ভারত তার ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য বিনিয়োগে অনাগ্রহ না দেখালেও বাস্তবে ধীর গতিতে এগুচ্ছে। ভুটান ও নেপাল ভারতের এই ধীর গতির কারণে বাংলাদেশে তাদের বিদ্যুৎ, পাথর ও ফলমূল রপ্তানি বাড়াতে পারছে না।
Published : 24 Jun 2024, 08:36 PM
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও কয়েকটি চুক্তি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার প্রতিপাদ্য হলো বাংলাদেশ কি পেল আর কি পায়নি তা নয়; বরং বলা চলে কি পায়নি তাই মুখ্য।
তার মধ্যে তিস্তা নদীর প্রসঙ্গ অন্যতম। এর বাইরে বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে ভারতের সাত রাজ্যের যোগাযোগ। জল ও স্থলভাগের মাধ্যমে এই যোগাযোগে ভারতের লাভের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের লাভের বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান নয়। তবে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ ভারতকে এই যোগাযোগ সুবিধা দেওয়াটা অব্যাহত রেখেছে। এটার পক্ষে যুক্তি হলো মুক্তবাজার বিশ্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বাংলাদেশ তাই ভারতকে মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। নদী পথের সুযোগও প্রশস্ত করেছে। বলা চলে, ভারত এখন তার সাত রাজের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারবে। বাংলাদেশের চোখ শুধু এই সাত রাজ্য নয়, ভুটান ও নেপাল পর্যন্ত। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। নেপাল ও ভুটানের প্রতি বাংলাদেশের আগ্রহ বাস্তবায়নে মাঝখানে চোখের বালি হলো ভারত। ভারত তার ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানকে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য বিনিয়োগে অনাগ্রহ না দেখালেও বাস্তবে ধীর গতিতে এগুচ্ছে। ভুটান ও নেপাল ভারতের এই ধীর গতির কারণে বাংলাদেশে তাদের বিদ্যুৎ, পাথর ও ফলমূল রপ্তানি বাড়াতে পারছে না। বাংলাদেশও লাভের জায়গাটা বাড়াতে পারছে না। ফলে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ভারত বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধ থাকছে।
বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য যে পরিমাণে বাড়ছে বা বাণিজ্য-ঘাটতি বাড়ছে তা বাংলাদেশ ভারতকে এই যোগাযোগ সুবিধা দিয়েও পুষিয়ে আনতে পারছে না।
তা-ও বলা চলে, ভারত বাংলাদেশের শুধু প্রতিবেশী নয়, বন্ধুও বটে। ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে লম্বা সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু বাংলাদেশ ভারতভূমি দ্বারা আবদ্ধ নয়। এটাই বাংলাদেশের ভৌগোলিক সুবিধা বা স্বাধীনতা। ইতিহাসে দেখা যায় নদী-সমুদ্র থাকার কারণে বাংলাদেশ যেমন পদানত হয়েছে তেমনি বিদ্রোহ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। যেমন, বার ভুঁইয়া। আর এটাই বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা। ভারত বাংলাদেশের এই সুবিধা পুরোটা নিতে চাইলে তাকেও অনেক কিছু ছাড়তে হবে, আর সেটা হলো সাত রাজ্যের সঙ্গে নেপাল-ভুটানে বাংলাদেশের অবাধ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুবিধা। এখানে লাভের হিসাব সমান সমান হওয়া দরকার। বিভিন্ন হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশ তাতে পিছিয়ে আছে। এই পিছিয়ে থাকার জন্য বাংলাদেশের সক্ষমতার অভাব কতটুকু তা বিবেচনায় নিয়েও বলা যায়, এই ঘাটতি একটা মনোগত সমস্যাও তৈরি করে।
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের সালতামামি করলে এই মনোগত সমস্যার বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে। ব্রিটিশ ভারতের সময় বাংলাদেশ তথা পূর্ব বঙ্গের সঙ্গে কলকাতার একটা জমিদার-প্রজা সম্পর্ক ছিল। মোগল আমলে বাংলা সবসময় দিল্লির বিরুদ্ধে ছিল। ভারত ভাগ তথা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার সময় পূর্ববঙ্গ ভারত-বিরোধী শিবিরে ছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক ছিল। আর পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের জয় হয়েছিল। এই জয়ের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও মনোজগৎ অবিশ্বাসের জায়গায় ভর করে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তার রাজনীতি ছিল চরম সাম্প্রদায়িক এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সহিংসতায় ভরা। বাঙালির জাতীয়তাবাদী বিকাশ, স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ এই বৈরিতা হিংসা ও অবিশ্বাসকে সাময়িক দূরে ঠেলে দিলেও মনোরাজনৈতিক জগতে তার রেশ থেকে গিয়েছিল যার বহিঃপ্রকাশ স্বাধীনতার পরপরই ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারত অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল। সেই সমর্থন বাংলাদেশের জন্মকে সহজ করেছিল। সেই ইতিহাস ধরে নিচ্ছি সবার জানা। কিন্তু জানা জিনিসও ঝালাই করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে যে ভারতবিরোধিতা প্রায় শূন্যের কোটায় এসেছিল বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, তা আবার জেগে ওঠে ১৯৭২ সালের ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি তথা ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর। পঁচিশ বছরের এই চুক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধিতাকে আবার সামনে নিয়ে আসে। এই চুক্তিতে ছিল–
১. চুক্তিকারী পক্ষগুলো দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে, দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব থাকবে এবং প্রতিটি পক্ষ একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করবে এবং অপর পক্ষের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে;
২. চুক্তিকারী পক্ষগুলো সমস্ত ধরণের ঔপনিবেশিকতা এবং বর্ণবাদের নিন্দা করে এবং তাদের চূড়ান্ত এবং সম্পূর্ণ নির্মূলের জন্য প্রচেষ্টা করার জন্য তাদের সংকল্প পুনর্নিশ্চিত করে;
৩. চুক্তিকারী পক্ষগুলো বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে জোট নিরপেক্ষতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে তাদের বিশ্বাস পুনঃনিশ্চিত করে;
৪. চুক্তিকারী পক্ষগুলো উভয় রাষ্ট্রের স্বার্থকে প্রভাবিত করে এমন প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলোর বিষয়ে একে অপরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং মত বিনিময় করবে;
৫. চুক্তিকারী পক্ষগুলো অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে তাদের পারস্পরিক সুবিধাজনক এবং সর্বাত্মক সহযোগিতাকে শক্তিশালী ও প্রসারিত করতে থাকবে এবং বাণিজ্য, পরিবহন এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকাশ ঘটাবে। সমতা এবং পারস্পরিক সুবিধার নীতি;
৬. চুক্তিকারী পক্ষগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকা উন্নয়ন এবং জলবিদ্যুৎ শক্তি এবং সেচের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা করতে এবং যৌথ পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়;
৭. উভয় পক্ষ শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা এবং স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়ন করবে;
৮. দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বের বন্ধন অনুসারে, চুক্তিকারী পক্ষের প্রত্যেকটি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে তারা অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনো সামরিক জোটে প্রবেশ করবে না বা অংশগ্রহণ করবে না। প্রতিটি পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে কোনো আগ্রাসন থেকে বিরত থাকবে এবং অন্য চুক্তিকারী পক্ষের নিরাপত্তার জন্য সামরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে বা অব্যাহতভাবে হুমকির মুখে পড়তে পারে এমন কোনো কাজ করার জন্য তাদের ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি দেবে না;
৯. চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর প্রত্যেকটি অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে অংশ নেওয়া তৃতীয় পক্ষকে কোনো সহায়তা দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। যদি উভয় পক্ষ আক্রমণ করা হয় বা আক্রমণের হুমকি দেওয়া হয়, চুক্তিকারী পক্ষগুলো অবিলম্বে হুমকি দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পারস্পরিক পরামর্শে প্রবেশ করবে এবং এইভাবে তাদের দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে;
১০. প্রতিটি পক্ষ গম্ভীরভাবে ঘোষণা করে যে তারা বর্তমান চুক্তির সঙ্গে বেমানান হতে পারে এমন এক বা একাধিক রাষ্ট্রের প্রতি গোপন বা প্রকাশ্য কোনো প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবে না;
১১. বর্তমান চুক্তিটি পঁচিশ বছরের মেয়াদের জন্য স্বাক্ষরিত, এবং পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে নবায়ন করা হবে;
১২. চুক্তির যেকোন ধারার ব্যাখ্যায় যে কোন মতপার্থক্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার মনোভাবের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হবে।
এই চুক্তি শান্তি ও মৈত্রীর কথা বললেও তা সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। আর এই সমালোচনার আড়ালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীরা সামনে চলে আসে।
পঁচিশ বছর পর এই চুক্তি কেউ নবায়ন করেনি। তাই দেখা যায়, ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের শক্তি হল মুক্তিযুদ্ধ।
আর দুর্বলতা হল ভারতের প্রতি একটা অবিশ্বাস। এই অবিশ্বাস অমূলক নয়।
বঙ্গবন্ধুর প্রবল জনপ্রিয়তার কালেও সন্দেহটা জনমনে ঢুকিয়ে দেওয়া গিয়েছিল। কারণ মনোজগৎ।
ভারত সবসময় তার প্রতিবেশীকে মূল্যায়ন করেছে তার নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের কথাকে কেন্দ্র করে। এখন নয়া উদার বাজার ব্যবস্থার কারণে সব দেশই নতুন নতুন বাজার খুঁজে। ভারত বা বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্কও সবসময় সরল ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে দুদেশই পরস্পরকে খেলিয়েছে। এখন রোহিঙ্গা সমস্যা চলমান, সামনে আসছে, কুকি-চিন সমস্যা।
তবে ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন আর খুব সহজ হবেও না। উভয়কে বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতার সাথে নিজ নিজ স্বার্থকে ঠিক রেখে এগুতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ এখন ভূ-রাজনীতির আবর্তে আছে। এই আবর্তে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে চীন একটা অস্বস্তি হিসাবে বিকশিত হয়েছে। চীন বাংলাদেশ সম্পর্ক যত বিকশিত হবে ভারত তত অস্বস্তিতে ভুগবে। আর এটা সামনের দিনে আরও বাড়বে।
একথা তাই বলা চলে, ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন আর দ্বিপাক্ষিক নয়, বহুপাক্ষিক।
ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিত্তিকে বা শক্তিকে এখন আর শুধু মুক্তিযুদ্ধের আবর্তে না রেখে তাকে বহুপাক্ষিক এবং বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে, এটাই হবে শক্তি আর নচেৎ, এটাই হবে একিলি'স হিল, বা লুকায়িত দুর্বলতা।
সময়ের পরিবর্তনকে প্রেক্ষাপটে রেখে না এগুলে উইন-উইন পরিবেশ তৈরি হবে না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উইন-উইন হোক।