হত্যা মামলায় জামিনের আদেশে বাদীর আইনজীবী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, “ম্যাজিস্ট্রেটের এ রকম জামিন দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।”
Published : 03 Apr 2024, 05:34 PM
ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত লতিফুর রহমানের মেয়ে শাযরেহ হকের করা চারটি মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন পেলেন গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহনাজ রহমান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান ও হেড অব ট্রান্সফরমেশন যারেফ আয়াত হোসেন।
আসামিরা সম্পর্কে যথাক্রমে বাদীর মা, বোন এবং ভাগ্নে।
বাদীর আইনজীবী এমন আদেশে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, হত্যা মামলায় জামিন নজিরবিহীন।
অর্থ আত্মসাৎ, সম্পত্তি দখল, অবৈধভাবে শেয়ার হস্তান্তর ও বাদীর বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে হত্যার অভিযোগ এনে মামলা চারটি করেছেন শাযরেহ।
বুধবার ঢাকার মহানগর হাকিম মাহবুব আহমেদ শুনানি নিয়ে তাদেরকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্ত ৫ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিন দেন।
বাদীর আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের কাছে এই আদেশে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “হত্যা মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের এ রকম জামিন দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। হাকিম আদালত থেকে হত্যা মামলায় জামিন পাওয়ার রেওয়াজ নাই।”
আসামিপক্ষে জামিন শুনানি করেন শাহীনুর ইসলাম অনি।
শাযরেহ মামলা করার সময় ট্রান্সকম গ্রুপের তিন শীর্ষ কর্তা বিদেশে ছিলেন। তারা যেন কোনো ধরনের বাধা ছাড়া দেশে ফিরে আইনিভাবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন, সে জন্য উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হয়েছিল।
সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত তাদেরকে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই দেশে ফেরা এবং ফেরার পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশও দিয়েছিল।
তারা দেশে ফিরেই বুধবার সকালে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির হন। এরপর তারা আদালতে আত্মসমর্পণ ও জামিন আবেদন করেন।
ট্রান্সকম গ্রুপের আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার গুলশান থানায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি তিনটি মামলা করেন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ হক। ওই মামলায় পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। তারা পরে জামিন পান।
এরপর গুলশান থানায় ২২ মার্চ আরেকটি মামলা করেন শাযরেহ হক। ৯ মাস আগে মারা যাওয়া তাদের ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে হত্যার অভিযোগ এনে এই মামলায় আসামি করা হয় ১১ জনকে।
এসব মামলায় অন্য আসামিরা আগে জামিন পেয়েছেন।
তিন মামলায় কী অভিযোগ
গত ২২ ফেব্রুয়ারি করা তিন মামলায় শাযরেহ তার মা, বোন, ভাগ্নেসহ আটজনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, সম্পত্তি দখল ও অবৈধভাবে শেয়ার হস্তান্তরের অভিযোগ আনেন।
একটি মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, তার বাবা বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও এফডিআরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রেখে মারা যান। সেসব অ্যাকাউন্টের নমিনি ছিলেন তার মা শাহনাজ রহমান।
২০২০ সালের ১ জুলাই লতিফুর রহমান মারা যাওয়ার পর ওই টাকা তার উত্তরাধিকারীদের (ওয়ারিশ) মধ্যে ‘বণ্টন করে দেওয়ার কথা থাকলেও’ সিমিন সব টাকা তার নিজের ও মায়ের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলেন বলে অভিযোগ শাযরেহের।
তার দাবি, সিমিন ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্সের ১৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নেওয়ার কথা বলে ২০২০ সালের ৩ অগাস্ট ওই ১০০ কোটি টাকা থেকে ৬০ কোটি টাকা নিজের নামে সরিয়ে নেন।
শাহনাজ ও সিমিন মিলে লতিফুরের অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করে এই কাজ করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন শাযরেহ।
আরেক মামলায় তার অভিযোগ, সিমিন ট্রান্সকমের আরও চার কর্মকর্তার সহযোগিতায় জালিয়াতির মাধ্যমে তিনটি হস্তান্তর দলিল তৈরি করে সেগুলো জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধকের দপ্তরে জমা দিয়ে ‘বেআইনিভাবে’ ট্রান্সকমের বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকানা নিজের হাতে নেন।
শাযরেহর দাবি, তার বাবা তাকে ৪ হাজার ২৭০টি শেয়ার, তার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে ৪ হাজার ২৭০টি শেয়ার এবং তার বোনকে ১৪ হাজার ১৬০টি শেয়ার হস্তান্তর করেছেন বলে তাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনোই হস্তান্তর দলিলে স্বাক্ষর করেননি।
তার বাবাও জীবিত অবস্থায় কখনও হস্তান্তর দলিলে স্বাক্ষর করেননি বলে দাবি করেছেন লতিফুরের ছোট মেয়ে। তার অভিযোগ, জালিয়াতির মাধ্যমে ওইসব নথি তৈরি করেছে আসামিরা।
তৃতীয় মামলায় অভিযোগ, সিমিন ও শাহনাজ ট্রান্সকমের তিন কর্মকর্তার সহযোগিতায় তার এবং তার ভাইয়ের সই জাল করে ডিড অব সেটেলমেন্ট বা মীমাংসা দলিল তৈরি করেন। পরে ওই দলিল ব্যবহার করে ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার নিজেদের নামে নিয়ে সিমিন ও শাহনাজ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইওর পদ নেন।
এজাহারে বলা হয়েছে করেছেন, পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে তিনি কখনও কোনা ডিড অব সেটেলমেন্ট করেননি।
হত্যা মামলায় কী অভিযোগ
২০২৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার গুলশানের বাসায় নিজের শোয়ার ঘরে মৃত অবস্থায় লতিফুরের ছেলে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে পাওয়া যায়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে জানান।
শাযরেহ এজাহারে লিখেছেন, “পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজসে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি অন্য ওয়ারিশ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে কৌশলে বিষ প্রয়োগ/শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে সিমিন রহমানসহ অন্যদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে।”
এই মৃত্যুর পেছনে এজাহারে ব্যক্তিগত চালক মিরাজুল এবং তার বাসার বাবুর্চি রফিকের হাত আছে কি না সে ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।
মামলায় শাযরেহ লেখেন, বাবা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমান, বোন সিমিন রহমান এবং তিনি নিজে তার বাবার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ। কিন্তু সিমিন রহমান এবং তার ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেন বিভিন্ন জাল কাগজপত্র তৈরি করে স্থাবর সকল সম্পত্তিসহ ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার এবং পজিশন থেকে তাকে এবং তার ভাইকে বঞ্চিত করে।
মামলায় বলা হয়, “এ সকল বিষয় জানার পর বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের সাথে কথা বলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৮ জুন আরশাদ ওয়ালিউর রহমান আমাকে আম মোক্তারনামা দেয়।”
আরশাদ ওয়ালিউর ‘ডিভোর্সি এবং নিঃসন্তান’ ছিলেন- মামলায় এ তথ্য দিয়ে বলা হয়, “আম মোক্তারনামা দেওয়ার কারণে সিমিন রহমান তার ভাইয়ের উপর চরম ক্ষিপ্ত হয় এবং একারণে জীবনের নিরাপত্তার কথা নিকটজনের কাছে আরশাদ ওয়ালিউর রহমান বলেছিলেন।
“এই আম মোক্তারনামা দেওয়ার আট দিনের মাথায় ১৬ জুন পিতা লতিফুর রহমানের পুরানো গৃহকর্মী মোসলেম হাওলাদারের মাধ্যমে ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমান গুরুতর অসু্স্থ বলে জানতে পেরে ভাইয়ের গুলশানের বাসায় যাই।”
শাযরেহ বলেন, সেখানে গিয়ে তার ভাইকে বিছানায় মৃত অবস্থায় দেখতে পান। যেখানে আগে থেকে সিমিন রহমান, যারাইফ আয়াত হোসেনসহ আসামিরা উপস্থিত ছিলেন।
বাদীর অভিযোগ, তার ভাইয়ের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সংবাদ সেখানে উপস্থিত কেউ তাকে জানাননি। তাছাড়া তার ভাইয়ের কোনো জটিল রোগও ছিল না। এ ঘটনার ৩/৪ দিন আগে থেকে তার ভাইয়ের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি।
মামলায় বলা হয়, সিমিন রহমান ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে মৃত্যুর সার্টিফিকেট তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা এবং ওই দিনই বিকালের মধ্যে দাফন করার জন্য সকলকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন।
এরমধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ ইউনাটেড হাসপাতালে নেওয়া হয় সেখানে চিকিৎসক ‘কেন দেরি করে আনা হল’, ‘অনেক আগেই মারা গেছেন’ বলে মন্তব্যও করেন।
হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পর হাসপাতালের চিকিৎসক আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের শারীরিক অবস্থা কি ছিল, তার কোনো দূরারোগ্য ছিল কি না জানতে চাইলে সঙ্গে থাকা ডা. মুরাদ নিজেকে তার (আরশাদ ওয়ালিউর রহমান) ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে দাবি করেন এবং তিনি ‘সমস্ত জানেন’ ‘কোনো পুলিশি রিপোর্ট প্রয়োজন নেই’ বলে জানান।
এরপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ডা. মুরাদসহ সেখানে উপস্থিত কয়েকজন মরদেহ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বজন ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানানোর পর শাযরেহ হকের স্বামী আরশাদ হক ভগ্নিপতি হিসাবে লাশ গ্রহণ করেন বলে মামলায় বলা হয়।
ট্রান্সকম গ্রুপ: ভাই হত্যা মামলার তদন্তেও পিবিআই, তোলা হবে লাশ
ট্রান্সকমের সিমিনের বিরুদ্ধে ভাই হত্যার অভিযোগে বোন শাযরেহের মামলা
ট্রান্সকমের গুলশান কার্যালয় থেকে নথি জব্দ
ট্রান্সকম: মা ও বোনের বিরুদ্ধে শাযরেহর যা যা অভিযোগ
হাসপাতালের সব কাগজপত্র মৃত্যুর সনদ ডা. মুরাদসহ অন্যরা নেন জানিয়ে মামলায় বলা হয়, মৃত্যু সনদের একটি ছবি তার স্বামী আরশাদ হক মোবাইল ক্যামেরায় তুলে রাখেন। যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসাবে ‘অজানা’ লেখা রয়েছে।
এই মামলায় তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে পুলিশের তদন্ত সংস্থা –পিবিআই। আরশাদের লাশ কবর থেকে তুলতে আদালতের অনুমতি পাওয়ার তথ্য দিয়েছেন পিবিআই ঢাকা উত্তরের পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম।