যে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা দেশে চলছে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
Published : 08 Aug 2024, 03:19 PM
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিতে দেশে ফিরে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে এ দেশের ‘পুনর্জন্ম দিয়েছে’, তাদের দেখানো পথেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
প্রবল গণ আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা দেশে চলছে তা বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি; বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাই হবে তার প্রথম কাজ।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দেশকে ‘স্বাধীনতা’ এনে দিয়েছে মন্তব্য করে ইউনূস বলেন, “যে তরুণ সমাজ এটাকে সম্ভব করেছে, তাদের প্রতি আমি আমার সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এরা এদেশকে রক্ষা করেছে। এ দেশকে পুনর্জন্ম দিয়েছে, এ পুনর্জন্ম যে বাংলাদেশ পেল, সে বাংলাদেশ যেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে পারে, সেটাই আমাদের শপথ। সেটা আমরা রক্ষা করতে চাই, আমরা এগিয়ে যেতে চাই।”
সবার আগে জনগণের আস্থা ফেরানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আপনারা যদি আমার ওপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত থাকেন, দেশের কোনো জায়গায় কারও ওপর হামলা হবে না। এটা আমাদের প্রথম দায়িত্ব।
“আর আমার কথা যদি না শোনেন, তাহলে আমার প্রয়োজন এখানে নাই। আমাকে বিদায় দেন। আর আমাকে প্রয়োজন মনে করলে আমার কথা শুনতে হবে। আমার প্রথম কথা হল, বিশৃঙ্খলা থেকে সহিংসতা থেকে দেশকে রক্ষা করেন, যাতে আমাদের ছাত্ররা আমাদের যা যা পথ দেখায়, আমরা সেই পথে এগিয়ে যেতে পারি।”
অলিম্পিকের আনুষ্ঠানিকতায় যোগ দিতে ইউনূস গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। এর মধ্যে ছাত্র জনতার বিপুল গণ আন্দোলনে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের সরকারের পতন ঘটে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচনের প্রয়োজনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেনাবাহিনীও তাতে সমর্থন দেয়।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করেছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাদের সঙ্গে একমত হন।
শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিতে বুধবার প্যারিস থেকে দেশের পথে রওনা হন ইউনূস। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে তিনি ঢাকায় নামেন।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন ও নৌ বাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান, নতুন আইজিপি ময়নুল ইসলাম এবং র্যাব মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান শাহজালাল বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে অধ্যাপক ইউনূসকে অভ্যর্থনা জানান।
সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল শিক্ষার্থীদের যে প্ল্যাটফর্ম, সেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহসহ কয়েকজনও উপস্থিত ছিলেন। মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তারা তুলে দেন ফুলের তোড়া।
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, উবিনিগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার, গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ছিলেন বিমানবন্দরে।
গ্রামীণ চেকের ফতুয়া ও কটি পরিহিত ৮৪ বছর বয়সী অধ্যাপক ইউনূস হাস্যোজ্জ্বল মুখে হাত মেলান সবার সঙ্গে। ২০০৬ সালে নোবেল জয়ের পর অধ্যাপক ইউনূসকে ঘিরে যে বাঁধ ভাঙা আনন্দের জোয়ার বয়েছিল, দেড় যুগ পরে সেই উচ্ছ্বাসের আবহ ফেরে দেশে।
বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে ইউনূস যখন বক্তৃতা করছিলেন, রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ কথা স্মরণ করে তার কণ্ঠ ধরে আসে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “সে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এটা কেউ ভুলতে পারবে না। কি অবিশ্বাস্য এক সাহসী যুবক! বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর থেকে কোনো যুবক, কোনো যুবতীই আর হার মানেনি, সামনে এগিয়ে গেছে। এবং বলেছে, যত গুলি মারো, মরতে রাজি আছি। যার কারণে সারা বাংলাদেশজুড়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে। যার ফলে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করল।
“এই স্বাধীনতাটা রক্ষা করতে হবে। শুধু রক্ষা করা না, এই স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছাতে হবে। নইলে এই স্বাধীনতার কোনো দাম নেই। এই স্বাধীনতাকে পৌঁছানোই আমাদের প্রতিজ্ঞা, আমাদের শপথ। মানুষ যেন জানে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হল, তার নিজের পরিবর্তন; ব্যক্তির পরিবর্তন, সুযোগের পরিবর্তন, তার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের পরিবর্তন। এটা যেন প্রত্যেকে বুঝতে পারে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের ক্ষেত্রে তরুণরাই যে প্রাধান্য পাবে, সে কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “এই তরুণ সমাজকে বোঝানো যে, এই দেশ তোমাদের হাতে। তোমরা এটাকে যেভাবে স্বাধীন করতে পেরেছ, তোমাদের মনের মত করে এটাকে গড়তেও পারবে। তোমাদের দেখে সবাই শিখবে, কীভাবে একটা দেশ একটা তরুণ সমাজ পাল্টে ফেলতে পারে।
“তোমাদের মধ্যে যে সৃজনশীলতা রয়েছে, সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এটা শুধু বই-খাতাতে লেখার জিনিস না। এটা প্রকাশ করার জিনিস, স্থাপন করার জিনিস।”
বিগত বছরগুলোতে সরকার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক এমডি ইউনূস বলেন, “সরকার বলে একটা জিনিস আছে, কিন্তু মানুষের কোনো আস্থা নেই। মানুষ মনে করে, সরকার একটা দমন-নিপীড়নের একটা যন্ত্র। সে ভয়ের একটা জিনিস, তাকে সামাল দিয়ে চলা। এটা সরকার হতে পারে না।
“সরকারকে দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে যে, সরকার মানুষকে সাহায্য করবে, তার পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু সরকার তার পাশে দাঁড়ায় না। এখন যে সরকার হবে, সে সরকার মানুষকে রক্ষা করবে। মানুষের আস্থাভাজন হবে, সেই আস্থাটা আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে মানুষের মনে। তাহলে মানুষও এতে যোগ দেবে।”
তিনি বলেন, “মানুষ এখন পিছিয়ে থাকে যে, ‘কীসের মধ্যে আমাদের ঢুকিয়ে দেবে!’ সারা বাংলাদেশ একটা বড় পরিবার। এ পরিবার আমরা একসঙ্গে চলতে চাই। আমাদের মধ্যে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা সরিয়ে ফেলতে চাই। যারা বিপথে গেছে, তাদেরকে পথে আনতে চাই। যাতে একসঙ্গে কাজ করতে পারি।”
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সরকারবিহীন চার দিনে দেশে যে সহিংসতা হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের হবু প্রধান বলেন, “ আসার পথে শুনলাম, এখানে আইনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটছে, মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে, ঘরবাড়ি-সম্পদ জ্বালিয়ে দিচ্ছে, চুরি-ডাকাতি হচ্ছে। অফিস আদালতে আক্রমণ করছে, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করছে। এগুলো হল ষড়যন্ত্রের অংশ।
“এগুলো আমাদের বিষয় না। আমাদের কাজ হল, প্রতিটি মানুষকে রক্ষা করা। প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন। আমাদের কাজ হল, প্রত্যেককে রক্ষা করা, একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা- এগুলো হল অগ্রগতির বড় শত্রু। আমাদের যে যাত্রা শুরু হল, সেই যাত্রার শত্রু। সেই শত্রুদের যেন রোধ করা যায়, বুঝিয়ে শুনিয়ে হোক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে হোক, তাকে বোঝাতে হবে। তাকে মেরে-কেটে বোঝানো যাবে না।”
ইউনূস বলেন, “আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা আমাদের প্রথম কাজ। আইনশৃঙ্খলা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারব না।”
বাংলাদেশকে ‘অনেক সম্ভাবনার’ একটি দেশ হিসেবে বর্ণনা করে এই নোবেল বিজয়ী বলেন, সেই সম্ভবা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
“এখন আবার সেই বীজতলা তৈরি করতে হবে। তারা (তরুণরা) এই দেশটা তৈরি করবে, তাদের হাত দিয়েই হবে। এবং তাদের দিকে আমরা তাকাব। তাদের নির্দেশ মত আমরা অগ্রসর হব।
“এখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন- সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী তাদের প্রতিও অনুরোধ, আমরা একটা পরিবার। এটার মধ্যে আমাদের যেন গোলযোগ না হয়। আমরা একযোগে একসাথে চলতে পারি, এবং আমরা ত্বরিৎ গতিতে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার দিকে এগিয়ে যাব- এটাই আমার কামনা।”
ইউনূস বলেন, “আপনাদের সবার কাছে আবেদন, উনাদেরকে আপনারা সে সুযোগ দিন, আমরা যেন সে পথে এগিয়ে যাই। প্রথিবীর সবাই আগ্রহ করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এখানে যখন ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে, পৃথিবীর সব জায়গা থেকে, অনেক অনেক জায়গা থেকে যে তারা অবাক হয়ে গেছে- আমাদের তো গা শিউরে উঠেছে প্রতিদিন যা ঘটেছে, অবিশ্বাস্য কাণ্ড!
“তাদেরও এটা স্পর্শ করেছে, তাদের তরুণরাও জেগে ওঠেছে আমাদের ছেলেমেয়েদের এ অভিজ্ঞতা থেকে। কাজেই আমাদের কাজ হবে এগুলো সম্পূর্ণ করা। আমরা আজকে থেকে শুরু করলাম। আমরা আশা করি দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে পারব।”
বক্তৃতা শেষে বিমানবন্দরেই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে এক দফা বৈঠক করে ইউনূস রওনা হন গুলশানের বাসার উদ্দেশে। রাত ৮টায় বঙ্গভবনে তার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যদের শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে।