গুলশানের সেই ভবনে ‘সব ছিল’, তারপরও …

আগুন লাগলে কী করতে হবে তা নিয়ে যে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না বাড়ির বাসিন্দা ও কর্মীদের।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2023, 07:34 PM
Updated : 20 Feb 2023, 07:34 PM

ঢাকার অন্য এলাকার মতো গায়ে গা লাগা অট্টালিকার ভিড় নেই আশপাশে, বাড়ির চারদিকে যথেষ্ট ফাঁকা জায়গা, সামনে প্রশস্ত নগর সড়ক, ছিল অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থাও। তবুও গুলশান ২ নম্বর সেকশনের ১০৪ নম্বর বাড়িটি লাগা আগুন নেভাতে লেগে গেছে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা।

সেই বিভীষিকার মুহূর্তে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন, একজন গুরুতর অবস্থায় বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। এর বাইরেও কয়েকজন চিকিৎসা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন।

১৯ কাঠা জমির উপর নির্মিত নানা সুবিধাসম্পন্ন এই বাড়িতে দেখা গেছে আগুন নেভানোর ফায়ার হাইড্রেন্ট; কিন্তু জরুরি সেই মুহূর্তে তা কোনো কাজেই আসেনি। আগুন লাগলে কী করতে হবে তা নিয়ে যে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না বাড়ির বাসিন্দা ও কর্মীদের।

সেই আক্ষেপ ঝরেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের কণ্ঠেও। ভবনটি পরিদর্শনে এসে সোমবার দুপুরে তিনি বললেন, “অ্যাওয়ারনেস, অ্যাওয়ারনেস, অ্যাওয়ারনেস। এখানে আমি নিজে এসেছি, আমার ইঞ্জিনিয়ার পাঠিয়েছিলাম; দেখা গেছে- বিল্ডিং কোড মেনেই তারা ভবন করেছে, ফায়ার সেফটি আছে, ইমার্জেন্সি এক্সিট আছে। তার মানে কী? সবকিছুই আছে, কিন্তু কিছুই নাই।”

মেয়র বলেন, “তারা সবকিছু করেছে। এই ভবন যেমন সুন্দর, যারা ছিলেন এই বাড়িতে, তারা শিক্ষিত, যথেষ্ট সম্পদশালী, সমাজের নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত মানুষ। তারাও কিন্তু আটকে গেছেন। কাজেই কে কবে আটকাবে তার কোনো ঠিক নাই।

“এখানে এত সুন্দর সিকিউরিটি, এত সুন্দর বাড়ি, কিন্তু যারা থাকবে, ইমারজেন্সি হলে তারা কী করবে, তা কি তারা জানত? সিঁড়ি, পাম্প সবই আছে- কিন্তু সেটা চালাবে কে? তাদের কি ফায়ার ড্রিল সার্টিফিকেট ছিল? কারখানায় আমরা ঠিকই এটা রাখছি, কিন্তু বাড়িতে রাখছি না।”

গুলশানের ১৩ তলা ওই ভবনে রোববার সন্ধ্যা ৭টায় আগুন লাগার পর চার ঘণ্টার বেশি সময়ের চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আবাসিক ওই ভবনের নিচ তলা বাদে উপরের ১২ তলায় ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটগুলোতে কয়েকটি পরিবারের বসবাস। আগুন ছড়িয়ে পড়লে ভবনের বিভিন্ন তলায় অনেকে আটকা পড়েন। উপরের দুটো ফ্লোরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক ফাহিম সিনহার বাসার ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে পড়েন কয়েকজন।

তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেনকে (৩০) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি ফাহিম সিনহার বাসায় বাবুর্চির কাজ ও বাজার করতেন।

ওই বাসার আরেক বাবুর্চি মোহাম্মদ রাজিব ওরফে রাজুকে গুরুতর আহত অবস্থায় রোববার রাতেই জেড এইচ শিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখানেই রাত ৩টার দিকে তার মৃত্যু হয়। রাজুও আগুন থেকে বাঁচতে লাফিয়ে পড়েছিলেন।

আর ফাহিমের স্ত্রী সায়মা রহমান সিনহার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

‘দুয়ার খুলছিল না নিরাপত্তা ইস্যুতে’

রাতে ফায়ার সার্ভিস ওই ভবনের আগুন নেভানোর পর মধ্যরাত থেকে সিলগালা করে দেওয়া হয় সেই ভবন। সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কাউকেও। ওই ভবনে যে বাসিন্দারা থাকতেন, তারা নিজেদের আত্মীয়দের বাসায় আশ্রয় নেন।

তবে আগুন লাগার পরপর ফায়ার সার্ভিস আসার আগে সেখানে জড়ো হয়েছিলেন যেসব সাধারণ মানুষ, তারা অভিযোগ করছেন, আগুন লাগার পর নেভাতে যারা এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তাদের কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি ‘নিরাপত্তার’ কথা বলে। এদের মধ্যে ছিলেন কমিউনিটি ফায়ার ফাইটারও।

আগুন লাগার খবরে সেখানে জড়ো হওয়া স্থানীয় দুই যুবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা এসে পানি নিয়ে ঢুকতে চেয়েছেন, তবে নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের ঢুকতে দেয়নি। ভেতরে যেতে পারলে কিছু একটা করতে পারতেন বলেই ধারণা তাদের।

একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের কর্মী মুর্শেদ হাসান বলছিলেন, “আমরা যাওয়ার সময় দেহি লোকজন ব্যালকনিতে খাড়ায়া লাইট মারতাছে। ফায়ার সার্ভিস সেদিকে যাইতে পারতাছে না। থাকতে না পাইরা লোকেরা লাফ দিতেছে। কিন্তু দারোয়ান আমাগো ঢুকতে দেয় না। পরে আমরা ৪০-৫০ জন বাড়ির গেট ভাইঙা ঢুকছি।”

এ বিষয়ে ভবনটির নিরাপত্তারক্ষীদের জিজ্ঞেস করলে তারা সাংবাদিকরা বলেন, ফায়ার সার্ভিস তো আসছিল, সাধারণ মানুষ ঢুকে কী করবে?

আগুন লাগার পর কী করতে হবে, তা জানা আছে কি না- এ প্রশ্নে তারা জানান, এমন ধারণা বা প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না।

ঘটনাস্থলে প্রথম যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার ফরহাদুজ্জামান বলছেন, “সেখানে যাওয়ার পর কোনো তথ্যই দিতে পারেননি ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরা। কোথায়, কোন তলায় আগুনটা লেগেছে, সেটাও তারা বলতে পারছিলেন না।”

ঘটনার সময় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাশের বাড়ি থেকেও সহযোগিতা করা হয়নি জানালেন এক প্রত্যক্ষদর্শী।

গুলশান ১ নম্বরের এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সাইফুল ইসলাম সেলিম বলেন, “অফিসের দিকে যাওয়ার পথেই আগুন দেখতে পেয়ে থামি। পরে ৭টা থেকে ১টা পর্যন্ত ছিলাম। যতটা পেরেছি সাহায্য করেছি। প্রথমে যখন আগুন লাগে, তখন তারা (বাসিন্দারা) মনে করেছিল, এটি সাধারণ আগুন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বাড়িটি থেকে ব্লাস্ট হওয়ার মতো শব্দ আসতে থাকে। সেখানে এসি ছিল নাকি সিলিন্ডার তা জানি না।

“ফায়ার সার্ভিস আসার পর পাশের ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিক গেইট খুলছিল না, ঢুকতে দিচ্ছিল না পরে গেইট ভেঙে ঢুকতে হয়েছে। আগুন তো তার বাড়িতেও আসতো পারত। পরে পেছনের আরেক বাড়ি থেকে পানি এনে, পানি দেওয়া হয়েছে।”

যে বাড়িতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করা হচ্ছে তার নিরাপত্তারক্ষী আলম দেওয়ান বলেন, “আগুন কখন লাগছে তা তো আমরা বলতে পারি না। ফায়ারের লোক আসছে, আমাদের এদিকে গাছ কাটছে তাও আমাদের গেইট দিয়ে ফায়ারের গাড়ি ঢোকে না।

“আমাদের ছাদে তো দোচালা, এখানে তো দাঁড়ানোর মতো না। পরে ওই বাসা (আগুন লাগা ভবনের পেছনের বাসা) থেকে যখন পানি মারছে- তখন আগুন নিভছে, কিন্তু কাজ যা হওয়ার তার আগেই হয়ে গেছে।”

কীভাবে লাগতে পারে আগুন?

গুলশানের ওই ভবনে আগুন লাগার পরদিন বেলা ১১ টার আশপাশে সেখানে আসেন নিউ এইজ নামে একটি পোশাক কারখানার ডিজিএম মাহফিজুল হাসান। নিউজ এইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ ইব্রাহিমের ফ্ল্যাট দেখতে সেখানে আসেন তিনি।

সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরলে মাহফিজুল বলেন, “আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। এই ভবন যখন করা হয়, তখন আমি এখানে ছিলাম। একটা ভবন নিরাপদ করার জন্য যা যা করার দরকার, সবই এখানে করা হয়েছে। আমাদের এখানে নিজস্ব হাইড্রেন্ট ছিল, ইন্ডাকশান সিস্টেম ছিল, এর সবই ফাংশনাল ছিল।

“যখন আগুনটা লেগেছে তখন অটোমেটিক অ্যালার্ম বেজেছে। আগুন নিচের দিকে ছিল। তিন বা চার নম্বর ফ্লোরে। সবাই যদি সিঁড়ি দিয়ে নামত, তাহলে নিরাপদ থাকতে পারত।”

আগুন তাহলে ছড়াল কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এই বাসার পুরোটা সেন্ট্রাল এসি, রিমোট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রথমে গেছে ধোঁয়া। এসির মাধ্যমে ছড়াতে পারে।”

আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে মেয়র আতিক বলেন, “ভবনটি বিল্ডিং কোড মেনেই করা হয়েছে। কিন্তু ডাক্টিং লাইন ও ইলেক্ট্রিক লাইন একই পাইপে উঠেছে। দুই লাইনের মাঝে সেপারেশন থাকে। সেটা যদি না থাকে বা মাঝে যদি কোনো দাহ্য পদার্থ থাকে, তাহলে কিন্তু সেপারেশন হল না।

“সেটা আমি ইঞ্জিনিয়ার ও ফায়ার সার্ভিসকে দেখতে বলেছি। সেন্ট্রাল এসি ছিল। সেটা থেকে কোনো কারণে আগুনের ঘটনা ঘটেছে কি না, সেটা তদন্ত হবে। ফায়ার সার্ভিস আগুনের কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি করেছে।”

বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে গুলশানের সেই বাড়িটিতে আগুন লেগে থাকতে পারে বলে ফায়ার সার্ভিসের কাছ প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ কমিশনার মো. আ. আহাদ।

তিনি বলেন, "ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে এই ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে৷ বাকিটা ফায়ার সার্ভিস তাদের তদন্তের মাধ্যমে জানাবে। আর ভবনে কোনো ত্রুটি ছিল কি না তা ফায়ার সার্ভিস ও রাজউক দেখবে।"

Also Read: গুলশানে অগ্নিকাণ্ড: ফিটফাট ভবনের আড়ালে ‘অনেক দুর্বলতা’

Also Read: গুলশানের আবাসিক ভবন নরককুণ্ড, ১ জনের মৃত্যু

Also Read: গুলশান অগ্নিকাণ্ড: লাফিয়ে পড়ে আহত আরেকজনের মৃত্যু

Also Read: গুলশান আগুন: ফাহিম সিনহার স্ত্রী আইসিইউতে

এই অগ্নিকাণ্ড তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ৫ সদস্যের যে তদন্ত কমিটি করেছে, তার প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল। সোমবার বিকালে তিনি তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিয়ে ভবনটি ঘুরে দেখেন।

তাজুল ইসলাম বলছেন, “এই ভবনটি কিন্তু খুবই অত্যাধুনিক একটা ভবন। কিন্তু আমরা তদন্ত করে বুঝলাম- এখানে অনেক রকমের সমস্যা আছে। এখন এগুলো হয়ত আমরা বলছি না।”

আগুনের সূত্রপাত কোত্থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সূত্রপাতের কথা এখনি আমি বলব না। এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কারণ প্রতিটি জিনিসই পাশপাশি অবস্থানে রয়েছে।

“গ্যাসের পয়েন্ট আছে যেখানে, তার পাশেই বিদ্যুতের পয়েন্টও রয়েছে। এর পাশাপাশি প্রচুর দাহ্যবস্তু রয়েছে সেখানে। কোনটা থেকে আগুনটা শুরু হয়েছে- এটা বোঝা যাচ্ছে না।”

তবে ভবনটির ইন্টেরিয়র ডিজাইনে ব্যবহৃত বোর্ডগুলো দাহ্য হিসেবে কাজ করেছে বলে জানান তিনি।

যে কারণে ১১ তলা থেকে লাফ

প্রত্যক্ষদর্শী ইমরান হোসেন নামের এক গাড়ি চালক বলেন, “ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা শুরুতে যখন আসে, তখন বাসার সামনের দিকের মানুষদের নামাচ্ছিল। কিন্তু যে পাশ থেকে চারজন লাফ দিয়েছে, সেদিকে যেতে পারছিল না। তারা প্রায় আড়াই ঘণ্টা সেখানে দাঁড়ানো ছিল। মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে সিগনাল দিচ্ছিল।

“কেউ তাদের নামাচ্ছিল না। কী অবস্থা- না দেখলে বোঝা যাবে না। লাফ যে দিছে- বিমের ওপর যদি পড়ত, তাহলে নিশ্চিত মারা যেত। তারা লাফ দেওয়ার পর চারিদিকে চিৎকার, তখন দেখলাম একদম সব বাহিনী চলে আসছে।”

একমি গ্রুপের এমডির গাড়িচালক শামসুদ্দিন বলেন, “তারা (ফায়ার সার্ভিস) এসে গাড়ি প্লেস করার পর দূর থেকে পানি দিচ্ছিল, সেই পানিতে কোনো কাজ হচ্ছিল না। ফায়ার সার্ভিস আসার পর তাদের আমরা বললাম- গাছটা কেটে পানির পাইপ ওদিকে দেন। তারা লেট করছিল, আগুন বাড়তেছিল।

“ভাবি (সায়মা রহমান) তখন দাঁড়িয়ে ছিল বেলকনিতে। আমরা নিচ থেকে দেখছিলাম দশ তলা থেকে আগুন যখন একদম লাল হয়ে ১১ তলায় আসছে, তখন আর টিকতে না পেরে বেলকনির শেষপ্রান্তে এসে ভাবি আর কাজের লোকগুলো জড়ো হয়েছে, তারা দাঁড়াতে পারছিল না। সইতে না পেরে আনোয়ার আর রাজু লাফ দিল। পরে কাজের মেয়ে লাফ দিল, শেষে ভাবি লাফ দিছে।”

আগুন শুরু চারতলা থেকে

আগুন লাগা বাড়িটির ১১, ১২ ও ১৩ তলার সব কিছু পুড়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। নিচের দিকে পুড়লেও ক্ষতি হয়েছে তুলনামূলক কম।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগুন শুরু হয়েছে চারতলা থেকে। চারতলা থেকে শুরু করে ১১তলা পর্যন্ত পুরোটাই পুড়ে গেছে। ভবনের মাঝের অংশগুলো বেশি পুড়েছে, ভেতরের দিকে ঢুকেনি। কিন্তু ১১তলার ভেতর পর্যন্ত আগুন ঢুকেছে।

“অন্য তলাগুলোর কিছু কিছু রুমের দরজা লাগানো ছিল। যেগুলোতে ফায়ার সেফটি দরজা, সেগুলোতে আগুন ঢুকতে পারেনি। ফলে সেখানে সেফ হয়েছে। অন্যগুলো পুড়ে গেছে। ১১তলায় যেসব দরজা দেখলাম, সেগুলো ভালো, কিন্তু ফায়ার ডোর না। ফায়ার ডোর থাকলে ফায়ার ভেতরে ঢুকে না, ফলে লাইফ সেফ হয়।”

বাড়ির হাল যা দেখলেন তারা

আগুন লাগার পরদিন দুপুর থেকে ভবনটিতে ঢুকতে শুরু করেন ফ্ল্যাটগুলোতে থাকা বাসিন্দারা। তবে বেশিরভাগই নিজেরা না এসে প্রতিনিধি পাঠান। তাদের প্রতিনিধিরা এসে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীদের নিয়ে উপরে গিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাট বুঝে নেন।

বাড়িটি দেখতে এসেছিলেন ভবনটির নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করা কণা এন্টারপ্রাইজের মালিক এনামুল হক কালাম। তিনি বলেন, “এই ভবনের মালিক বিএনপির সাবেক এমপি ফেনী-৩ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য ও ফেনী জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ও তার সাথে আরেকজন আছেন মো. জাকির হোসেন। এখানে ২৬টি ফ্ল্যাট আছে। কিছু বিক্রি হয়েছে আর বাকিগুলো তারা ভাড়া পান।

“আইন অনুযায়ী সব ব্যবস্থাই এখানে আছে। রাজউক সার্টিফিকেটে অবশ্যই দিয়েছে। নতুন ভবন এটা ২০১১-১২ সালের দিকে হয়েছে।”

গুলশান জোনের ডিসি আ. আহাদ দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, “বর্তমানে ফ্ল্যাট মালিকদের নিয়ন্ত্রণে আছে। পুলিশ এখানে নিরাপত্তার কাজে আছে। পুলিশের কেউ উপরে যাচ্ছে না। ফলে ভেতরের অবস্থা আমরা জানি না।

“ফ্ল্যাটমালিকরা আসছেন, তাদের এখানে ভবনের যে সিকিউরিটি আছে- তাদের নিয়ে উপরে উঠে ফ্ল্যাট বুঝে নিচ্ছেন।"

ফ্ল্যাট ঘুরে এসে মালিকদের কয়েকজন প্রতিনিধিরা জানান, যেসব ফ্ল্যাটে আগুন গেছে, সেগুলো পুড়ে গেছে।

ফাহিম সিনহার ফ্ল্যাট ঘুরে আসা দুই প্রতিনিধি জানান, ভেতরে কিছুই আর পোড়ার বাকি নেই। আগুনের পর ফায়ারের পানিতে সব ওলটপালট হয়ে গেছে।

মেয়র আতিকুল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এলে সাংবাদিকরা খুবই অল্প সময়ের জন্য ভেতরে ঢোকার সুযোগ পান। তখন ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, ভবনটির আন্ডারগ্রাউন্ডে যেসব গাড়ি পার্ক করা ছিল, সেগুলো নিজস্ব লোক দিয়ে বের করে নিচ্ছেন ফ্ল্যাট মালিকরা। ফ্ল্যাটে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল কেউ কেউ গাড়ির পেছনে তুলে নিচ্ছিলেন। ভবনের নিচে জড়ো করে রাখা হচ্ছিল লাগেজ, ব্যাগ, বস্তা। সেখানে দেখা মিলছিল শাকসবজি, মাছ-মাংস, পোশাক, কাগজপত্রসহ নানাকিছুর।

ভবনের এক গৃহিণী মেয়রকে দেখে বলেন, “আমি এখানে নিরাপদ বোধ করছি না। আতঙ্ক কাজ করছে। বিদ্যুৎ নেই, কিছু নেই।”

‘উৎসুক জনতাই’ তৈরি করে প্রতিবন্ধকতা

ঘটনার রাতে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ভিড় সামলাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে তাদের।

“আমি জনগণের উদ্দেশে বলব- ক্রাউড কন্ট্রোল আমাদের এত কষ্ট দিয়েছে যে আমাদের কাজ করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। আমরা কাজ করেছি। কিন্তু উৎসুক জনতা খুবই মুশকিল হয়ে উঠেছিল।”

ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের গঠিত কমিটির প্রধান ও সংস্থাটির পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম সোমবার পোড়া ভবনটি পরিদর্শন শেষে বলেন, “এই এলাকায় যে হাইরাইজ ভবনগুলো আছে, তার আশপাশের রাস্তার প্রশস্ততা কিন্তু খুবই কম। আমাদের টার্ন টেবিল ল্যাডারটা বহন করে অনেক বড় একটা গাড়ি। এই বড় গাড়িটা আমাদের বিভিন্ন স্টেশন থেকে এখানে আসছে।

“ল্যাডারটা যখন ওপরে উঠেছে তখন গাছপালা, তার অথবা ভবনের কারণে ল্যডারগুলো ঠিকমতো ডিসটেন্স (নাগাল) পাচ্ছিল না। আমাদের ল্যাডারগুলো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে কাজ করে। আপনারা দেখেছেন, আমরা বিভিন্ন দিক থেকে ওই ল্যাডার দিয়ে তাদের রেসকিউ করার চেষ্টা করি। আমরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও নবজাতকসহ ২২ জনকে উদ্ধার করি।”

তাজুল বলেন, “এটা নিয়ে অনেক কথা হয়। সাধারণ জনগণ তো আমাদের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো বুঝবে না। টার্ন টেবিল ল্যাডার কীভাবে কাজ করে- এটা তো তাদের বোঝার কথা না।”

অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণ ও মহড়ার উপর জোর দিয়ে মেয়র আতিকুল বলেন, “যে যাই বলুক, আমাদের ফায়ার সার্ভিসসহ সব বাহিনী দারুণ কাজ করেছে। একটা জিনিস আমি দেখলাম, যেখানেই আগুন লাগে মানুষ এসে সেলফি তুলে, লাইভ করে।

“আমাদের উদ্ধারকাজ আরও আগে শেষ হতে পারতো। আমাদের ফায়ারকর্মীরা উপরে ওঠার জন্য তাদের যে সরঞ্জামাদি আনবে, সেটা গতরাতে উৎসুক মানুষের ভিড়ের কারণে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। যত দ্রুত রাস্তা ক্লিয়ার হবে, তত দ্রুত উদ্ধার কাজ শেষ হবে।”

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোলাম মর্তুজা অন্তু]