মিয়ানমারকে ’ফায়দা’ লুটতে দেব না: রাষ্ট্রদূতদের ডেকে জানাল ঢাকা

“বাংলাদেশ পশ্চিমে, দক্ষিণে মিয়ানমার আর্মি, উত্তরে আরাকান আর্মি। তাদের গোলা কোনোভাবে বাংলাদেশে আসার কথা না, যদি কেউ ইচ্ছা করে না করে।”

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2022, 08:36 AM
Updated : 20 Sept 2022, 08:36 AM

মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান ঢাকায় প্রায় সব দেশের মিশন প্রধানদের ডেকে জানিয়ে দিল সরকার।

মঙ্গলবার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় কূটনৈতিক এ ব্রিফিংয়ে আসিয়ানভুক্ত দেশের বাইরে অন্য সব দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

তাদেরকে সীমান্ত উত্তেজনার বিষয়ে ব্রিফ করেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশেদ আলম। আগের দিন সোমবার আসিয়ানভুক্ত সাত দেশের মিশন প্রধানদের একই রকম ব্রিফ করেন তিনি।

মঙ্গলবার মিশন প্রধানদের ব্রিফিং শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আজকে যারা এসেছিলেন, অন্যান্য রাষ্ট্রদূতগণ তাদেরকেও আমরা একই জিনিস বলেছি যে, আমরা রোহিঙ্গাদের নিয়েছি পাঁচ বছর হয়ে গেল, তারা একটা রোহিঙ্গাও আজ পর্যন্ত ফেরত নেয়নি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন যে, আমরা ধৈর্য্যের সাথে কাজ করতেছি।

”আসলেই, আমরা ধৈর্য্যের সাথে কাজ করতেছি। কিন্তু আমরা এমন কিছু করি নাই, যার জন্য মিয়ানমারের গোলা এসে আমাদের যে জনগণ, যারা আমাদের সীমান্তের ভিতরে আছে, তাদের জানমালের নিরাপত্তা ব্যাহত করবে এবং তারা গরু-বাছুর নিয়ে বাইরে যেতে পারবে না, তাদের ধানক্ষেতে যেতে পারবে না, তাদের ঘরবাড়িতে থাকতে পারবে না, এটাতো চলতে দেওয়া যায় না।

”এই কারণে আমরা তাদের কাছে বলেছি যে, আপনাদের সাহায্য আমরা চাই, যাতে করে মিয়ানমার এ অঞ্চলে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ভবিষ্যতে ফায়দা লুটতে না পারে, যাতে এই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে না হয়।”

বাংলাদেশ যে ‘চরম ধৈর্য্য’ ধরে পরিস্থিতির ওপর রজর রাখছে, সে কথা কূটনীতিকদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব।

তিনি বলেন, “আমরা কোনোভাবে চাই না এখানে জড়িত হতে, যাতে করে এখানে জড়িত হলে মিয়ানমার হয়ত সুযোগ পাবে, এই রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ার জন্য অজুহাত পাবে, সেই রকম কোনো অজুহাত আমরা মিয়ানমারকে এই মুহূর্তে দিতে চাচ্ছি না।”

Also Read: বাংলাদেশের দূতকে ডেকে ফের আরাকান আর্মি ও আরসাকে দুষল মিয়ানমার

Also Read: সীমান্তে গোলা: চতুর্থবার তলব মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে

Also Read: মিয়ানমারের গোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, হতাহতের খবর

Also Read: মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির মধ্যে যুদ্ধের গোলা সীমান্তে এসে পড়ছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

কূটনীতিকদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল, এ প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম বিষয়াবলি ইউনিটের এই সচিব বলেন, “তাদের যে মতামত, তারা অ্যাপ্রিশিয়েট করছে খুব… এই যে চরম ধৈর্য্য আমরা দেখাচ্ছি এবং আমরা যে কোনো উসকানিতে পা দিচ্ছি না, মিয়ানমারের কোনো উসকানিতে পা দিচ্ছি না, এটাকে তারা অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে।

”এবং তারা বলেছে, তারা তাদের ক্যাপিটালে এই জিনিসগুলো জানাবে এবং যাতে করে ভবিষ্যতে যদি কোনো কিছু করণীয় থাকে, বিশেষ করে জাতিসংঘে যদি কোনো কিছু করণীয় থাকে, তারা আমাদেরকে সে বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস প্রদান করেছে।”

মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবে এদিকে গোলা পাঠাচ্ছে কি-না, এমন প্রশ্নে নৌবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, “সেটা আমাদের ধর্তব্যের বিষয় না। ইচ্ছা করে করুক বা যা কিছুই করুক, আমরা যেটা বলি যে, এটা এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফেলবে। কাজেই মিয়ানমার সরকারকে এটা বুঝতে হবে, তাতমাদোকে (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী) বুঝতে হবে যে, তারা যেটা করতেছে…

” বাংলাদেশ হইল পশ্চিমে, দক্ষিণে হইল মিয়ানমার আর্মি, উত্তরে হইল আরাকান আর্মি। তো, তাদের গোলা কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসারতো কথা না, পশ্চিমেতো আসার কথা না। ভৌগোলিকভাবে এটা হয় না, যদি কেউ ইচ্ছাপূর্বক না করে।”

খুরশেদ আলম বলেন, “ইচ্ছাপূর্বক আমাদেরকে এই কনফ্লিক্টে জড়ানোর যে প্রচেষ্টা, সেটা আমরা (ব্রিফিংয়ে) বলছি যে, আমরা এই প্রচেষ্টায় জড়িত হব না। আমরা আপনাদেরকে এটা অবহিত করলাম, আপনারা যে অ্যাকশন নেওয়া মনে করেন, যথাযথ মনে করবেন, সেটা আপনারা নেবেন।”

কূটনৈতিক পর্যায়ের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনার বিষয়ে যোগাযোগ হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নে খুরশেদ আলম বলেন, “আমরা সর্বস্তরেই মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ রাখতেছি।

”আমি শুধু এতটুকুই বলব যে, সর্বস্তরেই আমরা যোগাযোগ রাখতেছি, যাতে করে মিয়ানমার বুঝতে পারে, যে এই রকম একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা তাদের জন্য যেমন বিপদজ্জনক, বাংলাদেশ কোনোভাবেই এটা সঠিকভাবে গ্রহণ করবে না।”

সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “ওদের ভেতরেতো গোলাগুলি হচ্ছেই, সেটা অন্য জিনিস।”

Also Read: মিয়ানমার সীমান্তে সংঘাত: আসিয়ান দূতদের ডেকে অবস্থান জানাল বাংলাদেশ

Also Read: মিয়ানমার সীমান্তে আহত তঞ্চঙ্গ্যার পা কাটতে হল

Also Read: মিয়ানমার থেকে গোলা আসা বন্ধ না হলে জাতিসংঘে তুলব: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

Also Read: মিয়ানমার সীমান্তে বিস্ফোরণ: পা ‘হারাতে বসা’ যুবকের সঙ্গে ‘দিশেহারা’ পরিবারও

২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার অধিকাংশই সীমান্ত জেলা কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে রয়েছেন।

তাদের ফেরত নিতে দুই দেশের সরকার চুক্তিবদ্ধ হলেও পাঁচ বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি, আর সেজন্য মিয়ানমারকেই দায়ী করে আসছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।

এর মধ্যে গত অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমারের রাখাইনদের সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর নতুন করে সংঘাত শুরু হয়।

শুরুর দিকে বাংলাদেশের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তমব্রু, কোনার পাড়া, উত্তর পাড়া ও বাইশফাঁড়িসহ বিভিন্ন সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গোলাগুলির খবর আসছিল। পরে পুরো নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মিয়ানমার সীমান্তজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে।

ওই এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই দিনে ও রাতে থেমে থেমে গোলাগুলি চলছে। মাঝে মধ্যে হেলিকপ্টার ও জেট ফাইটার থেকেও ছোড়া হচ্ছে গোলা।

গত শুক্রবার রাতে মিয়ানমার থেকে আসা গোলা সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরিত হলে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন। ওইদিন সকালেই ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে ‘মাইন’ বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশি যুবকের পা উড়ে যায়।

এর আগে গত ২৮ অগাস্ট দুপুরে বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টারে গোলা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে এসে পড়ে।

সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর চতুর্থবারের মত তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপর সোমবার ইয়াঙ্গনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিম খান চৌধুরীকে ডেকে মিয়ানমারের ব্যাখ্যা তার সামনে তুলে ধরা হয়।

তাতে সীমান্তে মর্টার হামলার দায় আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ওপর চাপানো হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের ভেতরে আরাকান আর্মি ও আরসার ‘ঘাঁটি’ থাকার অভিযোগ তুলে সেগুলোর তদন্ত ও অপসারণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয় মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে খুরশেদ আলম বলেন, “এটা মিয়ানমার আজকের কথা না, তারা প্রথম থেকেই এ ধরনের কথা বলে আসতেছে। কিন্তু আমরা দৃঢ়ভাবে বলেছি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যে নীতি সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে শূন্য সহিষ্ণুতা… আমরা সেই নীতিতে বিশ্বাস করি।

”কাজেই অন্য দেশের কোনো রকম কাউকেই আমরা বাংলাদেশে স্থান দিয়ে মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করার অভিপ্রায় বাংলাদেশের কোনোদিন ছিল না, এখনো নাই, ভবিষ্যতেও থাকবে না।”