গুলশানে অগ্নিকাণ্ড: ফিটফাট ভবনের আড়ালে ‘অনেক দুর্বলতা’

অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনও বের করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2023, 12:41 PM
Updated : 20 Feb 2023, 12:41 PM

ঢাকার গুলশানে যে ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তা দেখতে সুদৃশ্য হলেও নিরাপত্তার দিক থেকে অনেক ঘাটতি খুঁজে পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

আগুন লাগার পরদিন সোমবার ভবনটি ঘুরে দেখেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী।

পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটি আপাতদৃষ্টিতে খুব অত্যাধুনিক হলেও এর নিরাপত্তার ‘ল্যাপস ছিল’।

“এই ভবনটি কিন্তু খুবই অত্যাধুনিক একটা ভবন। কিন্তু আমরা তদন্ত করে বুঝলাম, এখানে অনেক রকমের সমস্যা আছে।”

গুলশানের ১৩ তলা ওই ভবনে রোববার সন্ধ্যায় আগুন লাগার পর চার ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিস। আগুন থেকে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে দুজনের মৃত্যু ঘটে। 

আবাসিক ওই ভবনের নিচতলা বাদে উপরের ১২ তলায় ছয়টি ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে কয়েকটি পরিবারের বসবাস।

এই অগ্নিকাণ্ড তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ৫ সদস্যের যে তদন্ত কমিটি করেছে, তার প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল। সোমবার বিকালে তিনি তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিয়ে ভবনটি ঘুরে দেখেন।

‘অনেক রকম’ নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল জানালেও সে বিষয়ে বিষদ কিছু এখনই বলতে চাননি তাজুল।

ভবনের জরুরি নির্গমন পথ কিংবা অগ্নি নির্বাপনী সরঞ্জাম ছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা এখনও বলছি, এই ভবনের বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। তদন্তের পরবর্তী ধাপে হয়ত আমরা আরও কিছু পাব। কিন্তু আমরা তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলছি না।”

ভবনটির কোনো ‘ফায়ার সেইফটি প্ল্যান’ ছিল না জানিয়ে তাজুল সাংবাদিকদের বলেন, “তারা যেসময় ভবনটি করা শুরু করেছেন, তখন ফায়ার সেইফটি লাইসেন্স বলে কিছু ছিল না। সেজন্য তারা একটি নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে আমাদের অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপন আইন অনুযায়ী এখানে ফায়ার সেইফটি প্ল্যান নেওয়ার কথা ছিল। যেটা উনারা নেননি।”

ভবনের বাসিন্দাদের অগ্নি নির্বাপনী প্রশিক্ষণ এবং মহড়ার অভিজ্ঞতাও ছিল না বলে জানান তিনি।

Also Read: গুলশানে ভবনে আগুন, ১ জনের মৃত্যু

Also Read: গুলশান অগ্নিকাণ্ড: লাফিয়ে পড়ে আহত আরেকজনের মৃত্যু

Also Read: গুলশান অগ্নিকাণ্ড: লাফিয়ে পড়ে মারা যাওয়া আনোয়ারের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা

মহড়া না হওয়ার কারণে উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা দুটি ঘটেছে বলে মনে করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল।

তিনি বলেন, “দুজন মারা গেছেন, কিন্তু আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল তাদের বাঁচানোর জন্য। যে দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন, সেটাও নিজেদের দোষে। উনাদের কিন্তু আমরা বারংবার নিষেধ করেছিলাম যে আপনারা লাফ দিয়েন না। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ফায়ার ফাইটাররা ব্রিদিং অ্যাপারেটাস (শ্বাস গ্রহণের যন্ত্র) নিয়ে ভেতরে গিয়ে আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করে নিয়ে চলে আসছেন।”

‘আপনি তাহলে বলছেন তারা নিজেদের দোষেই মারা গেছেন’- প্রশ্ন করা হলে তাজুল বলেন, “ঠিক নিজেদের ফল্ট বলব না। সেই মুহূর্তে ভয়ে হয়ত তাদের মাথা কাজ করে নাই। আর তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণও ছিল না। সেই ধরনের কোনো জ্ঞানও ছিল না। যার কারণে ভয়ে তারা এটা করেছেন।”  

“এরপরে আপনারা দেখেছেন আমাদের লোকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভেতরে গিয়ে আটকে পড়া লোকদের উদ্ধার করেছে। নবজাতক শিশুদেরও পরম মমতায় আগলে নিচে নামিয়ে এনেছে ফায়ার সদস্যরা,” বলেন তিনি।

ভবনের প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটে সাজসজ্জায় প্রচুর পরিমাণে দাহ্য বস্তু ব্যবহার করা ছিল বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল।

আগুনের সূত্রপাত কোথা থেকে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সূত্রপাতের কথা এখনি আমি বলব না। এটা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কারণ প্রতিটি জিনিসই পাশপাশি অবস্থানে রয়েছে। গ্যাসের পয়েন্ট আছে যেখানে, তার পাশেই বিদ্যুতের পয়েন্টও রয়েছে। এর পাশাপাশি প্রচুর দাহ্যবস্তু রয়েছে সেখানে। কোনটা থেকে আগুনটা শুরু হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে না।”

ভবনে কী ধরনের দাহ্য পদার্থ ছিল- জানতে চাইলে তাজুল বলেন, “এরকম দাহ্য পদার্থ প্রত্যেকটা ভবনেই আছে। আজকাল ইন্টেরিয়রের কাজ করতে ডিজাইনাররা দাহ্য বস্তু ব্যবহার করেন। তারা যে প্লাইউড বা বোর্ড ব্যবহার করছেন, এগুলো সবই দাহ্য পদার্থ। এরকম দাহ্য পদার্থ প্রত্যেকটি ভবনেই পাবেন। সুতরাং বলা যায় না যে এটাই আগুনের উৎস।”

এই ভবনের বাইরে ফায়ার হাইড্রেন্ট রয়েছে, ভেতরে অগ্নিনির্বাপন সরঞ্জাম রয়েছে কি না এবং সেগুলো ব্যবহার হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “না। যে কোনো ভবনের বাসিন্দাদেরই ইনিশিয়াল ফায়ার ফাইটিং জানতে হবে। এটা হচ্ছে নিয়ম। কারণ লাইফ হ্যাজার্ড কিন্তু বাসিন্দাদেরই। এই বিষয়ে ভবনের বাসিন্দারা প্রশিক্ষণ নেননি। যার কারণে তারা প্রাথমিকভাবে ফায়ার ফাইটিং করতে পারেননি।”

উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বেগ পাওয়ার কথা জানিয়ে বাহিনীর পরিচালক বলেন, “এই এলাকায় যে হাইরাইজ ভবনগুলো আছে, তার আশপাশের রাস্তার প্রশস্ততা কিন্তু খুবই কম। আমাদের টার্ন টেবিল ল্যাডারটা বহন করে অনেক বড় একটা গাড়ি। এই বড় গাড়িটা আমাদের বিভিন্ন স্টেশন থেকে এখানে আসছে। ল্যাডারটা যখন ওপরে উঠেছে তখন গাছপালা অথবা ভবনের কারণে ল্যাডারগুলো ঠিকমতো ডিসটেন্স (নাগাল) পাচ্ছিল না। আমাদের ল্যাডারগুলো বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে কাজ করে। আপনারা দেখেছেন আমরা বিভিন্ন দিক থেকে ওই ল্যাডার দিয়ে তাদের রেসকিউ করার চেষ্টা করি। আমরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও নবজাতকসহ ২২ জনকে উদ্ধার করি।”

অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে জনসচেতনতার উপর জোর দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক বলেন, “দেশবাসীকে একটা কথা বলতে চাই, আপনারা যে ভবনে আছেন সেটি নিরাপদ কি না, সেটি ভালোভাবে খেয়াল করুন।… ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা নিন, আমাদের পরিদর্শকদের মাধ্যমে পরিদর্শন করান। আমাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিন, মহড়া করুন। আমাদের এটাই কাম্য। আপনারা সচেতন হোন, নিজেদের ভবনটিকে নিরাপদ করুন।”