ট্রান্সকম: মা ও বোনের বিরুদ্ধে শাযরেহর যা যা অভিযোগ

লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ হকের অভিযোগ, তার মা ও বোন মিলে ‘জালিয়াতি ও প্রতারণার’ মাধ্যমে তাকে বঞ্চিত করেছেন।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2024, 05:54 PM
Updated : 23 Feb 2024, 05:54 PM

দেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ট্রান্সকমের প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমানের পরিবারে শুরু হয়েছে উত্তরাধিকারের লড়াই।

তার ছোট মেয়ে শাযরেহ হক অর্থ আত্মসাৎ, সম্পত্তি দখল ও অবৈধভাবে শেয়ার হস্তান্তরের অভিযোগ এনে তিনটি মামলা দায়ের করেছেন, যেখানে আসামি করা হয়েছে তার মা, বোন, ভাগ্নেসহ আটজনকে।

লতিফুর রহমানের স্ত্রী শাহনাজ রহমান এখন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান। তার বড় মেয়ে সিমিন রহমান গ্রুপের সিইও। আর নাতি যারেফ আয়াত ট্রান্সকমের হেড অব ট্রান্সফরমেশন। ছোট মেয়ে শাযরেহ হকও ট্রান্সকম গ্রুপের একজন পরিচালক।

তিন মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ট্রান্সকম গ্রুপের পাঁচ কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হওয়ার পর আদালত থেকে জামিনও পেয়েছেন। তবে অভিযোগের বিষয়ে শাহনাজ রহমান বা সিমিন রহমানের ভাষ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।

পারিবারিক পাটের ব্যবসা দিয়ে কর্মজীবন ‍শুরু করা লতিফুর রহমান ১৯৭৩ সালে শুরু করেন ট্রান্সকম গ্রুপ গড়ে তোলার কাজ। চা রপ্তানি দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানি ও বিপণনে এ গ্রুপের ব্যবসা কেন্দ্রীভূত হয়।

এ গ্রুপের দেড় ডজন কোম্পানিতে এখন ২০ হাজারের বেশি মানুষ কাজ করে। ২০২০ সালে এ ব্যবসায়িক গ্রুপের বার্ষিক টার্নওভার ছিল ৮০ কোটি ডলার।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ২০২০ সালের ১ জুলাই লতিফুর রহমানের মৃত্যু হলে এক মাসের মাথায় ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে আসেন লতিফুর রহমানের স্ত্রী শাহনাজ রহমান, বড় মেয়ে সিমিন হোসেন পান ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্ব। এ গ্রুপের সব কোম্পানি ও সহযোগী কোম্পানির পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও তার হাতে দেওয়া হয়।

সাড়ে তিন বছরের মাথায় ছোট মেয়ে শাযরেহ হক মামলার পথে হাঁটায় এ পরিবারের কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এল। 

গুলশান থানায় করা ওই তিন মামলায় দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪১৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭০ ও ৪৭১ ধারায় অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ, জালিয়াতি, প্রতারণা, মূল্যবান জামানত জাল করে খাঁটি হিসাবে চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।

তিনটি মামলাতেই বোন সিমিন হোসেনকে আসামি করেছেন শাযরেহ। আর মা শাহনাজ রহমানকে তিনি আসামি করেছেন দুটি মামলায়। আর সিমিনের ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেন একটি মামলায় আসামি হয়েছেন।

বাকি পাঁচজন হলেন- ট্রান্সকম গ্রুপের আইন উপদেষ্টা ফখরুজ্জামান ভুইয়া, পরিচালক (করপোরেট ফাইন্যান্স) কামরুল হাসান ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, ম্যানেজার আবু ইউসুফ মো. সিদ্দিক ও কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ মোসাদ্দেক।

যেসব ধারায় মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০৬ নম্বর ধারাটি বিশ্বাসের ফৌজদারি লঙ্ঘন; এ অপরাধের শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।

আত্মসাৎ

শাযরেহ হক তার একটি মামলার এজাহারে লিখেছেন, তার বাবা বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও এফডিআরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা রেখে মারা যান। সেসব অ্যাকাউন্টের নমিনি ছিলেন তার মা শাহনাজ রহমান।

২০২০ সালের ১ জুলাই লতিফুর রহমান মারা যাওয়ার পর ওই টাকা তার উত্তরাধিকারীদের (ওয়ারিশ) মধ্যে ‘বণ্টন করে দেওয়ার কথা থাকলেও’ সিমিন সব টাকা তার নিজের ও মায়ের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে ফেলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।

শাযরেহর দাবি, সিমিন ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্সের ১৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নেওয়ার কথা বলে ২০২০ সালের ৩ অগাস্ট ওই ১০০ কোটি টাকা থেকে ৬০ কোটি টাকা নিজের নামে সরিয়ে নেন।

শাহনাজ ও সিমিন মিলে লতিফুরের অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের বঞ্চিত করে এই কাজ করেছেন বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন শাযরেহ।

ট্রান্সকমের শেয়ার থেকে বঞ্চিত করা

আরেক মামলায় শাযরেহ অভিযোগ করেছেন, সিমিন ট্রান্সকমের আরও চার কর্মকর্তার সহযোগিতায় জালিয়াতির মাধ্যমে তিনটি হস্তান্তর দলিল তৈরি করে সেগুলো জয়েন্ট স্টক কোম্পানির নিবন্ধকের দপ্তরে জমা দিয়ে ‘বেআইনিভাবে’ ট্রান্সকমের বেশিরভাগ শেয়ারের মালিকানা নিজের হাতে নেন।

শাযরেহর দাবি, তার বাবা তাকে ৪ হাজার ২৭০টি শেয়ার, তার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে ৪ হাজার ২৭০টি শেয়ার এবং তার বোনকে ১৪ হাজার ১৬০টি শেয়ার হস্তান্তর করেছেন বলে তাকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনোই হস্তান্তর দলিলে স্বাক্ষর করেননি।

তার বাবাও জীবিত অবস্থায় কখনও হস্তান্তর দলিলে স্বাক্ষর করেননি বলে দাবি করেছেন শাযরেহ হক। তার অভিযোগ, জালিয়াতির মাধ্যমে ওইসব নথি তৈরি করেছে আসামিরা।

মীমাংসা দলিল জালিয়াতি

তৃতীয় মামলায় শাযরেহর অভিযোগ, সিমিন ও শাহনাজ ট্রান্সকমের তিন কর্মকর্তার সহযোগিতায় তার এবং তার ভাইয়ের সই জাল করে ডিড অব সেটেলমেন্ট বা মীমাংসা দলিল তৈরি করেন। পরে ওই দলিল ব্যবহার করে ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার নিজেদের নামে নিয়ে সিমিন ও শাহনাজ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইওর পদ নেন।

শাযরেহ এজাহারে দাবি করেছেন, পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে তিনি কখনও কোনা ডিড অব সেটেলমেন্ট করেননি।

৫ কর্মকর্তার জামিন

মামলা হওয়ার পর বৃহস্পতিবার ঢাকার গুলশান থেকে ট্রান্সকমের পাঁচ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই।

শুক্রবার তাদের আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। অন্যদিকে আসামিদের জামিনের আবেদন করেন তাদের আইনজীবীরা।

শুনানি শেষে রিমান্ড আবেদন নাকচ করে ঢাকার মহানগর হাকিম শান্তা ইসলাম পাঁচ আসামির জামিন মঞ্জুর করেন।

ঢাকা বারের সভাপতি মিজানুর রহমান মামুন, শেখ বাহারুল ইসলাম বাহারসহ আরো কয়েকজন আইনজীবী আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন।

শুনানিতে বিচারক মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করেন, কী কী জালিয়াতি হয়েছে, কী কী ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে? সেসব দলিল রিমান্ড আবেদনে যুক্ত করা হয়েছে কি না।

জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তিনি সেসব নথি পরে দাখিল করবেন।

এ সময় আসামিদের আইনজীবী শেখ বাহারুল ইসলাম বলেন, “এ ধরনের মামলায় সাধারণত কোনো তদন্ত ছাড়া থানা কর্তৃপক্ষ সরাসরি এজাহার নেয় না। এ ক্ষেত্রে অজ্ঞাত কারণে তা নেওয়া হয়েছে।

“যেহেতু জাল জালিয়াতির অভিযোগ, সে কারণে সিআইডি দিয়ে এ অভিযোগগুলোর তদন্ত হওয়া দরকার ছিল। যদি তদন্তে জালিয়াতির প্রাইমাফেসি পাওয়া যেত, তবে মামলা হতে পারত।”

Also Read: শাযরেহ হকের মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের ৫ কর্মকর্তার জামিন

Also Read: শাযরেহ হকের মামলায় গ্রেপ্তার ট্রান্সকমের ৫ জন, আসামি মা-বোন-ভাগনেও

এই আইনজীবী বলেন, “মা খুব কম ক্ষেত্রেই সন্তানদের ঠকান। এখানে বড় বোন ও মায়ের বিরুদ্ধে যে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছে, তার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। আর গ্রেপ্তার ও আদালতে পাঠানোর প্রতিবেদনে চালাকি করে এক একটিতে দুই জন করে আসামিকে আদালতের সামনে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। অথচ আসামি কিন্তু দুইজনের বেশি। আর এসব অভিযোগ একটি মামলার মধ্যেই আনা যেত। ট্রান্সকমের মতো নির্ভেজাল একটি গ্রুপকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের ফসল এ মামলাগুলো।”

শুনানিতে বাহারুল ইসলাম বলেন, “লতিফুর রহমানের স্ত্রী তার নমিনি। আর শেয়ার ট্রান্সফারে যদি জালিয়াতি থাকত, তবে সে সব ডকুমেন্টে বাদীর নিজের স্বাক্ষর থাকত না। লতিফুর রহমান মারা যাওয়ার আগে সম্পদ বিলি বণ্টনের কাজ সবার সামনে স্বচ্ছভাবে করে গিয়েছিলেন।

“তাছাড়া এ সব বিষয়ে দেওয়ানি আরবিট্রেশন মামলা বিচারাধীন। সেখানে আমরা লড়ছি। এগুলো আসলে কাউন্টার মামলা।”

রাষ্ট্রপক্ষে তদন্ত কর্মকর্তা ও আদালত পুলিশের কর্মকর্তা এস আই শাহ আলম এসব বক্তব্যের বিরোধিতা করে তেমন কোনো যুক্তি দেননি।