এ সরকারের উপদেষ্টা ১৫ জনের মত হতে পারে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান।
Published : 08 Aug 2024, 04:24 AM
ইতিহাসে প্রথমবারের মত টানা তিন দিন সরকারবিহীন দেশে অদ্ভূত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে; পুলিশবিহীন নগরীতে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা, শিক্ষার্থীরা নেমেছে ট্রাফিক পুলিশের কাজে। রাতে বিভিন্ন স্থানে ডাকাতির খবরে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। এরমধ্যেই নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে ১৫ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হতে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে এ সরকারের শপথ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান।
বুধবার বিকাল পৌনে ৬টার দিকে সেনাসদরে সংবাদ সম্মেলনে সেনাপ্রধান বলেন, সময় কম হলেও বৃহস্পতিবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য চেষ্টা চলছে।
অর্ন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাওয়া শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথা হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তিনি কাজ করতে অত্যন্ত আগ্রহী।”
আগের দিন মঙ্গলবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূসকে অর্ন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রবল গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্যে গঠিত হতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন এ সরকার। এটির হাল ধরতে যাওয়া অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস ফ্রান্সের প্যারিস থেকে রওনা দিয়েছেন।
রওনা দেওয়ার আগে তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, বাংলাদেশের ‘নতুন’ বিজয়ের সর্বোত্তম প্রয়োগ ঘটানো হবে।
প্যারিস থেকে দুবাই হয়ে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ১০ মিনিটে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে তার পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
এরইমধ্যে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার সাজা বাতিল করে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
বুধবার বিকালে ঢাকার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) এম এ আউয়ালের (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ) আদালত এ রায় দেয়।
এ মামলায় শ্রম আদালতের দেওয়া ছয় মাসের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার কর্মকর্তা। শুনানি শেষে বুধবার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল চারজনকেই অব্যাহতি দিয়েছে।
এদিকে প্রবল গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্যে যে বিজয় অর্জিত হয়েছে- তা যাতে বেহাত না হয়, সেজন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
বুধবার ইউনূস সেন্টারের পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, “আমি সাহসী ছাত্রদেরকে অভিনন্দন জানাই- যারা আমাদের দ্বিতীয় বিজয় দিবসকে বাস্তবে রূপ দিতে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং অভিনন্দন জানাই দেশের আপামর জনসাধারণকে-যারা ছাত্রদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন।
“আসুন, আমরা আমাদের এই নতুন বিজয়ের সর্বোত্তম সদ্ব্যব্যবহার নিশ্চিত করি। আমাদের কোনো প্রকার ভুলের কারণে আমাদের এই বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাল ধরতে যাওয়া অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমি সকলকে বর্তমান পরিস্থিতিতে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের সহিংসা এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি এবং ছাত্র ও দলমত নির্বিশেষে সকলকে শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করছি।”
তীব্র গণআন্দোলন ও সহিংসতার মধ্যে সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। সেদিনই দেশ ছেড়ে ভারত চলে যান তিনি। বর্তমানে তিনি সেখানেই আছেন।
সরকার পতনের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শেষের দিনগুলোতে সারাদেশে যে সংঘাত শুরু হয়েছে তা চলেছে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরও।
বিভিন্ন থানায় হামলা করে পিটিয়ে পুলিশ মারা হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মীদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। এতে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। থানায় হামলা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে অনেকের।
পুলিশ সদস্যরা আত্মগোপনে থাকায় মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। রাতের বেলা চলছে বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি।
মঙ্গলবার রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় ‘ডাকাতি হচ্ছে’ বলে মসজিদে মসজিদে মাইকিং করা হলে স্থানীয়রা লাঠিসোঁটা হাতে দল বেঁধে রাস্তায় নেমে যান ডাকাতি ঠেকাতে। মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, চান মিয়া হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায় এই ডাকাতির আতঙ্ক ছড়ায়।
বুধবার রাতেও ডাকাতির খবর এসেছে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ইসিবি চত্বর ও উত্তরার দিক থেকে। মধ্যরাতে মিরপুরে ডাকাতি ঠেকাতে করা হয়েছে মাইকিং।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যখন ভেঙে পড়েছে, ঠিক সে সময় পুলিশের শীর্ষপদে আসে রদবদল। মঙ্গলবার মধ্যরাতে পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। পুলিশের ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের কমান্ড্যান্ট মো. ময়নুল ইসলামকে নতুন আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বুধবার দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে পুলিশ সদস্যদের স্ব স্ব ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মো. ময়নুল ইসলাম।
পরদিন সকালে র্যাব ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বদল করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সোমবার বিকালের পর থেকেই নগরীতে প্রকাশ্যে পুলিশের সংখ্যা কমতে থাকে; মঙ্গলবার শুধু রাজধানীতে নয়, প্রায় পুরো দেশেই পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে দেখা যায়।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের সড়কে নেমে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। পরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও থানার নিরাপত্তায় আনসার নামানো হয়।
‘একটি শূন্যস্থান হয়তো তৈরি হয়েছে’ মন্তব্য করে আইজিপি ময়নুল ইসলাম বলেন, “তবে সেটি পূরণে আমরা কাজ শুরু করেছি। আশা করছি অচিরেই এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সবার সহযোগিতা আহ্বান করেন তিনি। থানাগুলোকে ঠিকঠাক করতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সচেতন মানুষ, সাংবাদিকসহ সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একটি নাগরিক নিরাপত্তা কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন আইজিপি।
বিকালে সংবাদ সম্মেলনে সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামানও এ নিয়ে কথা বলেছেন।
তুমুল গণ আন্দোলন ও সংঘাতের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে নৈরাজ্য ও সহিংসতার ঘটনায় সাধ্যমত চেষ্টা করার কথা বলেছেন সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান।
তবে চেষ্টার পরও কোনো ব্যর্থতা থাকলে সে দায় নিজে নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
বুধবার বিকাল পৌনে ৬টার দিকে সেনাসদরে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, “রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের আমি বলেছিলাম আমাদের সহযোগিতা করতে। কারণ যে মুহূর্তে এই ট্রানজিশন হবে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ওনারাও আমাকে বলেছিলেন সহযোগিতা করবেন। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু জায়গায় এসব ঘটনা ঘটেছে।
“ঘটনা ঘটার পেছনে কিছু কারণও আছে। প্রথমে এসব ঘটনা ঘটেছে, এখন পরিস্থিতি অনেক শান্ত হয়ে এসেছে।”
রাজনীতিবিদদের অনুরোধে দায়িত্ব নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি দায়িত্ব নিয়েছি, আর তো কেউ নেওয়ার নাই। যদি কোনো ব্যর্থতা থাকে, সেই দায়-দায়িত্বও আমার।
“আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। খুব কম সময়ের মধ্যে একটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরত আসছে। আমাদের আরও অনেক কাজ করতে হচ্ছে। আমাকে একটু সময় দেন, ইনশাল্লাহ আমরা স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারব।”
পুলিশ পুর্নগঠিত হয়ে কাজে ফিরলে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
সেনাপ্রধান বলেন, “পুলিশের এত বিরাট ফোর্স নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর পক্ষে সেটা পূরণ করা সম্ভব হবে না। আমরা আনসার-বিএনসিসিকে কাজে লাগিয়েছি, ছাত্ররাও কাজ করেছে। আমাদের মিলিটারির সকল ফোর্স কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এখন এই ঘটনাগুলো কমে এসেছে।
“পুলিশের পুনর্গঠনের কাজ চলছে। একজন পুলিশ প্রধানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি নিশ্চিত, পুলিশের মনোবল ফেরত আসবে। পুলিশও ভালোভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে।”
নৈরাজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের আইনের আওতায় আনার সর্বোচ্চ চেষ্টার কথাও তুলে ধরেন তিনি।
আরও পড়ুন
কোনো দলের আকাঙ্ক্ষা পূরণে হয়নি এ আন্দোলন: সমন্বয়ক আসিফ
'নতুন' বিজয়ের সর্বোত্তম প্রয়োগের আশা নিয়ে দেশের পথে ড. ইউনূস
ইউনূস ফিরছেন বৃহস্পতিবার দুপুরে
কোনো ভুলে এ বিজয় যেন হাতছাড়া না হয়: মুহাম্মদ ইউনূস
শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ইউনূসের সাজা বাতিল