ট্রান্সকমের সিমিনের বিরুদ্ধে ভাই হত্যার অভিযোগে বোন শাযরেহের মামলা

গুলশান থানায় দায়ের করা এ হত্যা মামলায় ভাগ্নে সিমিনের ছেলেসহ ট্রান্সকম গ্রুপের কর্মকর্তাদেরও আসামি করা হয়েছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2024, 03:34 PM
Updated : 23 March 2024, 03:34 PM

দেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমানের বিরুদ্ধে এবার ভাইকে হত্যার অভিযোগ এনেছেন তার ছোট বোন শাযরেহ হক।

ঢাকার গুলশান থানায় বৃহস্পতিবার রাতে ১০ মাস আগে ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা এ মামলায় বড় বোন সিমিন রহমানের ছেলে ও ট্রান্সকম গ্রুপের হেড অব ট্রান্সফরেশন যারাইফ আয়াত হোসেনসহ মোট ১১ জনকে আসামি করা হয়েছে।

গুলশান থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ট্রান্সকম গ্রুপের পরিচালক শাযরেহ হক এ মামলা করার পর তারা তদন্ত শুরু করেছেন।

এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার না হওয়ার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের কেউ কেউ দেশের বাইরে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

২০২৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার গুলশানের বাসায় নিজের শোয়ার ঘরে মৃত অবস্থায় আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে পাওয়া যায়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে জানান।

ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর তার পরিবারে শুরু হওয়া উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের মধ্যে এবার বড় বোনের বিরুদ্ধে বড় ভাইকে হত্যার অভিযোগ আনলেন ছোট বোন শাযরেহ হক।

হত্যা মামলার আসামিরা হলেন- ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান (৫৭), সিমিনের ছেলে ও ট্রান্সকম গ্রুপের হেড অব ট্রান্সফরেশন যারাইফ আয়াত হোসেন (২৯), এসকেএফ ফার্মাসিটিউক্যাল লিমিটেডের ম্যানেজার (মেডিকেল অ্যাফেয়ার্স) ডা. মুরাদ (৫০), এসকেএফ ফার্মাসিটিউক্যাল লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) ডা. মো. মুজাহিদুল ইসলাম (৫৫), ট্রান্সকম লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স-আইন) মো. ফখরুজ্জামান ভূঁইয়া (৬০), ট্রান্সকম লিমিটেডের ট্রান্সকম গ্রুপ করপোরেট ফাইন্যান্সের পরিচালক মো. কামরুল হাসান (৬১), মো. জাহিদ হোসেন (৫৫), ট্রান্সকম লিমিটেডের ম্যানেজার (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) সেলিনা সুলতানা (৪৫), ট্রান্সকম লিমিটেডের ম্যানেজার (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) কেএইচ মো. শাহাদত হোসেন (৫০), বাবুর্চি রফিক (৫৫) এবং ব্যক্তিগত চালক মিরাজুল (৪০)। এজাহারে ৭ নম্বর আসামি জাহিদ হোসেনের কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি।

মামলায় শাহরেহ হক অভিযোগ করেন, “পূর্ব পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজসে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি অন্য ওয়ারিশ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে কৌশলে বিষ প্রয়োগ/শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে সিমিন রহমানসহ অন্যদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে।“

মামলা করতে দেরি হওয়ার বিষয়ে এজাহারে বলা হয়, “নিকট আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে এজাহার দায়ের করতে বিলম্ব হইল।“

এ মামলার বিষয়ে ট্রান্সকম গ্রুপ ও সিমিন রহমানের বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বক্তব্য জানতে ট্রান্সকম গ্রুপের জনসংযোগ কর্মকর্তা মাহবুব রহমানের মোবাইলে ফোন ও এসএমএস করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

এনিয়ে ট্রান্সকমের পরিচালক শাযরেহ হক পরিবারের সদস্যসহ ট্রান্সকম গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করলেন।

এর আগে শাযরেহ অর্থ আত্মসাৎ, সম্পত্তি দখল ও অবৈধভাবে শেয়ার হস্তান্তরের অভিযোগ এনে তিনটি মামলা দায়ের করেন, যেখানে আসামি করা হয়েছে তার মা, বোন, ভাগ্নেসহ আটজনকে। ওই মামলায় ট্রান্সকমের পাঁচজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

লতিফুর রহমানের স্ত্রী শাহনাজ রহমান এখন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান। তার বড় মেয়ে সিমিন রহমান গ্রুপের সিইও। আর নাতি যারেফ আয়াত ট্রান্সকমের হেড অব ট্রান্সফরমেশন। ছোট মেয়ে শাযরেহ হকও ট্রান্সকম গ্রুপের একজন পরিচালক।

মামলায় যা বলা হয়েছে

বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যুর পেছনে এজাহারে ব্যক্তিগত চালক মিরাজুল এবং তার বাসার বাবুর্চি রফিকের হাত আছে কি না সে ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়।

গুলশানের ওসি মাযহারুল ইসলাম বলেছেন, মামলাটি দণ্ডবিধির ৩০২ এবং ৩৪ ধারায় নেওয়া হয়েছে।

শাযরেহ হক মামলায় বলেছেন, তার বাবা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমান, বোন সিমিন রহমান এবং তিনি নিজে তার বাবার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ। কিন্তু সিমিন রহমান এবং তার ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেন বিভিন্ন জাল কাগজপত্র তৈরি করে স্থাবর সকল সম্পত্তিসহ ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার এবং পজিশন থেকে তাকে এবং তার ভাইকে বঞ্চিত করে।

মামলায় বলা হয়, “এ সকল বিষয় জানার পর বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের সাথে কথা বলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৮ জুন আরশাদ ওয়ালিউর রহমান আমাকে আম মোক্তারনামা দেয়।“

আরশাদ ওয়ালিউর ‘ডিভোর্সি এবং নিঃসন্তান’ ছিলেন- মামলায় এ তথ্য দিয়ে বলা হয়, “আম মোক্তারনামা দেওয়ার কারণে সিমিন রহমান তার ভাইয়ের উপর চরম ক্ষিপ্ত হয় এবং একারণে জীবনের নিরাপত্তার কথা নিকটজনের কাছে আরশাদ ওয়ালিউর রহমান বলেছিলেন।

“এই আম মোক্তারনামা দেওয়ার আট দিনের মাথায় ১৬ জুন পিতা লতিফুর রহমানের পুরানো গৃহকর্মী মোসলেম হাওলাদারের মাধ্যমে ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমান গুরুতর অসু্স্থ বলে জানতে পেরে ভাইয়ের গুলশানের বাসায় যাই।“

ছোট বোন শাযরেহ হক মামলায় অভিযোগ করেন, সেখানে গিয়ে তার ভাইকে বিছানায় মৃত অবস্থায় দেখতে পান। যেখানে আগে থেকে সিমিন রহমান, যারাইফ আয়াত হোসেনসহ মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই ছিলেন।

শাযরেহ হক দাবি করেন, তার ভাইরে অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সংবাদ সেখানে উপস্থিত কেউ তাকে জানাননি। তাছাড়া তার ভাইয়ের কোনো জটিল রোগও ছিল না। এ ঘটনার ৩/৪ দিন আগে থেকে তার ভাইয়ের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি বলেও মামলায় বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, সিমিন রহমান ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে মৃত্যুর সার্টিফিকেট তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা এবং ওই দিনই বিকালের মধ্যে দাফন করার জন্য সকলকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এরমধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ ইউনাটেড হাসপাতালে নেওয়া হয় সেখানে চিকিৎসক ‘কেন দেরি করে আনা হল’ ‘অনেক আগেই মারা গেছেন’ বলে মন্তব্যও করেন।

হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পর হাসপাতালের চিকিৎসক আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের শারীরিক অবস্থা কি ছিল, তার কোন দূরারোগ্য ছিল কি না জানতে চাইলে সঙ্গে থাকা ডা. মুরাদ নিজেকে তার (আরশাদ ওয়ালিউর রহমান) ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে দাবি করেন এবং তিনি ‘সমস্ত জানেন’ ‘কোনো পুলিশি রিপোর্ট প্রয়োজন নেই’ বলে জানান।

এরপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ডা. মুরাদসহ সেখানে উপস্থিত কয়েকজন মরদেহ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বজন ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানানোর পর শাযরেহ হকের স্বামী আরশাদ হক ভগ্নিপতি হিসাবে লাশ গ্রহণ করেন বলে মামলায় বলা হয়।

হাসপাতালের সব কাগজপত্র মৃত্যুর সনদ ডা. মুরাদসহ অন্যরা নেন বলে মামলায় অভিযোগ করে বলা হয়, তবে মৃত্যুর সনদের একটি ছবি তার স্বামী আরশাদ হক মোবাইল ক্যামেরায় তুলে রাখেন। যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসাবে ‘অজানা’ লেখা রয়েছে।

মামলায় শাযরেহ হক দাবি করেন, পারিবারকিভাবে বনানী করবস্থানে আরও ৪টি খালি কবর থাকার পরও তাড়াহুড়া করে তার ভাইয়ের মরদেহ তার ছোট বোন শাজনীনের কবরের উপর দেওয়া হয়।

এজাহারে বলা হয়, “মৃত্যুর প্রকৃত কারণে উদঘাটনে ময়না তদন্তের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিমিন রহমানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি নিশ্চুপ ছিলেন।“

আরশাদ ওয়ালিউরের মৃত্যুর পরপরই তার বাড়ি, গাড়িসহ অন্যান্য সম্পত্তি সিমিন রহমান, যারাইফ আয়াত হোসেনসহ অন্যরা দখলে নিয়ে যায় বলে মামলায় অভিযোগ করেন শাযরেহ হক।

আরও পড়ুন

Also Read: ট্রান্সকম: মা ও বোনের বিরুদ্ধে শাযরেহর যা যা অভিযোগ

Also Read: ট্রন্সকমের গুলশান কার্যালয় থেকে নথি জব্দ

Also Read: শাযরেহ হকের মামলায় ট্রান্সকম গ্রুপের ৫ কর্মকর্তার জামিন

Also Read: শাযরেহ হকের মামলায় গ্রেপ্তার ট্রান্সকমের ৫ জন, আসামি মা-বোন-ভাগনেও