আচরণবিধি না মেনেই করা হচ্ছে এসব ক্যাম্প; প্রার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, অতি উৎসাহীদের কাজ এগুলো।
Published : 02 Jan 2024, 10:58 PM
রাজধানী ঢাকার আসনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ এখনও কম; ভোটের ডামাডোল যে কারণে ওঠেনি জমে, তবে নগরজুড়ে সড়ক ও ফুটপাতে নির্বাচনি ক্যাম্প ও তোরণে বালাই নেই আচরণবিধির।
এমনটাই দেখা গেল রাজধানীর মিরপুর-৬ সেকশনের ডি ও ই ব্লকে। এ দুই ব্লকের মাঝের পৌনে এক কিলোমিটার দূরত্বেই তিনটি নির্বাচনি ক্যাম্প। সবগুলোই আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইলিয়াস মোল্লাহর; বানানো হয়েছে সড়ক ও ফুটপাতজুড়ে।
ঢাকা-১৬ আসনে নৌকার এ প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির আমানত হোসেনের ক্যাম্পও এগুলোর একটু দূরেই; সেটিও একটি সড়কে ঢোকার মুখেই। এটিও ফুটপাত ছাড়িয়ে সড়কের কিছু অংশজুড়ে করা হয়েছে।
মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনেরই চলন্তিকা মোড় এলাকায় সড়কের এক পাশের ফুটপাত ও সড়কের একাংশজুড়ে ক্যাম্প রয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন রবিনের। নৌকা না পেয়ে স্থানীয় এ আওয়ামী লীগ নেতা ঈগল প্রতীকে ভোটে লড়ছেন।
ঢাকার এ আসনেরই খণ্ড চিত্র এটি; মিরপুরের বড় অংশ নিয়ে গঠিত এ এলাকার এখানে সেখানেই এমন নির্বাচনি ক্যাম্প রয়েছে অনেক।
শুধু ঢাকা-১৬ নয়, মহানগরীর বেশির ভাগ আসনের এলাকায় এলাকায় নির্বাচনি আচরণবিধির নিয়ম ভেঙে ক্যাম্প ও তোরণ বানানো হয়েছে। যেখানে সেখানেই ফুটপাত ও সড়কের অংশজুড়ে ক্যাম্প বসানো হয়েছে। এতে মানুষের পথ চলতে সমস্যা হচ্ছে।
এসব বিষয়ে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তারা নিজেরা নন, অনেকেই অতি উৎসাহী হয়ে এসব কাজ করছেন। যখন জানতে পারছেন, তখন সেগুলো সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও আচরণবিধি লঙ্ঘনের এসব বিষয় নজরে আনার পর বা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানাচ্ছেন।
ঢাকা-১৬ আসনের ক্যাম্পগুলোর বিষয়ে নির্বাচন মনিটরিং টিমের সদস্য মো. জিয়াউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো বিষয় যদি আমাদের চোখে পড়ে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নিই। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠিয়ে দিই এবং তিনি ব্যবস্থা নেন। ওই এলাকার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি।”
আরেক আসন ঢাকা-১২ এ তেজগাঁওয়ের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি ও লাভ রোডে প্রবেশের মুখে একটি বড় তোরণ করা হয়েছে।
নিয়ম না মেনে ফুটপাত ও সড়কে তোরণ নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে এ আসনের আচরণবিধি প্রতিপালনের জন্য নিয়োজিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুলতানা সালেহা সুমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি আমার জানা ছিল না। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কী বলছে আচরণবিধি
নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী কোনো প্রার্থীর পক্ষে কোনো ধরনের তোরণ বানানো যাবে না। রাস্তা, ফুটপাত বা মানুষের ব্যবহারের স্থানে করা যাবে না নির্বাচনি ক্যাম্প। এছাড়া নির্বাচনে আলোকসজ্জার বিষয়েও আছে নিষেধাজ্ঞা।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আচরণবিধিমালার ১০ ধারা অনুযায়ী, কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল কিংবা তার মনোনীত প্রার্থী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী বা তাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচনি প্রচারণায় কোনো গেইট বা তোরণ নির্মাণ করতে পারবেন না বা চলাচলের পথে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবেন না।
পাশাপাশি আইন অনুযায়ী, কোনো সড়ক বা জনগণের চলাচল ও সাধারণের ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত স্থানে নির্বাচনি ক্যাম্প করতে পারবেন না।
একজন প্রার্থীর পক্ষে প্রতিটি ইউনিয়নে সর্বোচ্চ একটি এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতি ওয়ার্ডে একটির বেশি ক্যাম্প করা যাবে না।
সড়কের পর সড়কে যা দেখা গেল
কাগজে কলমে এমন সব নিয়মের কথা বলা থাকলেও ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রার্থীদের ক্যাম্প করা হয়েছে ফুটপাতে, রাস্তায়। অনেক স্থানে সেসব ক্যাম্প ফুটপাত ছাড়িয়ে সড়কে এসে পড়েছে। প্রার্থীর পক্ষে তোরণও নির্মাণও করা হয়েছে। আবার ক্যাম্পগুলো সাজানো হয়েছে রঙিন বাতি দিয়ে, করা হয়েছে আলোকসজ্জা।
ঢাকা-১৬ আসনে মিরপুর ১২ নম্বরের ই-ব্লক পার্কের একপাশে রাজুর হোটেলের কাছে সড়কের ওপর রয়েছে নৌকার প্রার্থীর আরেকটি ক্যাম্প। এটি বানানো হয়েছে ডিএনসিসির সাবেক কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন বেনুর সৌজন্যে।
জানতে চাইলে এ আসনের নির্বাচন মনিটরিং টিমে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. ইলিয়াস মোল্লাহর প্রতিনিধি মো. রজ্জব হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমক বলেন, “আমাদের নির্বাচনি এলাকায় চারটি ওয়ার্ডে আমরা চারটি ক্যাম্প করেছি। এর বাইরে একটি ক্যাম্পও আমাদের না। অতি উৎসাহীরা নিজেরাও এসব বানিয়েছে।
“বিষয়টি আমাদের এমপি মহোদয়ও পছন্দ করছেন না। ওই ক্যাম্পগুলো যেন নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেওয়া হয় আমরা সবাইকে সেই নির্দেশ দিয়েছি।”
ঢাকা-১২ আসনে ইস্কাটন এলাকায় হাতিরঝিলের ফুটপাত ও ওয়াকওয়েতে অল্প দূরত্বের ব্যবধানে দুটি নির্বাচনি ক্যাম্প করা হয়েছে। এরমধ্যে একটি ক্যাম্পের অবস্থান দিলু রোডে, আরেকটি ক্যাম্প করা হয়েছে বিয়াম স্কুলের পাশে।
বিয়াম স্কুলের পাশের ক্যাম্প করেছে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ। এটিতে আলোকসজ্জাও করা হয়েছে। অন্যটি বানিয়েছে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ৩ নম্বর ইউনিট।
তেজগাঁওয়ের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি ও লাভ রোডে ঢোকার মুখে রয়েছে একটি বড় তোরণ। ঢাকা-১২ আসনে নৌকার প্রার্থী আসাদুজ্জামান খান কামালের জন্য ভোট চেয়ে এ তোরণ বানিয়েছেন তেজগাঁও আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য সাইফুল ইসলাম সাইফুল।
একই আসনের ঢাকার শিশু হাসপাতাল এবং জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সামনের ফুটপাত ও সড়কের একাংশে বানানো হয়েছে একটি ক্যাম্প। এটি বানিয়েছে আওয়ামী লীগের পঙ্গু হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতাল ইউনিট।
এ ইউনিটের সভাপতি কাজল মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে আমাদের ইউনিটের অফিস। সামনেই একটু জায়গায় অস্থায়ীভাবে এ ক্যাম্প করা হয়েছে।”
এসব ক্যাম্পের বিষয়ে কথা বলতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তার প্রতিনিধি মোল্লা এনায়েত হোসেনকে ফোন করা হলেও তারা ধরেননি।
ভাসানটেক বাজারের কাছে রাস্তার একপাশের ফুটপাতের ওপর ঢাকা-১৭ আসনের নৌকা প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের পক্ষে একটি ক্যাম্প বানানো হয়েছে। এখানে সড়কের ওপর করা হয়েছে একটি বিশাল তোরণ, যেটির দুটি খুঁটি বসানো হয়েছে সড়কের ওপর।
এ তোরণ ও ক্যাম্প বানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. জহির আহমেদ।
নিয়মের বিষয়টি তুলে ধরা হলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, সড়কের ওপর তোরণ এবং নির্বাচনি ক্যাম্প দুটোই স্থানীয় অতি উৎসাহীরা বানিয়ে আমার নাম বসিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই তোরণ খুলে ফেলা হয়েছে।
“আমি ভাসানটেক মুক্তিযোদ্ধা স্কুলের পাশে একটি রুম ভাড়া নিয়ে আমার ওয়ার্ডের নির্বাচনি ক্যাম্প বানিয়েছি।”
ভাসানটেক বাজারের পকেট গেইট এলাকাতে সড়কের একটা অংশে পাশাপাশি দুটি ক্যাম্প করে ভোট চাওয়া হচ্ছে নৌকার পক্ষে। এ দুটি ক্যাম্প বানিয়েছেন ডিএনসিসির ৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর সাহিদা আক্তার শীলা।
আচরণবিধি ভাঙার বিষয়ে জানতে চাইলে ভাসানটেক থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহিদা বলেন, এগুলোর একটি নারীর ও একটি পুরুষের। তবে তার দাবি সেগুলো রাস্তায় ওপর করা হয়নি। একপাশে করা হয়েছে এবং ওইখানে আগে দোকানপাট ছিল।
এসব ক্যাম্পের বিষয়ে ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাতের ব্যক্তিগত সহকারী এবং প্রেস উইংয়ের প্রধান মাইকেল চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ক্যাম্প করেছি।
তবে এর বাইরে অনেক অতি উৎসাহী নেতাকর্মী আছেন যারা বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করেছেন। ঠিক কতগুলো ক্যাম্প আছে আমরা জানি না।
এজন্য আমাদের ক্যাম্পগুলো ছাড়া বাকিগুলো সরিয়ে ফেলার একটা নোটিস দিয়েছি।”
ঢাকার আরেক এলাকা মোহাম্মদপুর ও শংকর ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা-১৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর কবির নানকের কয়েকটি ক্যাম্প করা হয়েছে সড়কের ওপর। ফুটপাতেও রয়েছে ক্যাম্প।
ধানমণ্ডির শংকরে ৯/এ সড়কে একই জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তিনটি নির্বাচনি ক্যাম্প করেছেন। ১৯ নম্বর সড়ক ও ৯/এ সড়কের মোড়ে সড়কের দু্পাশে দুটি ক্যাম্প করা হয়েছে। এর একটি করেছে ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা মেহেদী হাসান খান এবং আরেকটি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের শংকর ইউনিটের পক্ষে।
ওই ক্যাম্পে কথা হয় ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এ আর আজিজুর রহমানের সঙ্গে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকা প্রচারণায় অনেকগুলো ক্যাম্প করা হয়েছে। এগুলো তার নিজের খরচেই করেছেন।
তিনি বলেন, “এটা আবাসিক এলাকা। ক্যাম্প করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নাই। এজন্যই রাস্তায় করা হয়েছে। এতে জনগণের সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে, এজন্য আমরা দুঃখিত। নির্বাচন হয়ে গেলে আমরা এগুলো দ্রুতই সরিয়ে নেব।”
মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে সড়কের ফুটপাত দখল করে নানকের প্রচার ক্যাম্প বানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম রাস্টন।
নিয়ম ভেঙে ক্যাম্প করার বিষয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদুর রহমান বিপ্লব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের নির্বাচনি এলাকায় কিছু ক্যাম্প নিয়ে আপত্তি আসার পর ম্যাজিস্ট্রেট সেগুলো সরিয়ে দিয়েছেন। আমরা নিজেরাও অনেকগুলো ক্যাম্প সরিয়ে ফেলেছি।
“শংকরে তিনটি এলাকার ক্যাম্প একসঙ্গে পড়ে গেছে। কোনো ক্যাম্প নিয়ে আপত্তি থাকলে আমরা সরিয়ে ফেলব।”