“উপন্যাসটিতে পাকিস্তানিদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাবও দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দোকানির ইয়াহিয়া খানের ছবিতে থুতু দিয়ে মোছা আর পাকিস্তানের প্রতি এক ভিক্ষুকের গালি সেটিই স্পষ্ট করে। এটি একাত্তরের চেতনায় সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার স্মরণীয় উপন্যাস।”
Published : 26 Mar 2025, 09:51 AM
‘আগুনের পরশমণি’ মূলত একাত্তরের অবরুদ্ধ ঢাকার গল্প। সেই আগুনঝরা দিনগুলোতে মধ্যবিত্ত একটি পরিবারকে ঘিরে এই উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে।
আশির দশকে লেখা উপন্যাসটি থেকে লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিজেই নব্বইয়ের দশকে চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছিলেন। সরকারি অনুদানে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটিই হুমায়ূনের প্রথম চলচ্চিত্র এবং প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেই একাধিক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যচর্চার জন্য আশির দশককে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেন সাহিত্যবোদ্ধারা। কারণ এ দশকেই সৈয়দ শামসুল হক, শহীদুল জহিরসহ অনেক সাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। হমায়ূন আহমেদও ‘আগুনের পরশমণি’ লেখেন এ সময়ে।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে বা বাংলাদেশের সাহিত্যে হুমায়ূনের অবস্থান কোথায় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ‘হুমায়ূন আহমেদ: পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য’ নামে বই লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম।
বর্তমানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য রচনার আলোচনায় আশির দশকের সময়টি বুঝতে হবে। তখন কেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য রচনা বেশি হয়েছে, তাও আলোচনায় আনতে হবে। সে সময় যে সাহিত্য রচিত হয়েছে, সেগুলো গুণে-মানে একটা পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রচুর প্রশ্ন আছে। কিন্তু পরিমাণের দিক থেকে কোনো ঘাটতি নেই।
লেখা আছে অশ্রুজলে
বলা হয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য খুব একটা হয়নি। তবে যা হয়েছে, তা-ও নেহায়েত কম নয়। যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে রচিত সেই সব কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটকের কয়েকটি নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন। সপ্তম পর্ব কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাস ও সিনেমা নিয়ে। |
প্রথম পর্ব: পাড়াতলী থেকে কোটি প্রাণে মুক্তি আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়েছিল ‘স্বাধীনতা তুমি’
দ্বিতীয় পর্ব: চিরকালীন মুক্তিসংগ্রামের গল্প 'সময়ের প্রয়োজনে'
তৃতীয় পর্ব: জীবনের বাস্তবতাই মূলত 'রাজনৈতিক বাস্তবতা'
চতুর্থ পর্ব: 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়'- মুক্তির পদধ্বনি
পঞ্চম পর্ব: 'উচ্চারণগুলি শোকের'- মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানোর অমোঘ বেদনার চিত্রকল্প
ষষ্ঠ পর্ব: 'হাঙর নদী গ্রেনেড': মুক্তিযুদ্ধে নারীর আত্মত্যাগের বয়ান
“মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সৃজনশীল সাহিত্যের পাশাপাশি গবেষণা-ফিচার এবং ব্যক্তিগত নানা মতামত বা গানও লেখা হয়েছে এই দশকে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের পুরো ব্যাপারটিতে আমি হুমায়ূন আহমেদকে খুবই উঁচু মূল্য দিয়ে থাকি।”
কেন মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে হুমায়ূন গুরুত্বপূর্ণ
মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার কারণেই হুমায়ূন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অধ্যাপক আজম।
তিনি বলেন, “আমাদের বেশিরভাগ মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক লেখালেখির প্রধান সংকট হলো তারা ধরেই নিয়েছেন একটা পক্ষ শয়তান, আরেক পক্ষ ফেরেশতা। ফলে উপন্যাস, গল্প, সিনেমার কাজ হলো এই দুইয়ের লড়াই দেখানো। কিন্তু আমরা জানি, জীবন এত সরল নয়। শিল্পের জন্য এগুলো খুবই নিম্ন শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি।
“হুমায়ূন ‘আগুণের পরশমণি’ উপন্যাসে, যা নিয়ে পরে তিনি সিনেমা বানিয়েছেন, তাতে জনমানুষের গল্পকে তুলে এনেছেন,” এমনটাই অধ্যাপক আজমের অভিমত।
তিনি বলেন, “হুমায়ূন আহমেদ আলাদা এখানেই। অন্যরা যখন শুধুমাত্র বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্রে রেখে লেখালেখি করছেন। হুমায়ূন সেখানে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, আবার মেইনস্ট্রিম যে ছক- ভাবাদর্শিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে- তাকে বাদ নিয়ে নয়। এটাকে সঙ্গে রেখেই তিনি নিজস্ব যে ভাবাদর্শিক অবস্থান, তা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছেন।”
‘আগুনের পরশমণি’ কেন গুরুত্বপূর্ণ তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “এই উপন্যাসটি ভাবাদর্শ তাড়িত। তারপরও উপন্যাসটিতে জীবনের বাস্তবতা দারুণভাবে এসেছে। মানুষ তো যন্ত্রের মতো শুধুমাত্র একটা মতাদর্শ তাড়িত হয়ে চলে না, যুদ্ধও করে না। তার বিচিত্র মাত্রা আছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ অবস্থান গ্রহণের ব্যাপার আছে। এই বিচিত্র ব্যাপারকে সমন্বয় করার ব্যাপারটি ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাসে আছে।”
তবে ‘আগুনের পরশমণি’ থেকেও হুমায়ূনের লেখা ‘১৯৭১’ উপন্যাসটিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অধ্যাপক আজম।
তার ভাষ্য, “আমি মনে করি ‘১৯৭১’ একটা ক্লাসিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের যে চিত্রায়ণ আছে, তা অসামান্য। হুমায়ূনের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে আরেকটি বিশেষ দিক হলো তিনি মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ হিসেবে দেখেছেন। অনেকেই মুখে মুখে বলেন যে, মুক্তিযুদ্ধ হলো জনযুদ্ধ। কিন্তু এই জনযুদ্ধ বলার যে কারণ, তার প্রয়োজনীয় যে উপকরণ, তা অধিকাংশের লেখাতেই হাজির থাকে না। হুমায়ূন সেটা সফলভাবে করতে পেরেছেন।
“যারা যুদ্ধ করছে, তারা কোথা থেকে আসল? যারা সাহায্য করছে, তাদের অবস্থান কী? যারা যুদ্ধ করছে না, বিরোধিতাও করছে না। সেই জনগোষ্ঠী কীভাবে ব্যাপারটির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তার বিশদ ব্যাখ্যা এসেছে হুমায়ূনের লেখায়। আর হুমায়ূন একক কোনো মতাদর্শ তাড়িত হয়ে লেখেননি। ফলে তার মুক্তিযুদ্ধের লেখা কেবল শয়তান-ফেরেশতার লড়াই হিসেবে হাজির হয়নি।”
পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার চিত্র অন্য অনেকের চেয়ে হুমায়ূনের লেখায় বেশি হাজির বলেও মনে করেন অধ্যাপক আজম।
লেখক ও গবেষক সালেক খোকন বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ‘ক্র্যাক প্লাটুনের’ যোদ্ধা শহীদ বদিউল আলম বদির (বীরবিক্রম) যুদ্ধদিনের ঘটনা নিয়েই হুমায়ূন আহমেদ রচনা করেছেন ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাসটি।
যেখানে গেরিলাদের বীরত্বের ঘটনাসহ নগরের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের সহযোগিতার ইতিহাসও উঠে এসেছে।
“উপন্যাসটিতে পাকিস্তানিদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাবও দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। দোকানির ইয়াহিয়া খানের ছবিতে থুতু দিয়ে মোছা আর পাকিস্তানের প্রতি এক ভিক্ষুকের গালি সেটিই স্পষ্ট করে। এটি একাত্তরের চেতনায় সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার স্মরণীয় উপন্যাস।”
কথাসাহিত্যিক রুমা মোদক বলেন, “একাত্তরে অবরুদ্ধ নগরজীবন। আতঙ্ক আর উৎকন্ঠা- মুক্তিকামী মানুষের জনমানস এতো নিপুণ কৌশলে হুমায়ূন আহমেদ ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাসে বয়ান করেছেন, যা সময়ের বিশ্বস্ত দলিল হয়ে উঠেছে। অথচ তিনি লিখেছেন ফিকশন। কোনোরকম ডকুমেন্টেশনে যাননি। একটা ফিকশন কীভাবে ডকুমেন্টারি হয়ে উঠতে পারে, কোনো তত্ত্ব বা তথ্যের ভার ছাড়াই, ‘আগুনের পরশমণি’ সেদিক থেকে সাহিত্যের একটি লেসন বলা যায়।”
প্রথম প্রকাশ
‘আগুনের পরশমণি’ প্রথম বই আকারে আসে ১৯৮৬ সালে। বইটির যে সংস্করণ এখন বাজারে পাওয়া যায়, তা প্রকাশ করেছে ‘অন্যপ্রকাশ’। ২০০৫ সালে অন্যপ্রকাশ এ সংস্করণটি বাজারে আনে।
‘আগুনের পরশমণি’ প্রথম কারা প্রকাশ করেছিল, তা জানতে অন্যপ্রকাশ সংশ্লিষ্ট একাধিকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা নিশ্চিত করতে পারেননি।
নব্বইয়ের দশকে হুমায়ূন আহমেদের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ হয়েছে ‘সময় প্রকাশন’ থেকে। প্রকাশনীটির স্বত্ত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ বলেন, “সম্ভবত মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ‘আগুনের পরশমণি’। তবে আমি নিশ্চিত নই।”
মাওলা ব্রাদার্সের প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হক বলেন, উপন্যাসটির তাদের প্রকাশিত নয়।
“তবে ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমার শুটিং আমাদের ওয়ারির বাসায় হয়েছিল। বইটি প্রথম কারা প্রকাশ করেছিল, তা এখন মনে করতে পারছি না। এটা মনে আছে যে উপন্যাস থেকে হুমায়ূন আহমেদ যখন সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লিখলেন, সেই চিত্রনাট্যটি সুবর্ণ প্রকাশন থেকে প্রকাশ হয়েছিল।”
হুমায়ূন আহমেদের ছোট ভাই লেখক-কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবকে ফোন করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে সময় হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ বই প্রকাশ করেছে ‘অনিন্দ্য’। যতদূর মনে পড়ে ‘অনিন্দ্য’ থেকেই বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল।”
প্রকাশনা সংশ্লিষ্টদের একাধিকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনিন্দ্য নামে ওই প্রকাশনা সংস্থাটির প্রকাশক নাজমুল হক মারা যাওয়ার পর প্রকাশনীটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ বই প্রকাশ করত স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্স, সময় প্রকাশন, কাকলী প্রকাশনীসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে হুমায়ূনের জীবদ্দশাতেই তার প্রায় সব বইয়ের প্রকাশক হয়ে যায় অন্যপ্রকাশ।
সিনেমার পর্দায় ‘আগুনের পরশমণি’
‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাস থেকে সরকারি অনুদানে সিনেমা নির্মাণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৪ সালে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। এই সিনেমা দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে হুমায়ূনের।
‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাস যে সিনেমায় রূপ নেবে, তার আঁচ পাওয়া যায় লেখকের একাধিক নাটকেও। আশির দশকের শেষ দিকে তার ‘বহুব্রীহি’ ধারাবাহিক নাটক তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এই নাটকের শেষ দুই পর্বের পুরো অংশ জুড়েই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন তিনি।
নাটকে টিয়া পাখির মুখ দিয়ে ‘তুই রাজাকার’ বলা সংলাপটি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনেরও অংশ হয়ে ওঠেছে।
হুমায়ূন আহমেদের একান্ত ঘনিষ্ঠজন সাহিত্যিক শাকুর মজিদ বলেছেন, “১৯৮৮-৮৯ সালের সময়টাতে এরশাদ ক্ষমতায়। টেলিভিশনে ‘পাকিস্তানি হানাদার’ বলা নিষিদ্ধ, শুধু হানাদার বলতে হয়। বেশ কয়েকজন কথিত রাজাকার এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য। ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশ টেলিভিশন বা রেডিওতে রাজাকার শব্দ ব্যবহার হয়নি।
“মুক্তিযুদ্ধের এ বিষয়টা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদকে অনেক জটিল পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে। তার বাবাকে পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল, আবার তার নানা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। এ দুপক্ষকেই তিনি দেখেছেন।”
‘আগুনের পরশমণি’র গল্প ও কলাকুশলী
‘আগুনের পরশমণি’র পটভূমিতে দেখা যায়, মতিন সাহেব, তার স্ত্রী, দুই কন্যা রাত্রি ও অপলা এবং কাজের মেয়ে বিন্তিকে নিয়ে বসবাস করেন। একাত্তরের একদিন এই পরিবারে আশ্রয় নেয় মুক্তিযোদ্ধা বদি। এখান থেকেই সে ঢাকায় গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে।
সেই অপারেশনে বদির সহযোদ্ধারা কেউ নিহত হয়, কেউ পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে মৃত্যুবরণ করে। বদিও আহত হয়ে মতিন সাহেবের বাসায় আসে। এক পর্যায়ে তার মৃত্যু হয়।
‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমায় মুক্তিযোদ্ধা বদির মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দিলারা জামান। সেই স্মৃতি মনে করে অভিনয়শিল্পী দিলারা জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আমার অভিনীত প্রথম সিনেমা। ছোট একটা চরিত্র করেছি।”
“প্রথমে সিনেমাটি করতে রাজি হইনি, কারণ আমি তখন স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। তবে হুমায়ূন আহমেদ ছুটির দিনেই আমার অংশের শুটিং রেখেছিলেন। পুরান ঢাকায় হয়েছিল শুটিং। আসাদুজ্জামান নূরের মায়ের চরিত্রটি আমি করেছি, নূর ‘বদি’ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সিনেমায়।
“সেই দৃশ্যটা এমন ছিল যে আমি সন্তানের গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছি, ‘তুই তো ভালোমত খাস না কতদিন, শুকিয়ে গেছিস’। এর মধ্যে খবর এসেছে পাকবাহিনী চলে এসেছে, তার চলে যেতে হবে। তখন বদি মানে চরিত্রটির অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর বাড়ির পেছনের ছোট একটা পাইপ দিয়ে নিচে নেমে পালিয়ে যাবেন। এই পাইপ বেয়ে নামার দৃশ্যটায় সবাই ভয়ে ছিল, যদি কিছু হয়ে যায়। কিন্তু নূর খুব দক্ষতার সাথে নেমে গিয়েছিলেন। এই দৃশ্যের কথা এখনো ভুলতে পারিনি।”
সিনেমাটির আরেক অভিনয়শিল্পী ডলি জহুর বলেন, “আমি তো মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, ফলে আমার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগ আছে। সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে যুদ্ধ দেখার যে আবেগ সেটা পুরোপুরি ধরতে পেরেছিলাম, ফিল করেছিলাম। এফডিসিতে সেট বানিয়ে আমরা সিনেমাটির শুটিং করেছিলাম।”
কতটা শিল্পমান উত্তীর্ণ?
‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমাটি মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে অনবদ্যভাবে তুলে ধরলেও নির্মাণ প্রক্রিয়া নিয়ে এ প্রজন্মের কোনো কোনো চলচ্চিত্র সমালোচক সন্তুষ্ট নন। তবে মুক্তিযুদ্ধে ঢাকার গেরিলা যোদ্ধাদের যুদ্ধদিনের চিত্রায়ণের কারণে সিনেমাটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াতের ভাষ্য, “নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের গল্প এই সিনেমায় চমৎকারভাবে এসেছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিনেমা হিসেবে এটা কখনো কখনো মনে হয়েছে একটু বেশি ‘রোমান্টিক’।”
সিনেমায় যুদ্ধদিনে নগরে মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্পটা ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে বলেও মনে করেন অনুপম হায়াৎ।
“একজন দোকানদার ইয়াহিয়ার ছবিতে থুথু দিয়ে আবার মুছে ফেলার মধ্য দিয়ে বাঙালির ঘৃণা এবং ভয়ের যে চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা অনবদ্য। মুক্তিযোদ্ধা বদির মৃত্যুর দৃশটাও অনবদ্য। একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে, তখন সূর্যের আলো এসে পড়ছে। এটাও ভাবনাকে উসকে দেবে।”
এটি একটি অনবদ্য সিনেমা। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমার মধ্যে এই সিনেমাটি এগিয়ে থাকবে বলেও মনে করেন অনুপম হায়াৎ।
তবে চলচ্চিত্র সংগঠক বেলায়াত হোসেন মামুন ও চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু বলছেন, সিনেমাটি শিল্পমানের বিচারে মাঝারি মানের। অবশ্য সিনেমাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মনে করেন।
কান চলচ্চিত্র উৎসবে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিকসের (ফিপরেস্কি) বিচারকের দায়িত্ব পালন করা বিধান রিবেরু বলেন, “সাহিত্য থেকে সিনেমায় যখন রূপান্তর হয়, তখন নানা রকম রূপান্তর হতে পারে। কখনো ছায়া অবলম্বনেও সিনেমা হয়। হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ সিনেমায় যে ভাবনার অবকাশ খুব কম ছিল, কেননা যিনি ঔপন্যাসিক তিনিই চলচ্চিত্রকার। তবে সিনেমাটি যে সময়ে নির্মিত হয়েছে, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ একটি সিনেমা।”
মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি বেলায়াত হোসেন মামুন বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে 'আগুনের পরশমণি' বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ৷ কারণ, ‘আগুনের পরশমণি’র আগপর্যন্ত ঢাকার গেরিলা যোদ্ধাদের যুদ্ধদিনের চিত্রায়ণ আমরা আর দেখিনি৷
“সীমিত আর্থিক সামর্থ্যে হুমায়ূন আহমেদ তার প্রথম চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের যে ভালোবাসা এবং সততার উদাহরণ তৈরি করেছেন, তা এর আগের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক চলচ্চিত্রে শুধু যে অনুপস্থিত ছিল তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে অনেকের চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থাপন ছিল অবমাননাকর।”
তবে সিনেমাটি শিল্পমানের বিচারে সুনির্মিত ও নির্ভুল কোনো চলচ্চিত্র নয় বলেও মনে করেন মামুন।
মামুন বলেন, “ছবিটি নির্মাণের ক্ষেত্রে হয়ত শিল্পমানের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সঠিক এবং আন্তরিক উপস্থাপনাকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়েছে, যা ছবিটি দেখতে বসে সবসময় অনুভব করা যায়৷ ‘আগুনের পরশমণি’র আবেগময়তা এবং সত্যনিষ্ঠতাই ছবিটির প্রধান সৌন্দর্য।”