প্রস্তাবিত বাজেটে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ সংশোধনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হলেও বোঝা যেত– অন্যদের দিকে আঙুল তোলার সময় নিজেদের নৈতিক জায়গাটি মেরামতের একটা বিলম্বিত চেষ্টা অন্তত তাদের দিক থেকে রয়েছে!
Published : 27 Jun 2024, 07:07 PM
বাজেট অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে সংসদ সদস্যরা কী বলছেন, সেদিকে দৃষ্টি রেখে নিবন্ধটি লিখতে শুরু করলাম। গত সাতদিনের সংবাদপত্র রয়েছে সামনে। সব সংসদ সদস্যের বক্তব্য তো আর মিডিয়ায় আসে না; এলেও গুরুত্বসহ আসে না। কেউ আকর্ষণীয় বক্তব্য রাখলে তবেই সেটা খবর হয়ে ওঠে। তেমন কোনো কোনো বক্তব্য প্রভাবশালী সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায়ও স্থান পায়। যেমন, ২৭ জুন তেমন একটি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ভাঁজের উপরে সংসদে রাখা এ বক্তব্য শিরোনাম হয়েছে– ‘স্বীকার করতেই হবে দেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে’! সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্যই এমন বক্তব্য রেখেছেন।
সংসদে যারা বিরোধী দল হিসেবে আছেন, তারা কতখানি বিরোধী– সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাজেট অধিবেশনে তাদেরও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর বক্তব্য রাখতে দেখা যাচ্ছে। যেমন, বিরোধীদলীয় উপনেতা সম্প্রতি সামনে আসা গুরুতর কিছু দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না’। সরকারদলীয় সদস্যরাও বড় বড় দুর্নীতির খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখছেন। তারা অবশ্য প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি নিয়েই সোচ্চার। এ আক্ষেপও তাদের কণ্ঠে ঝরে পড়ছে যে, দুর্নীতির জন্য রাজনীতিকদেরই বেশি দায়ী করা হয়! প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নয়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে আইনগত বাধা যে আছে, সে বিষয়েও জোরালো বক্তব্য রেখেছেন খোদ সরকারদলীয় একাধিক সদস্য। বিরোধীদলীয় উপনেতা তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েই যেন বললেন, চাকরির শুরুতে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়ার বিধান করতে হবে। পাঁচ বছর পরপর কিংবা পদোন্নতি এবং চাকরি থেকে অবসরের মুহূর্তেও তাদের সম্পদের তথ্য জমা দেওয়ার দাবি উঠেছে সংসদে।
এসব বক্তব্য সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির প্রকাশ কিনা, সে বিষয়ে মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি অবশ্য। অর্থপাচারসহ দুর্নীতিতে সরকারি কর্মচারীদের একাংশই এগিয়ে রয়েছে, এমন ধারণার কথা একজন প্রয়াত অর্থমন্ত্রীও কিন্তু বলেছিলেন সংসদে দাঁড়িয়ে। তাতে পরিস্থিতির যে কোনো উন্নতি হয়নি– সম্প্রতি বেরিয়ে আসা কিছু গুরুতর দুর্নীতির খবরেও তার কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। বাজেট অধিবেশনে রাখা বক্তব্যে একজন প্রবীণ বাম নেতা এমনটাও বললেন, দুর্নীতির এসব খবর হিমশৈলের চূড়া মাত্র। এর ধাক্কায় দেশের ‘উন্নয়ন-অগ্রগতির সলিলসমাধি’ হতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে জাপা চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা তাদের কার্যালয়ে রাখা বক্তব্যে বলেছেন, রাজনীতিকদের হাতেই দেশের ‘স্টিয়ারিং হুইল’। তারাই ‘দুর্নীতিকে সহায়তা করেছেন’ বলে মনে করেন তিনি।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনায় দেখা যাচ্ছে দুর্নীতির বিষয়েই কথাবার্তা হচ্ছে বেশি এবং এতে দোষের কিছু নেই। প্রশাসনসহ দেশের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি তো অবশ্যই বড় সমস্যা। তবে একমাত্র বড় সমস্যা নয়। অদক্ষতার সমস্যাও বিরাট। দুর্নীতি আর অদক্ষতা মিলেমিশে আমাদের অগ্রগতির পথে কঠিন অন্তরায়ও সৃষ্টি করেছে। তবে দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে আমরা অনেক সময় অদক্ষতার উল্লেখও করি না। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে এডিপির ৫৮ শতাংশও বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। এর কারণ প্রধানত অদক্ষতা। এডিপি বাস্তবায়নে দুর্নীতি নেই, তা সরকারের অতি বড় সমর্থকও বলবে না। তবে এর অর্থ ব্যয়ে অদক্ষতা ও অক্ষমতার কথাটাই বেশি বলতে হবে। বরাদ্দ কম বলে আলোচিত খাত থেকেও অর্থ ফেরত যাওয়ার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। সে কারণে আবার পরবর্তী অর্থবছরে এর বরাদ্দ আনুপাতিকভাবে কমিয়ে দেওয়াটাও দেখতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার নাকি করতে পেরেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ গ্রাহকদের অভিযোগ কিন্তু কমছে না। প্রায় ‘নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ’ যারা পাচ্ছে, তাদেরও অভিযোগ এর বাড়তে থাকা দাম নিয়ে। এদিকে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারীরা ঈদের ছুটিতেও লোডশেডিংয়ে ভুগেছে। আর এ খবর চলে এসেছে ফেসবুকে! বাজেট অধিবেশনে এসব নিয়ে আলোচনা কিন্তু কম। বিদ্যুৎ খাতে বিপুল অতিরিক্ত ক্যাপাসিটি তৈরি করে এর চার্জ জুগিয়ে গেলেও সরকার কেন যথেষ্ট বিদ্যুৎ জোগাতে পারছে না, তা নিয়ে শুধু বেসরকারি গবেষণা সংস্থাই কেন কথা বলবে?
আর এডিপির অতি নিম্ন বাস্তবায়ন নিয়ে কেন শুধু অর্থনীতিবিদরা বক্তব্য রাখবেন? এর বাস্তবায়ন তো দেখা যাচ্ছে করোনাকালীন পরিস্থিতির মধ্যে চলে গেছে। এটা কি সংসদীয় কমিটিগুলোরও খতিয়ে দেখা উচিত না? যেসব মন্ত্রণালয় এডিপির অর্থ ব্যয়ে একেবারে পিছিয়ে, তাদের বিষয়ে তো রীতিমতো তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সরকার অবশ্য আছে নজিরবিহীন অর্থসংকটে। রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি খারাপ। বিদেশি ঋণও প্রত্যাশামতো মিলছে না। ব্যাংক খাতের বাইরে– যেমন, সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ আহরণ হচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে আরও বেশি ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। তাতে বেসরকারি খাত আবার ঋণবঞ্চিত হতে পারে এবং এতে বিনিয়োগ কমে গিয়ে ঘটতে পারে কর্মসংস্থান পরিস্থিতির আরও অবনতি। এ নিয়ে অবশ্য একজন স্বতন্ত্র সদস্যকে উদ্বেগ জানাতে দেখা গেল সংসদে। তিনি আবার ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে বেশি পরিচিত এবং সে কারণেই হয়তো বিষয়টি সামনে এনেছেন। সরকার ও প্রশাসন পরিচালনার ব্যয় কমিয়ে আনার মতো বিষয়েও বলতে দেখা গেল তাকে। অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কমিয়ে এনে খরচ কমানো যায় কিনা, এ প্রশ্নও তিনি তুলেছেন। অনুন্নয়ন ব্যয় তো অবশ্যই কমানো দরকার। বাড়ানো বরং প্রয়োজন উন্নয়ন ব্যয়। কিন্তু বেশ ক’বছর এর উল্টোটাই ঘটে চলেছে। আর সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে এডিপির দুর্বল থেকে অতি দুর্বল বাস্তবায়নে। এ অবস্থায় সংসদে একথা তো জোরালোভাবে আসা প্রয়োজন যে, অর্থবছরের ১১ মাসে যখন এর ৫৮ শতাংশও ব্যয় করা যায়নি– সে অবস্থায় আর মাত্র এক মাসে তড়িঘড়ি করে বাকি অর্থ ব্যয়ের নামে অপচয় করা উচিত নয়। শেষ মাসটিও অবশ্য শেষ হতে চলেছে। এর মধ্যে ভেতরে ভেতরে এডিপির বাকি অংশ বাস্তবায়নের নামে কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় হয়ে গেল কিনা, সেটাই বা কারা বিচার করে দেখবে?
এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, একাধিক অবসরপ্রাপ্ত বাহিনী প্রধান ও এনবিআরের এক কর্মকর্তার অঢেল অর্থসম্পদের বিষয় সামনে না এলে সংসদে দুর্নীতি নিয়ে এত কথাবার্তা হতো না। বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য রাখার সুযোগে সংসদ সদস্যরা তো গতানুগতিক কিছু কথাই বলে থাকেন, যাতে মূলত থাকে স্তুতি আর নিজ এলাকার ‘উন্নয়ন’ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা। বাজেটের কাঠামো, এর বরাদ্দ, কর প্রস্তাব, পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় একে মূল্যায়নের চেষ্টা বলতে গেলে কখনোই দেখা যায় না। সব সংসদ সদস্য যে বাজেটের সব বিষয়ে আলোচনার ক্ষমতা রাখবেন, এমন প্রত্যাশা অবশ্য অসঙ্গত। তবে তাদের ১০ শতাংশও যদি প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর প্রস্তুতি নিয়ে এসে আলোচনা করতেন, তাতে একটা অগ্রগতি হতো। আজকাল তো বাজেটের অনেক বিষয় আগেভাগেই জানা যায়। এমনকি মিডিয়ায় চলে আসে এর বিশেষ দিকগুলো। সুতরাং বাজেট পেশের আগেও সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংসদীয় রীতিনীতি এক্ষেত্রে কোনো বাধা হলে সেটাও দূর করা যেতে পারে। বাজেট প্রণয়নের মতো কাজটি কেন ‘আমলানির্ভর’ হয়ে থাকবে, সে প্রশ্নও তো সংসদ সদস্যদের তোলা উচিত। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনেক বাড়ানোর পরও তারা কেন দুর্নীতিগ্রস্ত থাকবে– কেবল এ প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়াই কি যথেষ্ট? বাজেট প্রণয়নসহ সরকারের প্রায় সব ক্ষেত্রে আমলারা কেন এত প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন, এ প্রশ্ন বরং তুলতে হবে। অনেকে অবশ্য মনে করেন, এমন আলোচনা ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের জন্য অসুবিধাজনক। সে কারণেই হয়তো বিক্ষিপ্ত কথাবার্তা হচ্ছে বেশি!
এবারের বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছে, তাতে বড়রকম অসঙ্গতির বিষয়টি শুরু থেকে আলোচনায় এলেও সংসদে কিন্তু এ নিয়ে কথাবার্তা নেই বললেই চলে। টাকা সাদা করার বিষয়ে আনা প্রস্তাবটিই কেবল বেশি করে তাদের আলোচনায় এসেছে। এটি তো নতুন কোনো বিষয় নয়। অনেকবারই টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে; যদিও এতে সাড়া মিলেছে কম। তবে এবারই প্রথম ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানকেও সুযোগটি দেওয়া হলো আর বলা হলো, এক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ তাদের কোনোরকম প্রশ্ন করবে না। এমন সুযোগ রাখার পক্ষেও অবশ্য বক্তব্য রাখতে দেখা গেল কোনো কোনো সংসদ সদস্যকে। শেষ মুহূর্তে অবশ্য দেখতে হবে, বিতর্কিত এ সুযোগটি বহাল রাখা হয় কিনা।
সরকার যেসব সংকট কঠিনভাবে মোকাবিলা করছে; যেমন, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে কোনো জোরালো বক্তব্য কি রাখলেন কেউ সংসদে? এটা সরকারের জন্য স্পর্শকাতর ইস্যু অবশ্য। কিন্তু ‘নিট রিজার্ভ’ ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে তুলতে না পারলে সেটা কিন্তু অজানা থাকবে না। এদিকে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি সম্পর্কে সংসদ সদস্যসহ সর্বস্তরের জনপ্রতিনিধিই অবগত। এ নিয়ে সংসদে অবশ্য তারা কিছু কথা বলেছেন। কিন্তু একই সংকটে থাকা সমধর্মী অন্যান্য দেশ পারলেও বাংলাদেশ কেন মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে না, এ প্রশ্ন তুললে কি তাদের সমস্যা হবে? সরকার সমর্থকদের মধ্যে যারা স্বল্পআয়ের, তারাও কিন্তু মূল্যস্ফীতির আগুনে পুড়ছে। এ অবস্থায় বাজেটে এটা কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছে, সেটা কি বাস্তবসম্মত? বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা? রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা? এডিপির আকার? যারা বলছিলেন, নতুন এডিপি আরও ৫০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ধার্য করা যেত, তাদের বক্তব্য যে ভুল নয়– এর স্বীকৃতি কিন্তু মিললো ১১ মাসেও এডিপির ৫৮ শতাংশেরও বাস্তবায়ন না হওয়ার ঘটনায়।
সংসদে বলার সুযোগ আছে বলে শুধু আমলাদের দায়ী করলেই তো চলবে না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবে এনবিআরের ওপর বর্ধিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দিচ্ছে, সেটা কি গ্রহণযোগ্য? অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে আসার সময় রাজস্ব আহরণ বাড়ানো তো সহজ নয়। সেক্ষেত্রে সার্বিকভাবে ব্যয় সংকোচনে গিয়ে বরং সামাল দিতে হয় পরিস্থিতি। আর কাজটা শুরু করতে হয় ঘর থেকে। প্রস্তাবিত বাজেটে সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ সংশোধনের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হলেও বোঝা যেত– অন্যদের দিকে আঙুল তোলার সময় নিজেদের নৈতিক জায়গাটি মেরামতের একটা বিলম্বিত চেষ্টা অন্তত তাদের দিক থেকে রয়েছে!