গাছ, পতঙ্গ, পাখি, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী, অণুজীব সব প্রাণসত্তাই কথা বলে। নিজেদের ভেতর কিংবা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক বাস্তুতন্ত্র আরেক বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে অবিরাম কথা বলে চলেছে।
Published : 27 Jun 2024, 08:31 AM
গাছ জড়িয়ে ধরে দলে দলে নানা বয়সের মানুষ গাছের কথা শোনার চেষ্টা করছে। শিশু, কিশোর, তরুণ, প্রৌঢ়, প্রবীণ নারী পুরুষ গাছের গায়ে কান পেতে আছে। এমন বিরল দৃশ্য মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে, যা দেখে চোখে পানি চলে আসে। যেন ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র মায়াময় মানুষেরা চোখে জল নিয়ে গাছের কথা শুনছেন। মনে হলো সহস্র জগদীশ বসু উচ্চারণ করছেন, গাছের প্রাণ আছে। মনে হলো বহু অমৃতা দেবী, বিরসা মুন্ডা, মনা হাজং, অজিত রিছিল কী পীরেন স্নাল গভীর বিস্ময়ে জড়িয়ে আছেন গাছ। ইতিহাস থেকে ইতিহাসে এইসব মেহনতি নিম্নবর্গ গাছ ও প্রকৃতি রক্ষায় জীবন দিয়েছেন। গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রাঘদী ইউনিয়নের গজিনা গ্রামের এক ‘কথা বলা গাছ’ নিয়ে গত কয়েকদিন সরব ছিল গণমাধ্যম। একই সঙ্গে গণমাধ্যম এই প্রথম এমন একটি সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ করেছে, যা, কেবল নৃশংসই নয়, একই সঙ্গে সংবিধানবিরোধী। ‘পুলিশের উপস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত কেটে ফেলা হলো গোপালগঞ্জের গাছটি’ এমন সংবাদ আমাদের কী বার্তা দেয়। কোনো মানুষকে কুপিয়ে হত্যা করার ছবি গণমাধ্যম সচরাচর নৈতিকতার কারণে প্রকাশ করে না। কিন্তু সবার সামনে ‘কথা বলার অপরাধে’ একটি গাছকে খুন করার ছবি গণমাধ্যম নিদারুণভাবে প্রকাশ করেছে। এই ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে আমরা প্রবলভাবে ‘এথনোপোসেন্ট্রিক’ বা মানুষকেন্দ্রিক। একটি গাছ বা মৌমাছি বা সাপ কী বনরুইয়ের আহাজারি বোঝার কোনো যোগ্যতা আমাদের নেই। বাংলাদেশে সর্বদা মতপ্রকাশ বা বাকস্বাধীনতা বা কথা বলার স্বাধীনতা প্রশ্নে আমরা নাগরিক প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। গণমাধ্যম অন্ততপক্ষে মুক্তগণমাধ্যম দিবসে এই বিষয়ে সরব হয়। কিন্তু কেবলমাত্র কথা বলার অপরাধে একটি গাছকে নির্দয়ভাবে প্রাণ দিতে হলো। তাহলে কী মানুষ ছাড়া আর কারো কথা বলার অধিকার নেই। গাছ, পতঙ্গ, পাখি, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী, অণুজীব সব প্রাণসত্তাই কথা বলে। নিজেদের ভেতর কিংবা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এক বাস্তুতন্ত্র আরেক বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে অবিরাম কথা বলে চলেছে। এটাই মাতৃদুনিয়ার মহাবয়ানের জটিল রহস্য। প্রজাতি হিসেবে ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ মানুষ এতোই ‘অযোগ্য’ আর ‘অতৎপর’ যে, একমাত্র মানুষ অন্য কোনো প্রাণ-প্রজাতির ভাষা বুঝতে পারে না। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ নিরন্তর গাছের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছে। জনউদ্ভিদবিদ্যা গাছের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে পাঠ করে। ‘গাছ কথা বলতে পারে না’ যারা বলছেন তারা মূলত তাদের অজ্ঞানতা, অক্ষমতা, অপরাগতা এবং একই সঙ্গে প্রবল ‘প্রকৃতি-হন্তারক চরিত্র’ প্রকাশ করেছেন। কথা বলা গাছ ‘কুসংস্কার’ ও ‘অপপ্রচার’ ছড়াচ্ছে। এই অপপ্রচারকে কাজে লাগিয়ে কেউ যাতে ব্যবসা করতে না পারে সেকারণে অতিসচেতন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি গাছটি কাটার সিদ্ধান্ত নেন। অকারণে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত পরিবেশ আইন, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই ঘটনায় গণমাধ্যম একাডেমিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে একাডেমিকরা জানান, গাছ কথা বলতে জানে না। এটি ‘অবৈজ্ঞানিক’। জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন কী বিদ্যায়তন সবাই মিলে জোর করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন ‘গাছ কথা বলতে পারে না’। এখান থেকে আমরা কী বার্তা পাই? কেউ কথা না বলতে পারলে তাকে মেরে ফেলতে হবে? গাছের যোগাযোগের ভাষা নেই বিষয়টি যারা প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া, তারা কী গাছের ভাষা বুঝতে সক্ষম? তাহলে কেন একটা ভুল অবৈজ্ঞানিক ধারণা তারা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন? এই ক্ষমতা বাহাদুরির পেছনে প্রোথিত আছে প্রবল মানুষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই ঘটনা প্রমাণ করল মানুষ তার নিজের প্রবল মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো নিরীহ গাছ খুন করতে পারে। নদী, পাহাড়, বন দখল করতে পারে। যদি বিষয়টি ‘অপপ্রচার’, ‘অবৈজ্ঞানিক’ কিংবা ‘কুসংস্কার’ হয় তবে এসব তো শ্রেণিবিভাজিত সমাজের কাঠামোগত সংকট। এর সঙ্গে কী কোনোভাবেই গাছপালা জড়িত? যারা গাছটি কাটলেন তারা মূলত একটা ক্ষমতার চর্চা করলেন। বরং বিষয়টি পুরোপুরি সাংস্কৃতিক তর্ক। বরং এই ঘটনা আমাদের সচেতন ও সজাগ হওয়ার বার্তা দেয়। আমাদের বিদ্যায়তন, জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসন প্রাণ-প্রকৃতি বিষয়ে কী ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করেন। পরিবেশ দিবসে দশটি চারা রোপণ করে কিংবা লোকদেখানো পরিবেশ বাঁচাও শ্লোগান দিয়ে এই চিন্তাদর্শনের বদল ঘটবে না। চলতি লেখাটি ‘কথা বলা বা না বলার অপরাধে’ নিহত গাছের ন্যায়বিচার দাবি করছে। গাছসহ প্রাণ-প্রকৃতি ও প্রতিবেশ নিয়ে আমাদের প্রবল মানুষকেন্দ্রিক চিন্তার প্রতিবেশবাদী রূপান্তরের জন্য আমাদের আলাপ ও অনুশীলন গুলো মজবুত করতে হবে।
গাছ কেঁদেছিল, কিছু মানুষ শুনেছিল
চান্দারবিল এলাকার এক প্রাচীন গ্রাম গজিনা। আলতাফ শেখদের বাড়ির এক কথা বলা ‘আফ্রিকান মেহগণি’ গাছ নিয়ে যত কাণ্ড। গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, গ্রামের নীরবসহ কয়েকজন শিশু গাছের গায়ে কোপ দিয়েছিল। তখন গাছ বলেছিল, ‘আমাকে কেটো না’। তারপর থেকে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ গাছের গায়ে কান পেতে কথা শুনতে চায়। অনেকে গাছের কান্নার আওয়াজ শুনেছে। কিশোরী মেয়ে বা নারীকণ্ঠে কান্নার আওয়াজ। অনেকে বলেছে, সালাম দিলে গাছ এর জবাব দেয়। গাছের প্রতি মানুষের এই হৃদয়স্পর্শী সম্পর্ক অনেকে মেনে নিতে পারেনি। কোনোদিন যাদের বিজ্ঞানমনস্কতার আন্দোলনে দেখা যায়নি, তারা হঠাৎ করে গাছের কথা বলাকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ এবং ‘কুসংস্কার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। এক হুজুর বলেন, এমন ঘটনা ধর্ম সমর্থন করে না। অথচ ইসলাম প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি মানুষকে দায়িত্বশীল হওয়ার বার্তা দেয়। ইসলামে আছে, প্রতিটি গাছের পাতা সবসময় আল্লার জিকির করে। যে শিশুরা গাছের গায়ে কোপ দিতে গিয়ে গাছের কথা শুনে থেমে গিয়েছিল, তারা বড় বিস্ময়কর। সৌভাগ্যবান। যারা গাছের কান্নার আওয়াজ শুনেছেন তাদের জীবনে এই ঘটনা এক বিরল স্মৃতি হয়ে রইলো। প্রথম যখন এই ঘটনা শুনি মনে হয়েছিল যদি আজ দেশের সব গাছ কথা বলে ওঠতো, পাহাড় থেকে সমতলে, গ্রামে থেকে নগরে। তাহলে গাছের গায়ে আমাদের লোভাতুর উন্নয়নের নির্দয় কোপ থামতো। ঢাকার ধানমন্ডি সাত মসজিদ সড়ক বা চট্টগ্রামের সিআরবিতে বা শ্রীমঙ্গলের নাহার পুঞ্জি বা চিম্বুক পাহাড়ে গাছের গায়ে কোপ দিতে গিয়ে এর আগে কেউ কি গাছের চিৎকার শুনতে পেয়েছেন? গজিনা গ্রামের শিশু নীরবের মতো কেউ কী গাছের কথা শুনে কোপ বন্ধ করেছিলেন? গাছের কথা শুনে কোপ থামানো শিশুদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এই শিশুরা আমাদের আরেক নতুন বার্তা দিয়েছে। এরকম ঘটনা ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে। বহু ভূগোল, সমাজ ও সংস্কৃতিতে গাছের প্রতি অবিস্মরণীয়সব সম্পর্ক স্থাপনের নানা নজির আছে। কিন্তু যখন কথা বলা বা না বলার অপরাধে গাছটিকে সবার সামনে দিনেদুপুরে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো তখন ক্ষুব্ধ ও আহত হয়েছি। বারবার গাছের কথা শুনে কোপ থামানো গজিনা গ্রামের শিশুদের কথা মনে আসে। ছোট্ট শিশুর কাছে আমরা বড়রা আজ কী নিদারুণ বার্তা দিলাম। এই শিশুরা বার্তা পেল গাছ কেটে ফেলার জন্য মানুষ যেকোনো সময় যেকোনো কারণ তৈরি করতে পারে। এমন প্রাণপ্রকৃতি বিনাশী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই কী আমরা আমাদের শিশুদের বড় করতে চাই? তাহলে বড় হয়ে আমাদেও শিশুরা কেন পাহাড় দখল করবে না, নদী খুন করবে না, বন পুড়িয়ে দিবে না? কারণ আমরা এভাবেই আমাদের ভবিষ্যত গড়ে তুলছি।
‘কুসংস্কার’, ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ ও ‘অপপ্রচার’ তর্ক
‘কুসংস্কার’, ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ আর ‘অপপ্রচার’ নিয়ে নানা মত ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। বহুজাতিক সবুজ-বিপ্লব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যখন ধানক্ষেতে কার্বোফুরান বা প্যারাকোয়েট বিষ দেয়া হয় তখন সবকিছু মরে যায়। শুষণি শাক, থানকুনি, কলমি, হেলেঞ্চা, বথুয়া, শ্বেতদ্রোণ, ঘুম শাকের মতো খাদ্য ও পথ্য মেরে ফেলা হয়। শামুক, কেঁচো, ব্যাঙ, সাপ, মৌমাছি, ভ্রমর ও অণুজীব মারা যায়। একটি বাস্তুতন্ত্রেও সকল প্রাণ-প্রজাতিকে মেরে, সবার খাদ্য বিনষ্ট কওে কেবলমাত্র মানুষের জন্য ধান উৎপাদনের এই পদ্ধতিকে কিন্তু ‘বিজ্ঞানভিত্তিক’ কৃষি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে অধিপতি ব্যবস্থা। কিন্তু এই পদ্ধতি কী বিজ্ঞানমনস্ক? একটি বাস্তুতন্ত্রকে তছনছ করে ফেলা কোনোভাবেই কোনো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়। বিজ্ঞান সতত কল্যাণময় দর্শন ধারণ করে এবং নিরন্তর জনযুক্তি ও প্রমাণের ভেতর দিয়ে বিকশিত হয়। ‘কুসংস্কার’ বিষয়টি খুব বেশি ওতপ্রোতভাবে ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত। নিম্নবর্গের ওপর চাপিয়ে রাখা বহুবিধ কুসংস্কারকে আমরা অধিকাংশ সময় প্রশ্ন করতে পারি না। একটা সময় সতীদাহপ্রথা ছিল এমনকি ‘ডাইনি’ নাম দিয়ে বহু নারীদের পুড়িয়ে মারা হতো। বিদ্যায়তনে মেয়েদের জন্য প্রশ্নহীন সূর্যাস্ত আইন কিংবা ‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে’ এসব প্রবল বৈষম্যমূলক সামাজিক কুসংস্কার। সংস্কার-কুসংস্কার নিয়ে বহু নৃবৈজ্ঞানিক ও সামাজিক গবেষণা আছে। দেখা গেছে, প্রবল কুসংস্কারগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রেণিবিভাজিত সমাজের ক্ষমতাকাঠামোর তৈরি। নিম্নবর্গ কুসংস্কার তৈরি করে না, কিন্তু কুসংস্কার দিয়ে নিম্নবর্গকে দাবিয়ে রাখা হয়। আবার একই সঙ্গে নিম্নবর্গের বহুবিধ দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ এবং অনুশীলনকে জোর করে ‘কুসংস্কার’ বলে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ‘কথা বলা গাছ’ নিয়েও সর্বজনের প্রাণ-প্রকৃতিভিত্তিক বিশ্বাসকে ক্ষমতাপক্ষ ‘কুসংস্কার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জোর চেষ্টা করেছে। আর একটা গাছ কেটে ফেলার ভেতর দিয়ে সমাজ থেকে ‘কুসংস্কার’ উপড়ে ফেলার বাহবা নিতে চেয়েছে। সারাবিশ্বে প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় গ্রামীণ নিম্নবর্গ ও আদিবাসীদের লোকায়ত জ্ঞান, বিশ্বাস এবং অনুশীলনগুলো নানাভাবে ভূমিকা রাখছে। ক্ষমতাকাঠামো নানাসময়ে এসবকে ‘কুসংস্কার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জোর চেষ্টা করলেও আজ প্রমাণিত হচ্ছে এসব বিজ্ঞানভিত্তিক এবং মাতৃদুনিয়ার কল্যাণে নিরলস অবদান রাখা তৎপরতা। গ্রামীণ কৃষক ফসলের ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি বা গাছের ডাল পুঁতে দিয়ে কাকতাড়ুয়া বানাতেন, যাতে ফিঙেসহ পাখিরা বসতে পারে। পাখিরা পোকা খেয়ে এভাবেই ফসল রক্ষা করে। ফসল রক্ষার প্রকৃতিবান্ধব এই আদি কাকতাড়ুয়া পদ্ধতিকে ‘কুসংস্কার’ হিসেবে দেখেছেন বহু কৃষিবিজ্ঞানী। তারা পোকা মারতে বিপদজ্জনক রাসায়নিক বিষের অনুমোদন দিয়েছেন। যখন পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিষে আক্রান্ত তখন তারাই আবার গ্রামীণ কৃষকের এই আদি পদ্ধতিকে ‘পার্চিং’ নাম দিয়ে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চা হিসেবে হাজির করেন। তাহলে কোনটি কুসংস্কার আর কোনটি বিজ্ঞানমনস্কতা? মনস্যান্টো, সিনজেনটা, বায়ার, বিএএসএফ কোম্পানির বিষের ব্যবসাকে চাঙ্গা করতে কৃষকের প্রকৃতিবান্ধব জ্ঞান ও দর্শনকে বারবার ‘কুসংস্কার’ বলে চাপিয়ে দেয়া কী কোনোভাবেই বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারে? সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় গ্রামীণ সমাজে নানা নিয়ম পালিত হয় কঠোরভাবে। এ সময় খাদ্যগ্রহণের বিশেষ নির্দেশনা আছে। গর্ভসম্পন্ন নারীর জন্য বিশেষ নির্দেশনা আছে। বিজ্ঞানশিক্ষায় ‘শিক্ষিত’ হয়ে ওঠা একটা শহুরে মধ্যবিত্ত এখনো মনে করে এগুলো গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ মানুষের ‘কুসংস্কার’। কিন্তু নানাভাবে এসবের বিজ্ঞানসত্য প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৭ সালে বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঁশগাছে ফুল এসে গণমড়ক তৈরি হলো পাহাড়ের আদিবাসীরা বলেছিলেন, ইঁদুর-বন্যা এবং দুর্ভিক্ষ হবে। তখন বুকফুলিয়ে গণমাধ্যমকে কৃষিকর্মকর্তারা বলেছিলেন এটি কুসংস্কার। কিন্তু যখন ইঁদুর-বন্যা ও খাদ্যাভাব ঘটল তখন তারা লুকিয়ে গেলেন। তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এ বিষয়ে গবেষণার জন্য অর্থ নিয়ে প্রতিবেদনে লিখলেন, এটি বৈজ্ঞানিক এবং প্রাকৃতিক ঘটনা। কী নিদারুণ, কী রাজনৈতিক! বিশাল বট, অশ্বত্থ, হিজল, পাকুড় গাছের তলায় রাতের বেলায় ঘুমানো নিষেধ। গ্রামের প্রবীণজনেরা বলেন, গাছের ভূত-জ্বিন মেরে ফেলতে পারে। রাতের বেলা গাছ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমণ করে বলে এভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে। নদীর স্রোতের উজানে কখনো জেলেরা মলমূত্র ত্যাগ করে না, এতে নাকি অসুখ ছড়াবে গ্রামে। সুন্দরবনের বনজীবীরা বিশ্বাস করে, বাদাবন মা বনবিবির পবিত্রস্থল, এখান থেকে অন্যায়ভাবে কোনো কিছু চুরি করা যায় না। এইসব লোকায়ত বিশ্বাস কী কোনোভাবেই কুসংস্কার? এইসব দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুশীলন এখনো পৃথিবীর নদী, পাহাড়, অরণ্য প্রকৃতি বাঁচিয়ে রেখেছে।
এবার আসা যাক লোকায়ত বিশ্বাস ও চর্চার ভেতর দিয়ে বৃক্ষ প্রাণপ্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রেও সংরক্ষণের আলাপে। গ্রামীণ নিম্নবর্গ ও আদিবাসী জনগণ সহস্র বছর ধরে কেবলমাত্র বিশ্বাস আর অনুশীলনের ভেতর দিয়ে দুনিয়ার সহস্র প্রাণ-প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষিত রাখছে। ‘পবিত্র গাছ’, ‘পবিত্র বন’ হিসেবে ইতোমধ্যেই এসব বিশ্বাস জাতিসংঘ, বিদ্যায়তন ও জনপরিসরে স্বীকৃত হয়েছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এই বিষয়কে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে দেশে প্রথম ২০০৪ সালে যখন আমি পবিত্র গাছ ও পবিত্র বনের গবেষণা উপস্থাপন করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিতর্কিত বনকর্মকর্তা ওসমান গণি। বনভূমি লুটপাটের কারণে প্রধান বনসংরক্ষক থাকাকালীন যার বিচার হয়। উপস্থাপনের পর তিনি সবার সামনে বলেছিলেন, বৃক্ষ ও বন সংরক্ষণের লোকায়ত চর্চা ও বিশ্বাসগুলো মিথ্যা, বানোয়াট এবং কুংস্কারাচ্ছন্ন। সিলেটের শাহজালাল মাজারের জালালি কবুতর বা গজার মাছ, চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি মাজারের কালো কচ্ছপ কিংবা বাগেরহাটের খান জাহান আলী মাজারের মিঠা পানির কুমির কারা বাঁচিয়ে রেখেছিল? কোন বিশ্বাসে? প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষার এসব লোকায়ত বিশ্বাস কী ‘কুসংস্কার’? তাহলে চিড়িয়াখানার মতো নির্মম জেলখানা ছাড়া প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় ‘কুসংস্কার-বিরোধী’ ক্ষমতাচর্চাকারীদের আর কোনো উদাহরণ আছে কী?
কিছু মানুষ হয়তো নিজের বিশ্বাসে বা হয়তো ‘প্ররোচণায়’ গজিনা গ্রামের কথা বলা গাছের তলে মানত শুরু করেছিলেন। স্থানীয় চেয়ারম্যান প্রতিষ্ঠা করলেন এর মাধ্যমে ‘নতুন ব্যবসা’ শুরু হবে, সাধারণ মানুষ প্রতারিত হবে। তাই প্রশাসনসহ তারা গাছটি কেটে ফেলার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার কবল থেকে বাঁচালেন। কিন্তু যে মানুষেরা একটি গাছকে বিশ্বাস করে সেই গাছকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মানত করলো, তাদের বিশ্বাসে কেন আঘাত তৈরি করা হলো? এই বার্তাকে আমরা কীভাবে পাঠ করব? একটি গাছের কাছে, পাহাড় নদী বন বা প্রকৃতির কাছে মানুষ তাহলে নতজানু হবে না? মানুষের বিশ্বাস, চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চায় প্রাণ-প্রকৃতি থাকবে না? স্থানীয় চেয়ারম্যান আর প্রশাসন স্থানীয় মানুষের প্রকৃতিবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন চুরমার করে দাঁড়াতে পারলেন এই প্রশ্নটি আমাদের গণমাধ্যম কখনোই করেনি। তারা ক্ষমতাহীন গ্রামীণ নিম্নবর্গের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ক্ষমতা চর্চা করেন। কিন্তু একই এলাকায় যখন রাষ্ট্রের সাবেক এক প্রধান সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ করে বিঘার পর বিঘা কৃষিজমি দখল করেন তখন তাদের চুপ থাকতে হয়। তখন সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে তারা সর্বময় ক্ষমতার বাহাদুরিতে একটি আঁচড় পর্যন্ত বসাতে পারেন না। বারবার ইতিহাসে প্রমাণিত ও স্পষ্ট হয়েছে ‘কুসংস্কার’, ‘অপপ্রচার’ এবং ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ প্রবলভাবে ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত রাজনৈতিক প্রবণতা। আর এ প্রবণতায় বারবার শোষিত ও নিপীড়িত হয়েছে ক্ষমতাহীন নিম্নবর্গ, গজিনা গ্রামের নিরীহ কথা বলা না বলা গাছটির মতো বহু প্রাণ-প্রজাতিকে জীবন দিতে হয়েছে।
গাছ কথা বলে, আমরা কী শুনতে পাই?
গাছ কী কথা বলতে পারে? পৃথিবী ও মানসমাজের টিকে থাকার ক্ষেত্রে জীবন দিয়ে অবদান রাখা গাছের ক্ষেত্রে এমন একটি প্রশ্ন তোলা নিতান্তই অবান্তর, অবৈজ্ঞানিক এবং অকৃতজ্ঞতার সামিল। ‘কথা বলা’ বলতে আমরা কী বুঝবো? মানে অর্থবোধক যোগাযোগ তৈরি করে কীনা? যদিও ভাষা ও যোগাযোগ নিয়ে বহু আলাপচারিতা আছে। ভাষার কাঠামো, পরিসর, গঠন বিন্যাস, চিহ্ন, ইঙ্গিত, ক্ষমতা, রাজনীতি, বাণিজ্য নানাকিছু। আমরা সেই আলাপে ঢুকছি না। মানুষ যেভাবে কথা বলে বা যোগাযোগ করে তা কি দুনিয়ার সবার জন্য বোধগম্য, দুনিয়ার সব সমাজের সব মানুষের ভাষাভঙ্গি এক নয়। আবার মৌমাছির ভাষার সঙ্গে মাছের ভাষা মিলবে না। মধু আহরণের আগে শ্রমিক মৌমাছিরা চাকের চারধারে ‘মৌ-নাচের’ মাধ্যমে চাক থেকে মধুর উৎস, ফুলের বিবরণ, মধুর পরিমাণ সবকিছু প্রকাশ করে। চাকের অন্য মৌমাছিরা সেই নাচ দেখে মধু আহরণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি মৌমাছি সমাজের যোগাযোগর ভাষা। এখন একটি মৌমাছি বা গাছের সঙ্গে মানুষ কথা বলতে পারবে কীনা, একে অপরের ভাষা বুঝবে কীনা এটি একই সঙ্গে একটি দার্শনিক এবং প্রাণগত প্রশ্ন। গাছের ভাষা বোঝা নিয়ে নানা সমাজে নানা আখ্যান ও বিশ্বাস প্রচলিত আছে। বহু বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রমাণ হয়েছে। গাছ কীভাবে অনুভব ও যোগাযোগ করে এই গোপন সত্য নিয়ে ‘দ্য হিডেন লাইফ অব ট্রিস’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন পিটার ওয়লেবেন। ২০১৬ সালে গ্রেস্টোন বুকস এটি প্রকাশ করেছে। এটি একটি বেস্টসেলার বই। জার্মানিতে এখন অবধি এর প্রায় ৮ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল বইটি নিয়ে লিখেছে, ...আসলেই গাছ ফিসফিস করতে পারে।
বিজ্ঞানী টম্পকিসন ও বার্ড ১৯৭৩ সালে তাদের ‘প্ল্যান্টস সিক্রেট ল্যাঙ্গুয়েজ’ শীর্ষক বইতে লিখেন, রাসায়নিক সিগন্যাল, শব্দ তরঙ্গ এবং শেকড়ের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মূলত গাছ যোগাযোগ করে। গাছের এই গোপন ভাষা আমাদের জানা বোঝা জরুরি। ‘অ্যা রিভিউ অন আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য প্ল্যান্টস সিক্রেট ল্যাংগুয়েজ ফর কমিউনিকেশন অ্যান্ড ইটস অ্যাপ্লিকেশন’ শীর্ষক প্রবন্ধে বর্ধমানের উদ্ভিদবিজ্ঞানী চন্দন দাস জানান, গাছের ভাষা বুঝতে পারলে কৃষি, ওষুধশিল্প এবং প্রকৃতি সংরক্ষণে বড় রকমের ভূমিকা রাখা সম্ভব। বিয়াংকা বোনাতো, ফ্রান্সিসকা পেরেসট্টি, সিলভিয়া গুয়েরা, কুইরান ওয়াং এবং উমবার্তো ক্যাস্টিলোদের একটি যৌথ গবেষণা ‘ক্র্যাকিং দ্য কোড: অ্যা কমপারেটিভ অ্যাপ্রোচ টু প্ল্যান্ট কমিউনিকেশন’ শিরোনামে ২০২১ সালে ‘কমিউনিকেটিভ অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি’ জার্ণালে প্রকাশিত হয়। মানুষের সমাজে ‘ভাষাকে’ যোগাযোগের মাধ্যম বলা হয়। মানুষ এবং গাছ একই পদ্ধতিতে ‘যোগাযোগ’ রাখে কীনা বিষয়টি নিয়ে উল্লিখিত বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করেন। বিজ্ঞানীরা দেখতে পান সমন্বিত কাঠামো, অর্থ তৈরির কার্যক্রম এবং উপভাষার অস্তিত্ব মূলত এই তিনটি উপায়ে মানুষ ও গাছ ভাষাগত যোগাযোগ অব্যাহত রাখে। গবেষণায় তারা প্রমাণ করেন কোনো উদ্ভিদ তার নিজ বাস্তুতন্ত্রে নানা প্রাণসত্তা ও পরিবেশের সঙ্গে সার্বক্ষণীক যোগাযোগ করে। গবেষকগণ গাছ ও মানুষের ভাষাগত যোগাযোগের বয়ানকে বিশ্লেষণ করে ভাষার আরো বিস্তৃত পরিবেশগত সংজ্ঞায়নের প্রস্তাব করেন, যা একই সঙ্গে প্রাণবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান ডিসকোর্সেও ভেতর একটি আন্তঃসমন্বয় তৈরি করতে সক্ষম।
গাছ প্রকৃতির যেকোনো পরিবর্তনে সাড়া দেয়। গাছ তার বর্ষবলয়ে ঘটে যাওয়া বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, তীব্র দাবদাহ, শৈত্যপ্রবাহ কিংবা মহামারির স্মৃতি লিখে রাখে। যদিও এই বাক্য পড়ে আবার কোনো একাডেমিক না বলে বসেন, গাছ কীভাবে লিখবে গাছের কী আঙুল বা কলম আছে। কারণ গণমাধ্যমে গজিনার গাছের ক্ষেত্রে একজন একাডেমিক বলেছেন, গাছের কী ভোকাল কর্ড আছে, গাছ কীভাবে কথা বলবে? গোপালগঞ্জের গ্রামীণ জনগণ গাছের কথা বলা বলতে ‘যোগাযোগের’ যে রূপকল্প হাজির করেছেন তা আমরা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। মানুষসহ প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণ-প্রজাতির মতো গাছ কথা বলে, মানে গাছ যোগাযোগ করতে সমর্থ, মানে গাছ কথাই বলে। কারণ মানুষের সমাজে ‘কথা বলা বা ভাষার’ ক্ষেত্রে ‘অর্থবোধক যোগাযোগের’ বিষয়টিই সামনে আনা হয়। গাছ গান শোনে, বিশেষ সুরের বাদ্যযন্ত্র ও গান শুনিয়ে ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর বহু বৈজ্ঞানিক নমুনা আছে। গাছ ভয় পায়, বহিরাগত আক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষা করতে প্রতিরোধ করে, গাছ রোগে শোকে সাড়া দেয়। গ্রামীণ নি¤œবর্গ ও আদিবাসী মানুষ যারা মূলত পৃথিবীর বৃক্ষবৈচিত্র্য বাঁচিয়ে রাখছেন, তাদের বহুজনের বিশ্বাাস গাছ কষ্ট পায়, মন খারাপ করে, গাছ উৎসাহিত হয়, আনন্দ করে। গাছের এইসব ভাষা বোঝার জন্য ক্ষমতা বা যন্ত্র নয়; কলিজা লাগে। সাহসী, অবিচ্ছিন্ন এবং সংবেদনশীল অন্তর। উদ্বায়ী জৈব যৌগ, বিদ্যুৎ তরঙ্গ কিংবা শেকড়ের জটিল মাইকোরাইজাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গাছ মাটির অণুজীবদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু গাছের ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। ‘গাছের প্রাণ আছে’ এই বিজ্ঞানসত্য প্রমাণের ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের সামনে এক ঐতিহাসিক প্রতিবেশগত-দর্শনকে হাজির করেন। বিবর্তনবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন এবং দার্শনিক কার্ল মার্ক্স পরবর্তী সময়ে এই চিন্তা আমাদের ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ মনোজগতে বেশ প্রভাব তৈরি করেছে। আজ জলবায়ু বিপর্যস্ত এক ভঙ্গুর পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে সবাই যখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে এই বিপন্ন গ্রহকে আগলে দাঁড়াবার, সেই সময়ে বাংলাদেশের কোনো গ্রামে ‘গাছ কথা বলতে পারে না’ এই মর্মে ক্ষমতাপক্ষ কোনো গাছকে কেটে ফেলার মতো বাহাদুরি দেখায়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনা নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মমাটিতে আজ এই নিদারুণ ঘটনা ঘটলো। যিনি বহু সংবেদনশীল পরিবেশপ্রশ্ন হাজির করেছিলেন। আইনের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন। হৈমন্তীর মতো বহু বিরল ও দুষ্প্রাপ্য গাছ বুনেছিলেন। তাঁর জন্মমাটিতে মানুষের নিজেদের ভেতরকার তর্ক ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণে একটি গাছের প্রাণ হারানো নতুন প্রজন্মের কাছে ভিন্ন বার্তা দিবে।
গাছের বাকস্বাধীনতা রক্ষা করবে কে?
রাষ্ট্র গাছের আত্মপরিচয় এবং বাকস্বাধীনতা সুরক্ষায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’। জাতিসংঘের আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২, রামসার ঘোষণা, সাইটেস সনদ, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কিংবা ২০২১ সনে গ্লাসগো সম্মেলনে গৃহীত বিশ্বের বৃক্ষ ও বন সুরক্ষা নীতি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ পরিবেশ ও বৃক্ষ সুরক্ষায় বৈশ্বিক অঙ্গীকার করেছে। একই সঙ্গে ২০৩০ সালের ভেতর জাতিসংঘের ১৭টি স্থায়িত্বশীল লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনেও আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “...এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলাম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত। আমরা ক্রমাগতভাবে এই ধরণীর ব্যাকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি।” গজিনা গ্রামের যে শিশুরা গাছের কথা ও কান্না শুনেছে তাদের আমরা ভুল বার্তা দিয়েছি। আমরা কোনোভাবেই আমাদের দায় ও দায়িত্ব অবেহলা করতে পারি না। বরং এই কথা বলা গাছ এই পরিবেশ-বিপন্ন সময়ে প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষার ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের জন্য এক সহজ যোগাযোগ বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারতো। কার্ল মার্ক্স আমাদের জানান, মানুষ প্রকৃতির জন্যই বেঁচে থাকে, প্রকৃতির সঙ্গে সার্বক্ষণিক কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া জরুরি। নিয়ানডার্থাল, ডেনিসোভান, ইরেকটাস, ফ্লোরিয়েনসিস মানুষেরা প্রকৃতির সঙ্গে সার্বক্ষণিক আলাপ জারি রেখেছিল কীনা আমরা জানি না। তবে হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষ ঐতিহাসিকভাবে গাছের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে, যোগাযোগ নানাভাবে অব্যাহত রেখেছে। তা নাহলে এই প্রকৃতি ও সংস্কৃতি বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যেত। যে গোপালগঞ্জে কথা বলা বা না বলার অপরাধে একটি গাছ কেটে ফেলা হলো, সেখানেই কাশিয়ানীর হিরণ্যকান্দি গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে শতঘটনার স্বাক্ষী শতবর্ষী এক আমগাছ। আমি একবার এক পড়ন্ত বর্ষায় এই গাছের গায়ে কান পেতেছিলাম, গাছটি আমাকে কী বলেছিল মনে নেই, কেবল মনে আছে আমি কোনো মহাজীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম।