এর মধ্যে দিয়ে একজন শিক্ষক, অর্থনীতির গবেষক আর ‘গরিবের ব্যাংকার’ হয়ে শান্তিতে নোবেল জয়ীর পরিচয়ের পর নতুন এক পরিচয় পেলেন তিনি।
Published : 08 Aug 2024, 10:09 PM
ঠিক ৬ মাস ৪ দিন আগেই ভিন্ন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। তিনি নিজেই বলেছিলেন, ‘আজকের এ ছবিটা আপনারা তুলে রাখুন’ ঐতিহাসিক ছবি হয়ে থাকবে। এবার তাকে বলতে হল না; নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের বিমানবন্দরের ছবিটি বাংলাদেশের জন্য ইতিহাস হয়ে গেল।
প্রবল গণ আন্দোলন ও সহিংসতার মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলের মধ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি দেশে দেশের হাল ধরতে ঢাকায় এসে পৌঁছালেন। বিমানবন্দরে তাকে দেওয়া হল সরকারি অর্ভ্যথনা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের নাটকীয়তায় তিনি হলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান।
এর মধ্যে দিয়ে একজন শিক্ষক, অর্থনীতির গবেষক আর ‘গরিবের ব্যাংকার’ হয়ে শান্তিতে নোবেল জয়ীর পরিচয়ের পর নতুন এক পরিচয় পেলেন মুহাম্মদ ইউনূস; গত কয়েক বছর দেশে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যাকে যেতে হয়েছে।
নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর আদালতের চৌকাঠে ঘুরপাক খাওয়ার সময় পেরিয়ে তিনি হাল ধরলেন বাংলাদেশের। বৈরি সময় পেরিয়ে দেশের অস্থির এক সময়ে আস্থা ফিরিয়ে সবার আস্থাভাজন হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ নিতে যাচ্ছেন।
কয়েকদিন আগেও যে সরকারের সঙ্গে চলেছে আইনি লড়াই, প্রবল গণ আন্দোলন ও সহিংসতার মধ্যে শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারপ্রধানের সেই চেয়ারই এখন রাখা হয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য।
ক্ষুদ্র ঋণের ‘প্রবক্তা’, গরিবের ব্যাংকার, সামাজিক ব্যবসার অগ্রদূত আর নোবেলজয়ীর উপাধির সঙ্গে তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে যুক্ত হচ্ছে সরকারপ্রধানের পরিচয়ও।
সরকার পরিচালনার অংশ হওয়ার অভিজ্ঞতা তার আগেও রয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন এই অর্থনীতিবিদ। সেই অভিজ্ঞতায় এবার নেতৃত্ব দেবেন দেশ পরিচালনায়।
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন দারিদ্র বিমোচনে কাজ করে যাওয়া এ অর্থনীতিবিদ। দেশের হাল ধরতে স্বল্প সময়ের নোটিসেই প্যারিস থেকে চলে এসেছেন ৮৪ বছর বয়সি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
অথচ শান্তিতে নোবেল জয়ের পর বিশ্বজুড়ে দেশের সুনাম কুড়িয়ে আনা এ ব্যক্তিত্বকে কদিন আগেও কিছুদিন পর হাজির হতে হয়েছে আদালতের প্রাঙ্গণে। এ বছরের ৪ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদকের) টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে এসেছিলেন তিনি।
সেখান থেকে বেরিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে স্বভাবসুলভ হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আজকের এ ছবিটা আপনারা তুলে রাখুন। দুর্নীতি দমন কমিশন ও বটতলার এটি একটি ঐতিহাসিক ছবি হয়ে থাকবে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এটি প্রকাশিত হবে। যুগ যুগ ধরে নানান বইতেও এটা প্রকাশিত হবে। আপনারা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবেন।”
তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বটতলার এটি একটি ঐতিহাসিক ছবি হয়ে থাকবে।
বৃহস্পতিবার সেই চিত্র পাল্টে গেল। রাষ্ট্র প্রস্তুত তাকে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করতে। নানা ঘাত প্রতিঘাত উতরে তিনি এবার দেশের নেতৃত্বে।
৮৪ বছর বয়সী এ ব্যক্তিত্ব বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশকে এগিয়ে নিতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন।
সুযোগ এসেছিল আগেও
এর আগেও তার আরেকবার সরকারপ্রধান হওয়ার সুযোগ থাকলেও তা নিয়ে না করে দিয়েছিলেন। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কয়েক মাস পর তৎকালীন সেনা সমর্থিত সরকার তাকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে চেয়েছিল।
এর কয়েক মাস পর সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজনীতির মাঠে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে নোবেলজয়ীকে এ নিয়ে নানান তিক্ততার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে; গরিবের ব্যাংকের বদলে শুনতে হয়েছে ’সুদখোর’ এর সমালোচনা।
প্রতিকূল সময়
ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনে সরকার গঠনের পর ১৯৯৭ সনে মুহাম্মদ ইউনূসকে পল্লীফোন (বর্তমানে গ্রামীণ টেলিকম) চালুর অনুমতি প্রদান করেছিলেন তৎকালীন সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
তবে পরিস্থিতি পাল্টে যায় দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর।
দুই বছরের সেনাশাসন শেষে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ইউনূসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে থাকে।
এর প্রথমটা শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে নোবেলবিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে অব্যাহতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে। ২০১১ সালের মার্চে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ জারি করে।
অধ্যাপক ইউনূসকে অনেকবার ‘সুদখোর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ২০১২ সালে পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের জন্য মুহাম্মদ ইউনূসের ‘প্রভাব’ কাজ করে থাকতে পারে বলে মন্তব্যও করেন শেখ হাসিনা।
২০২২ সালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রাক্কালে অধ্যাপক ইউনূসকে পদ্মা নদীতে ‘চুবানি দিয়ে তোলা’র মত কটাক্ষও করা হয়।
সে বছর ১৮ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “একটি এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে তোলা উচিত। মরে যাতে না যায়, পদ্মা নদীতে একটু চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেওয়া উচিত। তাহলে যদি শিক্ষা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থ বন্ধ করাল ড. ইউনূস। কেন? গ্রামীণ ব্যাংকের একটি এমডি পদে তাকে থাকতে হবে।”
ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টাকে ‘শান্তি স্থাপন’ বিবেচনা করে ২০০৬ সালে ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সরকারের অর্থায়ন ও সহযোগিতায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইউনূস এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, ইউনূসকে 'অবৈধভাবে' অপসারণ করা হয়েছে।
২০১১ সালে অবসরের বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়ায় ইউনূসের পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক; ওই বছর মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউনূসকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতে যান এবং দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আপিল বিভাগের আদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব হারান তিনি।
ইউনূসকে অপসারণের বিষয়টি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমেও ব্যাপক প্রচার পায়। ইকোনমিস্টসহ নানা সংবাদপত্র ও সাময়িকী সরকারের কড়া সমালোচনা করে। পশ্চিমা দুনিয়ার প্রীতিভাজন বলে পরিচিত তাকে সরিয়ে দিলে প্রকাশ্য ক্ষোভ দেখায় যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, "এ ক্ষেত্রে (ইউনূসকে অপসারণ) যে প্রক্রিয়া অবলম্বর করা হয়েছে, তাতে আমাদের সরকার বিচলিত। ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি, তিনি একজন নোবেল বিজয়ী। সম্মানজনক পদ্ধতিতে এ সমস্যার সমাধান করা যেত"।
অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের অভিযোগ, পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন ঝুলে যাওয়ার পেছনেও ইউনূসের হাত রয়েছে। ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী বন্ধুদের তিনি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লাগিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ।
নোবেলবিজয়ী ইউনূস সব সময়ই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মিরপুরের চিড়িয়াখানা সড়কে ১৪ তলা টেলিকম ভবনে ‘গ্রামীণ পরিবারের’ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক ‘জবর দখল’ করে বলে অভিযোগ উঠে। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে আইনি সহায়তা চেয়েও তারা পাননি।
ইউনূসের ভাষায়, এটা দেশবাসীর সামনে তাকে ‘হয়রানি’ করা এবং তার সামাজিক ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানকে ‘ধ্বংস করার নীল-নকশা’ ছাড়া আর কিছু নয়।
সম্প্রতি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার কর্মকর্তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় শ্রম আদালত। এছাড়া গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আরেক মামলায় ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন করেছে দুদক।
সরকারের ‘ইচ্ছাতেই’ এসব হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছেন ইউনূস।
ইউনূসের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও সেগুলোতে তার দণ্ড হওয়ার জন্য শেখ হাসিনার ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছেন ড. ইউনূস।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ড. ইউনূসের ছয় মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল। বুধবার তার সাজা বাতিল করে ঢাকার শ্রম আদালত।
অর্ন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে বুধবার শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার সাজা বাতিল করে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এদিন বিকালে ঢাকার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) এম এ আউয়ালের (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ) আদালত এ রায় দেয়।
এ মামলায় শ্রম আদালতের দেওয়া ছয় মাসের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার কর্মকর্তা। শুনানি শেষে বুধবার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল চারজনকেই অব্যাহতি দিয়েছে।
এর মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ পাল্টে যায়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলন এক সময় প্রবল গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। ব্যাপক সহিংসতা ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে যান।
এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করলে তাতে সম্মতি দেন রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধানসহ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। রাজনীতিতে আসার অভিপ্রায় না থাকলেও এবারের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্মতি দেন।
সরকারপ্রধানের হাল ধরতে দেশে আসার পর বিমানবন্দরে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে- তা যাতে বেহাত না হয়, সেজন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
একজন ইউনূস
বিশ্বে 'গরিবের ব্যাংকার' হিসেবে পরিচিত ক্ষুদ্রঋণের জনক অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বিএ ও ১৯৬১ সালে এমএ সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষ করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব ইকোনমিক্স এ যোগ দেন। পরে ১৯৬১ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে ইউনূস ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। ১৯৬৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় অধ্যাপক ইউনূস টেনেসির ন্যাশভিলে নাগরিক কমিটি গঠন করেন। 'বাংলাদেশ নিউজলেটার' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অন্যান্য বাংলাদেশীদের সঙ্গে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র চালু করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অন্যদের সমর্থন আদায় এবং পাকিস্তানকে সামরিক সহযোগিতা প্রদান বন্ধ করতে মার্কিন কংগ্রেসে লবি করার উদ্দেশ্যে তিনি এসব উদ্যোগ নেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইউনূস ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার পর ইউনূস দারিদ্র্য দূরীকরণে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং তার অর্থনীতি বিভাগের একাডেমিক প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে গ্রামীণ অর্থনীতি কর্মসূচি চালু করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি নতুন ধরনের কৃষি সমবায় 'নবযুগ তেভাগা খামার' সংগঠিত করেন, যা পরবর্তীতে সরকার প্যাকেজড ইনপুট প্রোগ্রাম হিসেবে গ্রহণ করে।
১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা গ্রামে অত্যন্ত দরিদ্র্য কিছু পরিবারের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার পর তিনি আবিষ্কার করেন যে, খুব সামান্য পরিমাণ ঋণ একজন দরিদ্র্য মানুষের জীবনে বড়ো ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
তিনি দরিদ্র্যদের ঋণ দেওয়ার জন্য প্রথাগত ব্যাংকগুলোর কাছে ধর্ণা দিয়ে দেখতে পেলেন তারা এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। কারণ, ব্যাংকগুলো মনে করে গরিব মানুষ ঋণ পাওয়ার উপযুক্ত নয়। অনেক প্রচেষ্টার পর অবশেষে তিনি একটি ক্রেডিট লাইন প্রতিষ্ঠায় সফল হলেন।
নিজে গরিব মানুষের ঋণের জামিনদার হয়ে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে স্থানীয় জনতা ব্যাংক থেকে তার প্রকল্পের মাধ্যমে জোবরা গ্রামের গরিব মানুষদের ঋণ দেওয়া শুরু করলেন।
১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর তার এই প্রকল্প পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়। যার নাম হলো 'গ্রামীণ ব্যাংক'।
গ্রামীণ ব্যাংক ছাড়াও গত কয়েক দশকে মুহাম্মদ ইউনূস দরিদ্র বাংলাদেশিদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং ফোন পরিষেবা প্রদানসহ কয়েক ডজন সামাজিক কাজ করে আসছেন।
গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
২৮ জুন তার জন্মদিনকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিকভাবে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
এখন পর্যন্ত দারিদ্র্যদূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে।
বিশ্বের ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে তার চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়।
অধ্যাপক ইউনূসের অর্জিত অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, সিডনি শান্তি পুরস্কার। আর বাংলাদেশে তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার (১৯৭৮), কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুরস্কার (১৯৮৫) এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৮৭)।
ইউনুস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও অনেক পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন।
কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ড. ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ইউনূসের সম্মতি
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে তৈরি হওয়া নানান রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রায় এক মাস ধরে ছাত্র আন্দোলন এ মাসের শুরুতে সরকারপতনের এক দফার আন্দোলনের রূপ পায়।
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে সোমবার দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এর পর থেকে চারদিকে অরাজকতা বিরাজ করছে; অনেক জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনে শূন্যতা দেখা দিয়েছে।
আন্দোলন-সহিংসতার মধ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পর সংকট উত্তরণে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে ‘রাজি’ হন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করার সিদ্ধান্ত হয়; অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ১০ থেকে ১৫ জনের নাম প্রস্তাব করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন; যা আরও আলোচনার পর চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে ইউনূসকে প্রধান করার এ সিদ্ধান্ত হয়।
বঙ্গভবনে বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। এবং আজকে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও সম্মতি দিয়েছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে গঠন করা হবে।”
বৈঠকের পর বঙ্গভবনের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়, “বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি অন্তবর্র্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হয়। রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন তাদের প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করেন।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাল ধরতে প্যারিস থেকে বৃহস্পতিবার দেশে ফেরেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রবল গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্যে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে- তা যাতে বেহাত না হয়, সেজন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “আমি সাহসী ছাত্রদেরকে অভিনন্দন জানাই- যারা আমাদের দ্বিতীয় বিজয় দিবসকে বাস্তবে রূপ দিতে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং অভিনন্দন জানাই দেশের আপামর জনসাধারণকে- যারা ছাত্রদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।
“আসুন, আমরা আমাদের এই নতুন বিজয়ের সর্বোত্তম সদ্ব্যব্যবহার নিশ্চিত করি। আমাদের কোনো প্রকার ভুলের কারণে আমাদের এই বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়।”
আরও পড়ুন
ছাত্রদের দেখানো পথেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ: ইউনূস
কারো ওপর কোনো হামলা হবে না: ইউনূস
ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে 'প্রস্তুত' যুক্তরাষ্ট্র
ইউনূসকে নিয়ে 'অত্যন্ত আশাবাদী' ফখরুল
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ বৃহস্পতিবার রাতে : সেনাপ্রধান
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসকে চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত
সাজা বাতিল, ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৃহস্পতিবার
আমার ঘর জবর দখল হয়ে যাচ্ছে: ইউনূস
কীসের বিচার হবে, 'বুঝতে পারছেন না' ইউনূস
ইউনূস অপসারণ প্রক্রিয়ায় বিচলিত যুক্তরাষ্ট্র
'নতুন' বিজয়ের সর্বোত্তম প্রয়োগের আশা নিয়ে দেশের পথে ড. ইউনূস