মানুষের জীবনের ভ্রান্তি হলো অন্য প্রাণীদের জীবনের মূল্য উপেক্ষা করা। প্রকৃতিতে কেবল মানুষ থাকবে আর কেউ না। একেই বলে একীকরণ প্রক্রিয়া। একক অবস্থান। মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করার যোগ্যতা ক্রমশ হারাচ্ছে।
Published : 26 Jun 2024, 05:35 PM
চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব খবর প্রকাশিত হচ্ছে তার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আমাদের অতিচেনা সাপটি নিজের বাংলা নাম হারিয়ে মিডিয়ার কল্যাণে রাসেল’স ভাইপার বলে পরিচিত পেয়েছে। অনেকে এসব সংবাদ অর্ধসত্য, অসত্য বা অপতথ্য বলে মন্তব্য করছেন। অর্ধসত্যের ব্যাপারে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসের সাংবাদিক রালফ্ ফ্রেমেলিনো ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে একটি মজার কথা বলেছিলেন, তা হলো, ‘ইউ ক্যান নট বি হাফ প্রেগনেন্ট’। অর্থাৎ অর্ধসত্য বলে কিছু নেই। বিষয়টি হয় সত্য না হয় মিথ্যা। চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত তথ্যের সত্যতা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
কথা হলো, সত্যের তুলনায় অসত্য দৌড়ায় দ্রুতগতিতে। ফিলিপাইনের নোবেলজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রোসা তার গ্রন্থ ‘হাউ টু স্ট্যান্ড আপ টু এ ডিকটেটর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘সত্যের চেয়ে মিথ্যা দৌড়ায় ৬ গুণ দ্রুতগতিতে।’ চন্দ্রবোড়ার গতির চেয়ে তাদের নিয়ে খবর/অখবর দৌড়াচ্ছে বিদ্যুৎগতিতে।
চন্দ্রবোড়া সাপ ঘিরে ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছে। মিডিয়া সৃষ্ট ভয় কেবল মিডিয়াতে থাকে না, তা বাস্তবে নেমে আসে। যেমন, গতকাল রাজধানীর শ্যামলী ফুটওভার ব্রিজের নিচে তেলাপোকা ও ইঁদুর মারার বিষ বিক্রেতা হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা করছিলেন, এ বিষ ছিটালে ঘরে ‘রাসেল ভাইপার সাপও ঢুকবে না।’ মফস্বলের চন্দ্রবোড়া সাপ রাসেল (রাসেল’স) ভাইপার হয়ে ভার্চুয়ালি মহানগরে চলে এসেছে। মিডিয়া এভাবে দূরের ভয় কাছে টেনে আনছে। অপ্রয়োজনীয় বিষয় প্রয়োজনীয় করে তুলছে।
পাবলো নেরুদার স্মৃতিকথার প্রথম অধ্যায় ‘কাউন্টেজ বোজে’র শুরুর ৫১৬টি শব্দ জীবন বদলে দেওয়ার মতো। এ অংশে নেরুদা চিলির বন, উদ্ভিদ, পশু-পাখিদের বিবরণ তুলে ধরেছেন। এ অংশে প্রাণ-প্রকৃতি দেখা ও অনুভব করা কত গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে আলোচনা উঠে এসেছে। অতিনগণ্য ও ক্ষুদ্রের মধ্যেও কত অসাধারণত্ব থাকতে পারে তিনি তা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। এ অংশের কয়েকটি লাইন হলো:
“নীরবতা উদ্ভিদ জগতের আইন... এখানে কদাচিৎ দূরবর্তী প্রাণীদের কান্না শোনা যায়, লুকিয়ে থাকা পাখিদের কণ্ঠস্বরে কঠিন বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না ঝড়ো হাওয়ায় পৃথিবীর সবসংগীত স্তব্ধ না হয় ততক্ষণ বনের শাকসবজিগুলো নিচু গলায় তাদের সুরেলা কণ্ঠ ধরে রাখে। যিনি চিলির বনে যাননি তার পক্ষে পৃথিবীকে জানা সম্ভব নয়। পৃথিবীজুড়ে গাইবার জন্য আমি এ ধরনের ভূদৃশ্য, কাদা, নীরবতা আর ভ্রমণের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছি…’’
চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে মিডিয়া বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়া লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিউজ ফিল্টারিং/এডিটিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে সবাই রিপোর্টার, সবাই এডিটর। মিডিয়া এডুকেশন ছাড়াই সোশ্যাল মিডিয়া চলছে প্রবল দাপটে। অডিয়েন্সের মিডিয়া এডুকেশন কম থাকায় যে কোনো তথ্যই তারা প্রাথমিকভাবে সত্য বলে ধরে নেয়। তথ্যের উৎস, বস্তুনিষ্ঠতা ও মান নিয়ে প্রশ্ন করার সক্ষমতা বেশিরভাগের নেই।
চন্দ্রবোড়া সাপ বিষয়ে মিডিয়ার বোঝাপড়ার ও পেশাদারি মানের সংকট দেখা যাচ্ছে। বৈচিত্র্য দেখার ঘাটতিও কম নয়। মিডিয়া চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে ভয় ছড়াচ্ছে। এ কথা সত্য কেউ ভয় না পেলে ভয় দেখায় না। তবে কী মিডিয়া চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে ভয় পেল? হাতেগোণা কিছু ইতিবাচক লেখালেখি দেখা যাচ্ছে মিডিয়ায়, কিন্তু তা অপতথ্যের প্রবাহের তুলনায় নগণ্য।
এখানে মিডিয়া ভিউয়ের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যায় না। এর পেছনে রয়েছে অর্থ উপার্জন। কেবল জয়, অসংগতি, বিষমতা বা সেক্স বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়। চন্দ্রবোড়া সাপ প্রমাণ করছে ভয়ও বিক্রয়যোগ্য। ভয়ের আর্থিক মূল্যও কম নয়। এ সাপ কমবেশি সবাইকে তাড়া করে ফিরছে আর তা করছে মূলত প্রচারণার কারণে। কখন না ঘরের কোণে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। চন্দ্রবোড়া নিয়ে ট্রলও হচ্ছে। তরুণ নারী উদ্যোক্তা সাইমা সাদিয়া ইসলাম তার ফেইসবুক পেইজে লিখেছেন, “পাশেই রাসেল ভাইপার নিয়ে ঘুমাই আর লোকজন আসে ফেসবুক কাপাইতে।” পরে জানা যায় সাদিয়া ইসলামের স্বামীর নাম মেহবুব রাসেল।
ফ্যাক্টচেকারেরা জানাচ্ছেন চন্দ্রবোড়া সাপ নয় এমন অনেক সাপকে চন্দ্রবোড়া সাপ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। সাপ বিষয়ে পুরানো খবর নতুন মোড়কে চন্দ্রবোড়া সাপ বলে মুদ্রিত হচ্ছে। দৈনিক আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেকারেরা সম্প্রতি এরকম বেশ কয়েকটি খবর ছাপিয়েছেন।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতকতার একটি প্রধানতম প্রবণতা হলো ইস্যু খোঁজা। প্রতি সাত থেকে পনের দিনের মধ্যে নতুন ইস্যুর আর্বিভাব হয়। যেমন, কলকাতায় সংসদ সদস্য আনোয়ার আজীম হত্যাকাণ্ড, পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের দুর্নীতি খবরের পর ছাগলকাণ্ড তারপর হাজির হয়েছে চন্দ্রবোড়া সাপ।
প্রখ্যাত আমেরিকান সমাজ বিজ্ঞানীয় রবার্ট ই পার্ক তার প্রবন্ধ ‘নিউজ অ্যাজ এ ফর্ম অব নলেজ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো খবর। ইচ্ছেই হোক বা অনিচ্ছেই হোক মানুষকে খবর দেখতে, শুনতে ও জানতে হয়। ইস্যুভিত্তিক সংবেদনশীল, হাস্যরস, বস্তুনিষ্ঠহীন খবরগুলো হয়ে উঠছে জ্ঞানের বর্জ্য। এ ধরনের খবরের প্রবাহ জনস্মৃতিকে স্বল্পায়ু করে তুলছে। এখন এক সপ্তাহ আগের ঘটনা স্মরণ করা কঠিন হচ্ছে।
জনস্মৃতির ওপর ভিউনির্ভর খবরের যে অভিঘাত তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করা দরকার। ম্যাথিউ হুডক তার ‘পাবলিক মেমোরি’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, মেমোরি হলো সাবজেক্টিভ আর হিস্ট্রি হলো অবজেক্টটিভ। সাবজেক্টিভ মোমেরি পরিশীলিত হয়ে তৈরি হয় ইতিহাস। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস চর্চার প্রধানতম বাধা সাবজেক্টিভ মেমোরির দাপট। সাবজেক্টিভ মেমোরির মাঠ তৈরি করছে মিডিয়া। দর্শক-স্রোতাকে তাৎক্ষণিকতায় অবগাহন করতে বাধ্য করছে মিডিয়া। ফলে জাতীয় জনস্মৃতির আজ ভঙ্গুরদশা।
মানবাধিকারকর্মী জাহিদ হোসেন তার ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “প্রতিবছর সাপের কামড়ে যত মানুষ মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় মশার কামড়ে। পারলে সাপ না মেরে মশা মারুন। সাপ মশার চেয়ে অনেক উপকারী।”
চন্দ্রবোড়া সাপ মারার ব্যাপারে যত উন্মাদনা, যত পুরস্কার কিন্তু মশা মারার ব্যাপারে তেমন তৎপরতা নেই। সাপের ব্যাপারে মনোভঙ্গিগত সংকীর্ণতা রয়েছে বাঙালির। সাপ দেখলেই সে ভয় পায়। ইউলিয়াম এফ. ইভেনস তার ‘কমিউনিকেশন ইন দ্য এনিমেল ওয়ার্ল্ড’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সাপের শ্রবণ এবং দৃষ্টিশক্তি দুর্বল। সাপ সম্ভাব্য শক্রকে লেজ নাড়িয়ে ভয় দেখায়। আক্রান্ত না হলে বা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে সাধারণত কামড় দেয় না। কিন্তু মানুষের প্রতিরক্ষামূলক আক্রমণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিমাপযোগ্য। অথচ সাপের বিষ থেকে তৈরি হচ্ছে ৬টির মতো ওষুধ। প্রাকৃতিক চেইন সুরক্ষায় রাখছে বিশেষ ভূমিকা। সাপকে ঘিরে মিডিয়া একপাক্ষিক মিথ তৈরি করছে। ডেনিয়েল কোলম্যানের ‘ভাইটাল লাইজস, সিম্পল ট্রুথ দ্য সাইকোলজি অফ সেলফ ডিসেপশন’ গ্রন্থে মানুষের আত্ম-প্রবঞ্চনার এ ধরনগুলো দারুণভাবে তুলে ধরেছেন।
একটি নির্বিবাদী সাপ রাস্তা দিয়ে নীরবে চলার সময় মানুষের দৃষ্টিসীমার মধ্যে পড়লে তার নিস্তার নেই। প্রাণিকূলের প্রতি মানুষের নির্মমতার কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি। আহমদ শরীফ তার ‘‘ডায়রি ভাব-বুদ্বুদে’ লিখেছেন, ‘আমাদের ঘরে ঘরে প্রতিনিয়ত চলছে হত্যাকাণ্ড। আমরা মশা মারি, মাছি মারি, পিঁপড়ে মারি, ছারপোকা মারি আর মারি তোলাপোকা– ক্বচিৎ ইঁদুরও। আর খাদ্য হিসেবে পশুপাখি ও সবজি হিসেবে এবং ফল হিসেবে উদ্ভিদও মারি। কাজে হত্যা দিয়ে হনন দিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জাগ্রত মুহূর্তগুলো কাটে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে তিনি আরও লিখেছেন, ‘হত্যা অরণ্যের মাঝে/ হত্যা লোকালয়ে/ হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে/ কীটের গহ্বরে/ অগাধ সাগরে জলে/ নির্মল আকাশে/ হত্যা জীবিকার তরে/ হত্যা খেলাচ্ছলে/ হত্যা অকারণে/ হত্যা অনিচ্ছার ফলে।’ আহমদ শরীফের আহবান, ‘হত্যা এড়ানোর যুগান্তর আসন্ন, হত্যা কমানোর প্রয়াস আমাদের মানবিক দায়িত্ব।’
জনমনস্তত্ত্ব প্রাণ-প্রকৃতি-নিসর্গের ব্যাপারে হিংসা চরমে উঠেছে, যেখানে সংবেদের কোনো উপলক্ষ নেই। চারদিকে বিযুক্তি ও হননের তীব্র আকাঙ্ক্ষার লকলকে জিভ। এ নীচুতা কুরে কুরে খাচ্ছে পাবলিক সাইকিকে। সেখানে চন্দ্রবোড়া সাপ বাঁচে কী করে? বছর কয়েক আগে আমরা হাতি মেরেছি, বানর মেরেছি। মানুষের জীবনের ভ্রান্তি হলো অন্য প্রাণীদের জীবনের মূল্য উপেক্ষা করা। প্রকৃতিতে কেবল মানুষ থাকবে আর কেউ না। একেই বলে একীকরণ প্রক্রিয়া। একক অবস্থান। মানুষ প্রাকৃতিক পরিবেশে বাস করার যোগ্যতা ক্রমশ হারাচ্ছে।
এ থেকে উত্তরণে পরার্থবোধ বা অন্যের জন্য কল্যাণবোধের জাগৃতি জরুরি। প্রতিটি প্রাণ অমূল্য। তা কাড়ার অধিকার কারও নেই। একটি বৈচিত্র্যময়, সহাবস্থানমূলক নিরাপদ বলয় গড়ে তুলতে হবে। চন্দ্রবোড়াসহ সকল কীটপতঙ্গ, প্রাণ-প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। আর মিডিয়া পারে বৈচিত্র্যের মর্মবাণী তুলে ধরতে।
আর চন্দ্রবোড়া সাপ হত্যা নয়, আর অপতথ্য নয়। সংযত হই, অবগত হই, সচেতন থাকি। চন্দ্রবোড়াও বাঁচুক, আমরাও বাঁচি।