক আজাদ পত্রিকার স্বত্ত্বাধিকারী মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষক। মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় অবাঙালি নেতৃত্বের সমর্থন-সহানুভূতিও ছিল এদের প্রতি। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সাথে ছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত ও ছাত্র-তরুণদের নিয়ে গঠিত এক বিশাল কর্মীবাহিনী। যার নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরাই ছিলেন বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনের মূলশক্তি।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ‘১৯৪৭ সালে যে মুসলিম লীগকে লোকে পাগলের মত সমর্থন করছিল, সেই মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয়বরণ করতে হল কি জন্য?’ এর উত্তরও দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। লিখেছেন, “কোটারি, কুশাসন, জুলুম, অত্যাচার এবং অর্থনৈতিক কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করার ফলে।” পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষার সাথে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠির যে নীতি ও পরিকল্পনা তা খাপ খায়নি। বঙ্গবন্ধু লিখছেন, “ইংরেজ আমলের সেই বাঁধাধরা নিয়মে দেশ শাসন চলল। স্বাধীন দেশ, জনগণ নতুন কিছু আশা করেছিল, ইংরেজ চলে গেলে তাদের অনেক উন্নতি হবে এবং শোষণ থাকবে না। আজ দেখছে ঠিক তার উল্টা। জনগণের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছিল। এদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই আমাদের শাসকগোষ্ঠীর।”
পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। মুসলিম ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে কিংবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন শিষ্য হিসেবে যে স্বাধীন পাকিস্তানের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, বাস্তবতা ছিল তার বিপরীত।
লিখছেন তিনি, “আমি কয়েকদিন বাড়িতে ছিলাম। আব্বা খুবই দুঃখ পেয়েছেন। আমি আইন পড়ব না শুনে বললেন, যদি ঢাকায় না পড়তে চাও, তবে বিলাত যাও। সেখান থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি নিয়ে এস। যদি দরকার হয় আমি জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিব। আমি বললাম, এখন বিলাত গিয়ে কি হবে, অর্থ উপার্জন করতে আমি পারব না। আমার ভীষণ জেদ হয়েছে মুসলিম লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলাম, এখন দেখি তার উল্টা হয়েছে।”’
বঙ্গবন্ধু নিজেই উপলব্ধি করছেন এর একটি পরিবর্তন দরকার– “জনগণ আমাদের জানত এবং আমাদের কাছে আশা করত। স্বাধীন হয়েছে দেশ, তবু মানুষের দুঃখ দূর হবে না কেন “
পাশাপাশি নতুন রাষ্ট্রে শাসকদের নিপীড়ন, দুর্নীতি, বিনা বিচারে রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তার, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুকে বিক্ষুব্ধ করে। বিশেষ করে পাকিস্তান সরকারের রাজনৈতিক নিপীড়ন বঙ্গবন্ধুর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে।
শামসুল হক ফিরে আসার পরেই পুরানা লীগ কর্মীরা মিলে এক কর্মী সম্মেলন ডাকল ঢাকায়। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করা। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সে সভা আহ্বান করা হয়েছিল। নিজের সম্পৃক্ততাসহ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার কাহিনি বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেন আত্মজীবনীতে। “পুরানা লীগ কর্মীরা মিলে এক কর্মী সম্মেলন ডাকল ঢাকায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন সে সভা আহ্বান করা হয়েছিল...আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই...আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেওয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, ‘আর মুসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের...নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোনো কর্মপন্থাও নাই।’ আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।”’
এ সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে নিরাপত্তা বন্দী।”
অনেক রাজনৈতিক নেতাও যোগ দিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, খয়রাত হোসেন এম এল এ, বেগম আনোয়ারা খাতুন এম এল এ, আলী আহমেদ খান এম এল এ, আল্লামা রাগীব আহসান, হাবিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়া উল্লেখযোগ্য। সম্মেলনের প্রথম দিনেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে (জেলে বন্দি অবস্থায়) যুগ্ম-সম্পাদক ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
‘আওয়াম’ শব্দের অর্থ জনগণ, আর ‘লীগ’ মানে ঐক্য বা সম্মিলনী। অর্থাৎ সরকারি মুসলিম লীগের বিপরীতে জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা। দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সহ-সভাপতিরা ছিলেন আতাউর রহমান খান, আব্দুস সালাম খান, আলী আহম্মদ খান, আলী আমজাদ খান ও সাখাওয়াত হোসেন। নতুন এ দলের জন্য ৪০ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়।
কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে ২৩ জুন যে রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল সেটি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিতর্ক তৈরি হয়। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পূর্বেই তার নেতাকর্মীদের নিয়ে এর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। ২২ জুন খবরের কাগজ আজাদ লিখছে, “মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাহেবের দ্বারা আগামী ২৩ ও ২৪ জুন তারিখে ঢাকায় মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনের নামে যে সভা আহুত হইয়াছে তাহার সহিত মুসলিম লীগের কোনো সম্পর্ক নাই। বস্তুত ইহা দলগত স্বার্থ ও ক্ষমতালাভের জন্য মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টির দ্বারা মুসলমান সংহতি নষ্ট করিয়া পাকিস্তানের স্থায়িত্ব এবং অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে আহুত হইয়াছে।” মুসলীম লীগের বিরোধিতার পরেও আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই কর্মী সম্মেলনে প্রায় ৩০০ প্রতিনিধি যোগ দেন।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠে বুঝতে পারা যায়, ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেনির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে বঙ্গবন্ধুসহ অন্য ছাত্রনেতৃবৃন্দের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার এবং একই মাসে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করে ১৫০ নম্বর মোগলটুলী পার্টি হাউসের প্রগতিশীল লীগের কর্মীদের প্রধান সংগঠক শামসুল হকের বিজয় উভয় ঘটনা নতুন এ দল প্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্বিত করে।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে যে মুসলিম লীগ বঙ্গবন্ধুসহ পূর্ববঙ্গের অন্য নেতাদের কাছে এত আবেগের নাম ছিল সেটি ত্যাগ করে কেন নতুন একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম নিল। লিখেছেন তিনি, “১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগণের পর্ণকুটিরে যাঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শামসুল হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। একেই বলে কপাল, কারণ সেই পাকিস্তানের জেলেই শামসুল হক সাহেবকে পাগল হতে হল।”
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরাট প্রভেদ রয়েছে। সেখানে রাজনীতি করে সময় নষ্ট করার জন্য জমিদার, জায়গিরদার ও বড় বড় ব্যবসায়ীরা। আর পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতি করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত না থাকার জন্য জনগণ রাজনীতি সম্বন্ধে বা দেশ সম্বন্ধে কোনো চিন্তাও করে না। জমিদার বা জায়গিরদার অথবা তাদের পীর সাহেবরা যা বলেন, সাধারণ মানুষ তাই বিশ্বাস করে।”
অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ লিখেছেন, “১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মুক্তিলাভের পর থেকে ১৯৫৪ সালের মে মাসের শেষে পুনরায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারাগারের বাইরে ছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এটাই আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক বিস্তারকাল। আর এর প্রাণ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।”
আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখছেন, “আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানকে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে খবর দিলাম পূর্ব বাংলায় আসার জন্য। তিনি আমাকে পূর্বেই কথা দিয়েছিলেন এক মাস সমস্ত প্রদেশ ঘুরবেন এবং জনসভায় বক্তৃতা করবেন।” আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক জাগরণ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু লিখছেন, “এই সময় মুসলিম লীগ দলের মোকাবেলায় একমাত্র আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হিসেবে গড়ে উঠতে লাগল।” মুসলিম লীগ ও মুসলিম লীগ সরকার জনপ্রিয়তা দ্রুত হারিয়ে ফেলেছিল। বঙ্গবন্ধু লিখছেন, “আমি বুঝতে পারলাম, এখন শুধু সুষ্ঠু নেতৃত্ব ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। এই সুযোগ আমি ও আমার সহযোগীরা পুরোপুরি গ্রহণ করলাম এবং দেশের প্রায় শতকরা সত্তরটা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হলাম। যুবক কর্মীরা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ল। কারণ আমিও তখন যুবক ছিলাম।”
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। অমুসলিমরা ও এই দলে যোগ দেয়ার সুযোগ পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের সকল কাগজপত্রে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ব্যবহার করা হয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন এবং ১৯৫৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৫৩ সালে দলের প্রথম কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন বঙ্গবন্ধু। লিখেছেন, “আমরা ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র নিয়ে সমস্ত রাত আলোচনা করলাম সাবজেক্ট কমিটিতেও কাউন্সিল সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হল এবং নির্বাচনও সর্বসম্মতিক্রমে হয়ে গেল । মওলানা ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান সাহেব সহ-সভাপতি, আমি সাধারণ সম্পাদক (ম্যানিফেস্টো আমার কাছে এখন নাই, পরে তুলে দিব)। এখন আওয়ামী লীগ একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জনগণের সামনে দাঁড়াল। ম্যানিফেস্টো বা ঘোষণাপত্র না থাকলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।”
পূর্ববঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু অন্যদের সাথে মিলে গঠন করেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। যেটি পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়। চুয়ান্নের নির্বাচনের পরে বঙ্গবন্ধু হয়ে পড়ের এই দলের অবিচ্ছেদ্য অংশে। ছয় দফা দলে ভাঙ্গর তৈরি করে। একই সাথে আওয়ামী লীগের একক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর উত্থান ঘটে। বাংলার জনগণ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, আওয়ামী লীগ একই স্বপ্নে যাত্রা শুরু করে। যার প্রতিফলন দেখা গিযেছিল সত্তরের নির্বাচনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এই মিলিত রূপরেখার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।