এখনও হাজামের হাতে ঝুঁকিপূর্ণ খতনা, চিত্রটা ভয়াবহ

অবৈজ্ঞানিক উপায়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া খতনা করাতে গিয়ে প্রায়ই পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলাসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে না বললেই চলে।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2024, 07:40 PM
Updated : 11 March 2024, 07:40 PM

দুই শিশুর মৃত্যুতে হঠাৎ করেই আলোচনায় শিশুদের খতনা। যদিও বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে হাজাম বা খলিফাদের মাধ্যমে সনাতন পদ্ধতিতে ছোট এই অস্ত্রোপচারটি করা হচ্ছে।

তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম শিশুদের খতনার কাজটি চিকিৎসকরাও করছেন। আর সম্প্রতি চিকিৎসকদের হাতেই খতনা করাতে গিয়ে মারা যায় দুটি শিশু।

চিকিৎসকরা বলছেন, প্রতি বছর যত বিপুল সংখ্যক ছেলে শিশুর খতনা করান হাজাম বা খলিফারা। অবৈজ্ঞানিক উপায়ে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া খতনা করাতে গিয়ে প্রায়ই পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলাসহ নানা দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ। এসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে আসে না বললেই চলে।

পরিস্থিতি কেমন

দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এবং চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন-বিডিএফের সহযোগিতায় গত কয়েকদিন ধরে হাজামদের দিয়ে খতনা করাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার অন্তত ত্রিশজন শিশুর খোঁজ পেয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই গত এক মাসে ১৪টি শিশু এসেছে খতনা পরবর্তী জটিলতার চিকিৎসা নিতে।

চিকিৎসকরা বলছেন, বাস্তব পরিস্থিতি আরও খারাপ। অনেক শিশুই সরকারি হাসপাতালে আসে না। এলেও অনেকে বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা নিয়ে চলে যায়, তাদের তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে কামরাঙ্গীরচরের ছয় বছর বয়সী মোহাম্মদ সাঈদ এবং ফরিদপুরের সদরপুরের ছয় বছর বয়সী ফারহান খান নামে দুটি শিশু ভর্তি হয়। দুজনের খতনা হয়েছে হাজামের হাতে। সাঈদের অতিরিক্ত রক্তপাত হচ্ছিল, আর ফারহানের জননাঙ্গের চামড়া প্রায় পুরোটাই কেটে ফেলা হয়েছে।

হাসপাতালে ফারহানের নানা শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তিনি হাজামকে বারবার বলছিলেন এত গোড়ায় না কাটতে। কিন্তু হাজাম তার কথা শোনেনি।

“চামড়া কাটার পরে আমার নাতি চিৎকার দিয়া প্রায় বেহুঁশ হইয়া গেছে। আমার চার-পাঁচজনেও তারে ধইরা রাখতে পারতেছিলাম না। পরে কাপড় দিয়া বাইন্ধা, একটা ইনজেকশন দিয়া হাজাম চইলা যায়। তিনদিন পর বাঁধন খুইলা দেখি ঘা হইয়া গ্যাছে। দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়া গেলে ডাক্তার কয় ঢাকা মেডিকেলে নিয়া আসতে।”

তিনি বলেন, হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর খবর শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তারা। সেজন্য হাজাম ডেকেছিলেন।

“ভয়ে হাজাম দিয়া করাতেই চাইছিলাম। মনে করলাম এইটা তাদের পেশা। কিন্তু হাজাম আমার নাতির জীবনডাই শ্যাষ কইরা দিল।”

ফারহানের সার্জারি করেছেন যে চিকিৎসক, তিনি বলেন, পুরুষাঙ্গের চামড়া প্রায় পুরোটাই কেটে ফেলায় শিশুটির পরবর্তী স্বাভাবিক যৌনজীবন আর থাকবে না।

এ বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে এ ধরনের ১৪টি শিশুর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। যেসব শিশু তাৎক্ষণিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে তাদের তথ্য রাখা হয়নি।

ওই ওয়ার্ডের একজন চিকিৎসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রতিদিনই ওই ওয়ার্ডে গড়ে একটি শিশু আসে এ ধরনের সমস্যা নিয়ে।

হাজামের হাতে খতনার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে ফেব্রুয়ারির শেষে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় নাটোর সদর উপজেলার জামাল উদ্দিনের ৬ বছর বয়সী ছেলে রাজনকে।

চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখেন, হাজাম খতনা করানোর সময় শিশুটির জননাঙ্গের একটি রক্তনালী কেটে ফেলায় এই রক্তপাত।

শিশুটির বাবা বলেন, “খতনা করার পর সে ভালোই ছিল। কিন্তু রাতে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তার সার্জারি করেছেন চিকিৎসকরা।”

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. নওশাদ আলী বলেন, “হাজাম তো জানে না রক্তনালী কোনটা, রক্তনালী বাঁধতে হবে। অনেক সময় চেপে ধরলে ব্লিডিং বন্ধ হয়ে যায়, এটা হয়নি। আমাদের এখানে সার্জারি করে তার ব্লিডিং বন্ধ করা হয়েছে।

“শীতের সময় এ ধরনের কেইস প্রতি সপ্তাহে দুই-একটা পাই আমরা। হাজামরা প্রশিক্ষিত না, তাদের চিকিৎসাজ্ঞানও নাই। এজন্য তাদের দিয়ে খতনা করলে এ ধরনের ঘটনা ঘটবেই।”

ফেব্রুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে সিয়াম নামে সাত বছর বয়সী এক শিশুর খতনা করাতে গিয়ে হাজাম শিশুটির পুরুষাঙ্গের চামড়ার বেশিরভাগ কেটে ফেলেন। সংক্রমণ হলে শিশুটিকে আড়াইহাজার জেনারেল হাসপাতালে নামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়।

শিশুটিকে চিকিৎসা দেওয়া এম এম মাহফুজুর বলেন, “খতনা করাতে গিয়ে অনেক বেশি স্কিন কেটে ফেলেছিল। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চিকিৎসা দিচ্ছি। এখন একটু উন্নতির দিকে। কিন্তু ওই বাচ্চার পেনিসে স্কিন ড্রাফটিং করাতে হবে।”

সাভারের কবিরপুরের আবুল কালাম আজাদের সাত বছর বয়সী ছেলে জোবায়ের হোসাইন নোমানের খতনা করান স্থানীয় একজন হাজাম। শিশুটির রক্তপাত শুরু হলে পরদিন সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান অভিভাবকরা।

ওই শিশুটির চিকিৎসা দেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. মো. রাশেদুজ্জামান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, শিশুটির পুরুষাঙ্গের চামড়া কাটার সেটি কাপড় দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল। বাঁধন খুলে দিলে রক্তপাত শুরু হয়েছে।

“শিশুটির বাবা আমাকে জানিয়েছেন, হাজাম তাকে পরামর্শ দিয়েছে নারিকেল তেল দিয়ে ওই অংশটি বেঁধে দিতে। তবে তারা বুদ্ধি করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। যদি এরকম ব্লিডিং হতেই থাকত তাহলে শিশুটি শকে চলে যেতে পারত। আমাদের কাছে এ ধরনের কেইস প্রায়ই আসে।”

সোহেল খলিফা নামের ওই হাজামের সঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তিনি বলছেন, বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজ করে আসছেন।

“আমার দাদা, বাবাও এই কাজ করেছেন। আমরাও দুই ভাইও তাই করি। বাচ্চাদের খতনা করানোর আগে ইনজেকশন দিই। খতনা করানোর পর শিশুটি ভালোই ছিল। অবস্থা একটু খারাপ হইছিল, তার বাপকে বলছিলাম আপনি একটু বাসায় থাকেন, আমি আসতেছি। কিন্তু আমার কথা না শুইনা তারা হাসপাতালে চলে গেছে।”

হাজাম দিয়ে খতনা করাতে গিয়ে পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা পাঁচ বছর বয়সী এক শিশুর চিকিৎসা দিয়েছেন ঢাকার বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল আলম। সাম্প্রতিক ওই ঘটনার ছবি ও অন্যান্য তথ্য দিয়েছেন তিনি। তবে সেগুলো প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

ডা. রাশেদুল আলম বলেন, “তার পেনিস ব্যান্ডেজ করে নিয়ে আসা হয়েছিল। ব্যান্ডেজ খুলে আমরা দেখতে পাই পুরুষাঙ্গের প্রায় এক সেন্টিমিটার অংশ প্রস্রাবের রাস্তাসহ কেটে ফেলা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে ওই শিশুর এক আত্মীয় ওই কাটা অংশটি হাতে করে নিয়ে আসে। ওটিতে নিয়ে আমরা প্লাস্টিক সার্জারি করে দিই। ভাগ্যক্রমে সেটা সফল হয়।”

“এগুলো অহরহই হচ্ছে। সে কারণে ডকুমেন্টস রাখি না। এ ধরনের কেইস প্রায়ই আসে।”

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক কামরুল হাসান বলেন, তাদের হাসপাতালে প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের খতনা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে শিশুরা আসে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তারাকান্দা থেকে একটি শিশু আসে যার অবস্থা ছিল খুব খারাপ।

“হাজাম পেনিসের চামড়া অনেক বেশি কেটে ফেলেছিল। প্রচণ্ড রক্তপাত শুরু হলে সেটা আর বন্ধ করতে পারেনি। ফলে কাপড় পেঁচিয়ে আমাদের এখানে নিয়ে আসে। আমাদের এখানে ভর্তি করে চিকিৎসা দিই। ২২ ফেব্রুয়ারি শিশুটি বাসায় চলে যায়।”

এরপর গত ৬ মার্চ ওই হাসপাতালের শিশু সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি হয় সাদিদ নামে ছয় বছর বয়সী আরেক শিশু। তারও খতনা করানোর সময় পুরুষাঙ্গের চামড়ার বেশি কেটে ফেলা হয়েছিল।

চিকিৎসকরা জানান, পুরুষাঙ্গের রক্ত প্রবাহ সচল রাখে ফেনোলার আর্টারি (ধমনী) এবং ডর্সাল ভেইন (শিরা)। পুরুষাঙ্গের নিচের দিকে থাকে শিরা, উপরের দিকে ধমনী। পাশাপাশি অনেকগুলো ছোট ছোট ক্যাপিলারি (রক্তনালীর শাখা প্রশাখা)। 

খতনা করাতে গিয়ে এসব ধমনী ও শিরা কাটা পড়ে। দক্ষতা থাকলে ধমনী এবং শিরা না কেটেও খতনা করানো সম্ভব। রক্তপাত বন্ধের জন্য চিকিৎসকরা সেলাই এবং ইলেকট্রো কটারির (ডায়াথার্মি) মাধ্যমে রক্তপাত বন্ধ করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু হাজামদের কাছে এই প্রযুক্তি থাকে না।

হাসপাতালে সব শিশুর খতনা সম্ভব?

সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩২ লাখ শিশু জন্মায়, যাদের ৯০ শতাংশ জন্মায় মুসলমান পরিবারে।

সে হিসাবে মোটা দাগে ২৮ লাখ ৮০ হাজার মুসলিম শিশুর অর্ধেক, অর্থাৎ ১৪ লাখ ৪০ হাজার ছেলে। তার মানে হল, প্রতি বছর ১৪ লাখের মত শিশুর খতনা করানো হয়।

শিশু সার্জনরা বলছেন, বাংলাদেশে যত খতনা হয়, তার মাত্র ১০ শতাংশ করেন চিকিৎসকরা। বাকি প্রায় ৯০ শতাংশ খতনাই করাচ্ছেন হাজাম, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, স্বাস্থ্য সহকারী, পল্লী চিকিৎসক এবং বিভিন্ন ওষুধের দোকানদাররা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আশরাফ উল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “খতনা ছোট হলেও এক ধরনের অস্ত্রোপচার। যে কোনো অস্ত্রোপচারের জন্য দরকার পরিচ্ছন্নতা, জীবাণুমুক্ত পরিবেশ। এছাড়া হাজামদের অ্যানাটমিক্যাল (শারীরবিদ্যা) শিক্ষা নেই। কোথায় ধমনী, কোথায় শিরা, চামড়ার কতটুকু অংশ কাটতে হবে, তা হাজামদের জানার কথা নয়।

“অপরিচ্ছন্নভাবে খতনা করায় বলে ইনফেকশন হয় অনেক। চিকিৎসকরা খতনা করার আগে সার্জিক্যাল কলম দিয়ে মার্কিং করে নেন, সে হিসাবে কাটা হয়। কিন্তু বিষয়গুলো জানা না থাকায় হাজামরা কম বা বেশি কেটে ফেলে। খতনার উদ্দেশ্য হল ওই স্থানটি যেন পরিষ্কার থাকে। কম কাটলে প্রস্রাব করার পর ওই স্থানে প্রস্রাব, ময়লা জমে থাকে।”

ওই চিকিৎসক বলেন, ঢাকায় খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃত্যুর পর বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের ‘নেতিবাচক প্রচার’ হয়েছে। তাতে খতনার জন্য চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার আগ্রহ আরও কমে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। সেটা হলে ক্ষতি হবে দীর্ঘমেয়াদী।

বাংলাদেশে প্রতি বছর যত শিশুর খতনা হয়, হাসপাতালে বা চিকিৎসকের মাধ্যমে তা করার মত জনবল আছে কি না জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, চিকিৎসক হিসেবে তিনি হাজামদের দিয়ে খতনা করানোর বিপক্ষে।

তার দাবি, সারাদেশে ছেলে শিশুদের খতনা করানোর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসক এবং জনবল দেশে রয়েছে।

“প্রশিক্ষিত চিকিৎসক দিয়ে, ভালো জায়গায় খতনা করানো উচিত। প্রতিটি জেলা, উপজেলা হাসপাতালে এই সুবিধা আছে। আমার মনে হয় না তাদের খতনা করাতে কোনো অসুবিধা হবে।”

প্রশিক্ষণহীন হাজামদের দিয়ে খতনা করানো বন্ধে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা, অথবা হাজামদের প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হবে কিনা, এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি বিষয়টি নিয়ে এখনও অবগত নই, তাদের বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ আছে কি না। বিষয়টি আমি দেখব।”