সৈয়দ শামসুল হক ‘নাটকের করণকৌশল’ লেখায় বলেছেন, “…লন্ডনের ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মনে মনে রচনা করে চলি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।”
Published : 23 Mar 2025, 08:28 AM
মুক্তিযুদ্ধের তখন শেষ সময়। গ্রামের নারী-পুরুষ এসেছেন মাতব্বরের কাছে। তাদের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। মাতব্বর সবাইকে আশ্বাস দিচ্ছেন, কিন্তু গ্রামবাসী মাতব্বরের কথায় আশ্বস্ত হতে পারেন না।
একসময় ঘর থেকে বের হন মাতব্বরের মেয়ে। সবার সামনে বলেন, বাবা জোর করে কলেমা পরিয়ে তাকে ক্যাপ্টেনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অবাক গ্রামবাসী। আর সেই বীরাঙ্গনা আত্মাহুতি দেন। নিস্তার মেলেনি রাজাকার মাতব্বরেরও। খুন হন তিনি।
এমন পটভূমিতে রচিত ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটির মধ্য দিয়ে সত্তরের দশকে বাংলা সাহিত্যে ‘কাব্যনাট্যে’র এক নতুন যাত্রার সূচনা করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা প্রথম কাব্যনাটক সৈয়দ হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।
পাঠক ও দর্শকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবে চিহ্নিত হলেও, এ নাটক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নাটক হিসেবে রচনা করেননি বলে ‘নাটকের করণকৌশল’ শিরোনামে এক লেখায় জানিয়েছেন সৈয়দ হক।
লেখা আছে অশ্রুজলে বলা হয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য খুব একটা হয়নি। তবে যা হয়েছে, তা-ও নেহায়েত কম নয়। যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে রচিত সেই সব কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটকের কয়েকটি নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন। চতুর্থ পর্ব সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটক নিয়ে। |
প্রথম পর্ব: পাড়াতলী থেকে কোটি প্রাণে মুক্তি আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়েছিল ‘স্বাধীনতা তুমি’
দ্বিতীয় পর্ব: চিরকালীন মুক্তিসংগ্রামের গল্প 'সময়ের প্রয়োজনে'
তৃতীয় পর্ব: জীবনের বাস্তবতাই মূলত 'রাজনৈতিক বাস্তবতা'
তার ভাষ্য, “এই নাটকে একাত্তর একটি পরিচিত ও আমাদের প্রত্যেকের জীবন-স্পর্শকারী পটভূমি মাত্র। আমি চেয়েছি মুক্তিযুদ্ধকে পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করে আরো বড় একটি মুক্তির জন্যে দর্শককে প্রাণিত করতে- সে মুক্তিযুদ্ধ ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ধর্মের নৌকোয় নৈতিক অন্যায়কে পার করিয়ে দেবার যুগযুগান্তরের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে।”
কবে লেখা?
নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, সৈয়দ শামসুল হক নাটকটি লেখেন ১৯৭৫ সালের মে-জুন মাসের দিকে। তিনি তখন লন্ডনে বিবিসিতে কাজ করতেন। দেড় মাস সময়ের মধ্যে নাটকটি লেখেন তিনি।
“সৈয়দ হক নাটকটিতে প্রথমে কিছু লাইন প্রমিত বাংলায় লিখেছিলেন। পরে তিনি নিজেই মনে করেছিলেন, যে এটি সাধারণ মানুষের ভাষা হয়ে উঠছে না। পরে তিনি আঞ্চলিক ভাষায় লিখলেন। নাটকটির বড় গুণ হচ্ছে, সংলাপগুলোতে উপমা এবং প্রতীকের যথোপযুক্ত ব্যবহার। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষেরা কিন্তু কথায় কথায় উপমা দেয়। সেটা এই নাটকে তিনি সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন।”
সৈয়দ শামসুল হক ‘নাটকের করণকৌশল’ লেখায় বলেছেন, দেশ থেকে বহুদূরে বসে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ লিখেছিলাম। এক কামরার ছোট একটি ঘরে, শীতার্ত লন্ডন নগরীতে। সে বছর ১৯৭৫ সাল। আমি ভোরে উঠে কাজে বেরোই ছাইরঙা মোটা ট্রেঞ্চকোট পরে, পাতাল রেলের ইস্টিশানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি ট্রেনের। লন্ডনের ইস্টিশানের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মনে মনে রচনা করে চলি ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।
এই নাটকের বীজ মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব একটি ঘটনা থেকে পেয়েছেন উল্লেখ করে সৈয়দ হক বলেন, “এমন ঘটনা বাংলাদেশে সেদিন প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই ঘটেছিল বলে আমরা দেখতে পাবো। আমরা দেখতে পাবো যে, হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা সহায়তা করেছিল তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত ঐ হানাদার বাহিনীরই শিকারে পরিণত হয়েছিল।”
লিখেছিলেন মঞ্চের জন্যই
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মঞ্চের জন্যে লেখা সৈয়দ হকের প্রথম নাটক। তার ভাষ্যে- “প্রথম এই অর্থে, মঞ্চে অভিনীত হবে, সচেতন সেই ভাবনা নিয়ে লেখা।”
ষাটের দশকের শেষ দিকে টেলিভিশনের জন্যে বেশ ক’টি নাটক লিখলেও সেগুলো কোনোটিকেই নাটক রচনার অন্তর্গত বলে মনে করেন না সৈয়দ হক।
“বলা যেতে পারে ও সবই ছিল আমার শিক্ষানবীশী,” বলেছিলেন লেখক।
১৯৭৬ সালের ২৫ নভেম্বর, ঢাকার মহিলা সমিতি মঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়েছিল কালজয়ী এ কাব্যনাট্য। এটি মঞ্চে আনে নাট্যদল ‘থিয়েটার’। সবশেষ গত ডিসেম্বর মাসে নাটকটির ২১০তম প্রদর্শনী হয়েছে বলে জানিয়েছেন ‘থিয়েটার’ এর পরিচালক (সাংগঠনিক) রামেন্দু মজুমদার।
“১৯৭৬ সালে সৈয়দ হক লন্ডন থেকে একবার ছুটিতে ঢাকায় এলেন। তখন তিনি আমাকে এবং আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে এই পাণ্ডুলিপিটা দিলেন। পরে নাটকটির মহড়ায় আব্দুল্লাহ আল-মামুন কিছু পরিমার্জন করেছিলেন।”
উদাহারণ টেনে রামেন্দু মজুমদার বলেন, “নাটকে যে যুবকের সংলাপ, সেটা দীর্ঘ ছিল। তখন মামুন যেটা করল, সংলাপকে ভাগ করলো যুবক-১, যুবক-২, এরকম করে। এভাবে কিছু কিছু জায়গায় পরিবর্তন হলো মহড়ায়।”
এই নাটকটি মঞ্চে আনা সাহসী কাজ ছিল উল্লেখ করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, “১৯৭৬ সালের ২৫ নভেম্বর আমরা নাটকটি প্রথম মঞ্চে আনি। তখন তো দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে নাটকটি মঞ্চে আনা ভীষণ সাহসের ব্যাপার ছিল।”
“নাটকটি যখন মঞ্চে আসে, তখনও বই আকারে প্রকাশ হয়নি, তারও কয়েক বছর পর এটি বই আকারে প্রকাশ হয়েছিল”– বলছিলেন রামেন্দু মজুমদার।
এক দশক আগে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি চারুলিপি প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়, এই সংকলনটিই এখন বাজারে পাওয়া যায়। এছাড়া সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য সংগ্রহেও নাটকটি সংকলিত আছে।
চারুলিপির প্রকাশক হুমায়ূন কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নাটকটি প্রথম বই আকারে প্রকাশ হয় ১৯৭৭ সালে। তখন সৈয়দ হকের নিজেরই একটা প্রকাশনা ছিল, নাম ছিল ‘সব্যসাচী’। তার ছোট ভাই সৈয়দ আমজাদ হুসাইন রাজা প্রকাশনীটির দায়িত্বে ছিলেন। পরে প্রকাশনীটি বন্ধ হয়ে যায়, রাজাও মারা যান।
“সৈয়দ হকের লক্ষ্মীবাজারের বাড়িতে ছিল প্রকাশনীটির অফিস। পরে সম্ভবত ২০১২ সালের দিকে সৈয়দ হক আমাকে নাটকটি দেন প্রকাশ করার জন্য। চারুলিপি থেকে আমরা তখন প্রকাশ করি।”
যেখানে বিশেষত্ব
‘বাচ্চার খিদার মুখে শুকনা দুধ দিয়া/ খাড়া আছি খালি এক জোড়া চক্ষু নিয়া’- এই সংলাপের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় সকল নিপীড়নের বর্ণনার সঙ্গে ক্ষুধার এই অসহ, নির্লিপ্ত বয়ান পাওয়া যায় কাব্যনাট্যে।
কবি ও নাট্যকার শুভাশিস সিনহা বলেন, “পটভূমি একাত্তর হলেও নাটকটি লেখা হয় পঁচাত্তরে। সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা প্রথম নাটক এটি। প্রোটাগনিস্ট বা নায়কের ধারণা সরিয়ে এই নাটকে একটি গ্রামের জনতাই নায়ক হয়ে ওঠে। তারা ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়েই নতুন জয়যাত্রার কাহিনি রচনা করেন।”
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চলনে আঞ্চলিক শব্দ ও বাকভঙ্গির সামান্য প্রয়োগে, ধর্ম সংস্কার গ্রামীণ সামাজিক স্বভাব রীতি ও মিথিক্যাল প্রসঙ্গের সংযোগে, কাব্যভাষার জনসংলগ্ন রূপায়নে এ নাটকের সংলাপ তীব্র, ব্যঞ্জনাময় বলে মনে করেন শুভাশিস সিনহা।
তার ভাষ্য, “একাত্তর বা মুক্তিযুদ্ধকে এখানে গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতার নানান দ্বন্দ্ব, শ্রেণিগত বিরোধ বৈষম্যের মধ্য দিয়েও দেখার চেষ্টা আছে। নেতিবাচক চরিত্রের এক ধরণের ইতিবাচক উপলব্ধি ও তৎপরতার মধ্য দিয়ে কাহিনির মোড় পাল্টে যায়। বিষয়টি প্রথাগত মনে হলেও লেখকের ভাষার মুন্সিয়ানায় তা বিশেষ হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের এক ব্যাপ্ত রূপের নান্দনিক প্রকাশ এ কাব্যনাট্য।”
নাট্যকার রুমা মোদক বলেন, “‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ লেখা হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বদেশে এই নাটকটির সময়কাল এবং বক্তব্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমরা পরপর কয়েকটি প্রজন্ম যে রাজনৈতিক বাতাবরণে বড় হয়েছি, বলা যায় সেই রাজনৈতিক বাতাবরণে নাটকটি ছিল সময়ের সাহসী উচ্চারণ। সমকালীনতা অতিক্রম করে, যা কি না এখনো সমান উপযোগিতা ধারণ করে।
প্রথমবার আমি নাটকটি দেখেছিলাম বিটিভির পর্দায়। এখন আমি ভেবে খুব অবাক হই, বিটিভির মতো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান তখন নাটকটি প্রচার করতে পেরেছিল।”
বিষয়, আঙ্গিক, সময়কাল এবং অভিনয়শিল্পী- সব মিলিয়ে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিহাসের মাইল ফলক বলেও মন্তব্য করেন রুমা মোদক।
নাট্যজন রামেন্দু মজমুদার মনে করেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যত নাটক হয়েছে তার মধ্যে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ অন্যতম প্রধান।
“এই নাটকে রাজাকারকে বড় করে দেখানো হয়েছে বলে কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্যও করেন, তবে তা ঠিক নয়। মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের যে পতন হয়েছে, তা দেখানো হয়েছে। সৈয়দ হক নাটকটি রচনা করেছেন কাব্যে। আমাদের এক সময় একটা ধারণা ছিল, যে কাব্যনাট্য মানে কেবলই কবিতা। এটা নাটক হয়ে ওঠে না। কিন্তু কাব্যনাট্য যদি যথার্থভাবে রচিত হয়, তবে কাব্যনাট্যও মানুষের মনে ভীষণ অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। তার একটি উজ্জ্বল উদাহারণ ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। এই নাটকটি আমাদের দেশে কাব্যনাট্যের একটা বড় ভিত রচনা করেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, “বাংলা সাহিত্যে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এই জন্য যে এর যে কাব্যরীতি, তা বাংলা সাহিত্যে নতুন পথ উন্মোচন করেছে।
“স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের আরবান থিয়েটারে কমিউনিটি গল্পকে এত বৃহৎ ক্যানভাসে নিয়ে আসা এই নাটকের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জনমানুষের গল্পকে তুলে আনা হয়েছে।
ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়া এবং পরবর্তীকালে লন্ডনে থাকার অভিজ্ঞতা সৈয়দ হককে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে এবং সেই প্রভাব তার লেখায় এসেছে বলেও মনে করেন সুদীপ।
মহড়ার স্মৃতি
চার যুগেরও বেশি সময় ধরে সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকে নিয়মিত অভিনয় করেছেন নন্দিত অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। প্রথম দিকে মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করলেও এখন তিনি বৃদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করছেন। নাটকটির ২১০টি মঞ্চায়ন হয়েছে, যার সবগুলোতেই অভিনয় করার অভিজ্ঞতা আছে ফেরদৌসী মজুমদারের।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “এ নাটকটি নিয়ে যখন মহড়া শুরু হলো, প্রথম দিকে আসলে কিছুই বুঝিনি। নাটকের অর্থ বুঝতেই অনেক সময় লেগেছে। প্রথম মনে হয়েছে, করতে পারব না হয়তো। তখন আব্দুল্লাহ আল-মামুন আমাদের সাহস যুগিয়েছেন।”
নাটকটির মেয়ের চরিত্রে ফেরদৌসী মজুমদারকে মনোনীত করেছিলেন নাট্যনির্দেশক আব্দুল্লাহ আল-মামুন।
ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, “তিনি আমাকে চরিত্রটা বুঝিয়ে দিলেন। একটা গ্রামের মেয়ে, খুবই প্রতিবাদী চরিত্র। তার একটা শক্তি ছিল প্রতিবাদ করার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। আমি যখন প্রথম নাটকটিতে অভিনয় করেছি, তখন অনেকটা না বুঝেই করেছি। পড়তে গেলে কবিতা পাঠের মতো হয়ে যেত। পরে আমাদের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-মামুন বুঝিয়ে দিতেন, যে এটা কবিতার মতো করে লেখা হয়েছে, তবে অভিনয়ের সময় কবিতার মতো করে পড়া যাবে না।”
নাটকটিতে শুরুর দিকে পীরের চরিত্রে অভিনয় করতেন মোহাম্মদ জাকারিয়া। সেই স্মৃতি মনে করে ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, “তার অভিনয় ছিল অতুলনীয়।”
প্রথম মহড়ার স্মৃতি মনে করে রামেন্দু মজুমদার বলেন, “মহড়া শুরু হলে দেখা গেল সংলাপ পাঠে সবার মধ্যে একটা সুর চলে আসে। তখন মামুন বলল, যে এটা তো ছড়া নয়। সুর দিয়ে বললে হবে না। এটা কথার মতো করে বলতে হবে এবং মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় তালে তালে কথা বলতে হবে। প্রথমে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল, কারণ কাব্যনাট্যে তো আমাদের শিল্পীরা অভিনয় করতে অভ্যস্ত নয়। পরে শিল্পীরা খুবই যত্নের সঙ্গে এবং পরিশ্রম করে তারা নাটকটি আয়ত্ত করেছে।”
মাইলফলক প্রদর্শনী
১৯৯০ সালের ২৩ মার্চ ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকের শততম প্রদর্শনী করে নাট্যদল ‘থিয়েটার’। ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে নাটকটির ২০০তম প্রদর্শনী হয়।
এছাড়া ১৯৮১ সালের ১০ মার্চ দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিআই) আয়োজিত পঞ্চম তৃতীয় বিশ্ব নাট্যোৎসবে নাটকটির দুটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের বাইরে অন্য কোনো দেশে এটিই ছিল প্রথম কোনো বাংলাদেশের নাট্যদলের নাটকের মঞ্চায়ন।
১৯৮৭ সালের ২৫ মার্চ সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাদদেশে নাটকটির একটি প্রদর্শনীও হয়েছিল। এই প্রদর্শনীটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন রামেন্দু মজুমদার।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, “১৯৮১ সালে প্রথম যখন আইটিআই নাট্যোৎসবে এ নাটকটি নিয়ে যায়, তখনও আইটিআই নিয়ে আমাদের ধারণা ছিল না। সেখানে গিয়েই আমরা আইটিআই-এর সঙ্গে পরিচিত হলাম। কোরিয়ায় আমাদের দুটি প্রদর্শনী হয়েছিল। নাটকটি সেখানে প্রশংসিত হয়েছে। পরে নানান জায়গায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে।
“একবার আমরা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাদদেশে নাটকটি মঞ্চস্থ করেছিলাম। কোনো এক ২৫ মার্চ বিকেল বেলায়। এটা দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। ব্যাকগ্রাউন্ডে স্মৃতিসৌধ। আর সেখানে মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। এটা বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।”
এই নাটকটি এখনও দর্শক ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দেখতে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নাটক বলেই দর্শকের মাঝে আগ্রহটা বেশি কাজ করে বলে মনে করেন রামেন্দু মজুমদার।
কোরিয়ায় নাটকটি মঞ্চায়নের স্মৃতি মনে করছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার- “কোরিয়ায় গিয়ে আমার মেকআপ নিয়ে ধারণা পাল্টে গিয়েছিল। কোরিয়ায় আমাদের টিম ছোট করার কারণে আমাকে দুটি চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছিল। কারণ শিল্পী সংখ্যা সীমিত রাখতে হয়েছিল। তাদের মেকআপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি নিজেই তখন নিজেকে চিনতে পারিনি। মেকআপ যে চরিত্রকে কতটা প্রাসঙ্গিক করে তুলে, সেটা কোরিয়ায় গিয়ে প্রথম বুঝেছিলাম। আমাদের দেশে মেকআপের ওপর লেখাপড়া করে জ্ঞানার্জন করা উচিত।”
বিরতি এবং নবরূপে ফেরা
২০০২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ‘কলাকুশলী সংকটের’ কারণে নাটকটির প্রদর্শনী বন্ধ ছিল। ১০ বছর বিরতি দিয়ে ওই বছর থেকে ফের মঞ্চায়ন শুরু হয়। নবরূপে নাটকটির নির্দেশনা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, “তখন মান্নান হীরার লেখা ‘লাল জমিন’ নামে আরেকটি নাটক নির্দেশনা দিয়েছিলাম। সেটিও মুক্তিযুদ্ধের নাটক। একদিন লাল জমিন নাটকটি দেখতে এসেছিলেন রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, ত্রপা মজুমদার এবং থিয়েটার নাট্যদলের আরো অনেকে। তারা আমাকে প্রস্তাব করলেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নির্দেশনা দেওয়ার জন্য।
“এটা আমার জন্য দারুণ অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ বছর পর আমার জন্ম। আমি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি, ইতিহাস পড়েছি। তা আমাকে আলোড়িত করত। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছি। নাটকটি আমরা করেছি, যত কম উপাদান ব্যবহার করে মঞ্চায়ন করা যায়, সেটা মাথায় রেখে। ২০১২ সালে নবরূপে মঞ্চে আসে নাটকটি।”
‘পায়ের আওয়া পাওয়া যায়’ নাটকে শুরু থেকে মেয়ের চরিত্রটিতে ফেরদৌসী মজুমদার অভিনয় করলেও নবরূপে যখন মঞ্চে আসে তখন মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন তারই কন্যা ত্রপা মজুমদার। আর ফেরদৌসী মজুমদার অভিনয় করেন বৃদ্ধার চরিত্রে।
ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, “আমার বয়স বেড়েছে। তখন ভাবনায় এল এটা করবে কে? পরে নাট্যদলের সবাই বললো ত্রপা করবে। সে তো কিছুতেই রাজি না। তার বক্তব্য ছিল, ‘মা, এটা আমি পারব না। তোমার যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, সেটা অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব না’। আমি বলেছি, তুমি পারবে।”
“তবে এটা সত্য, একবার যদি কোনো চরিত্রে কোনো শিল্পী প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় বা জনপ্রিয় হয়ে যায়, তখন আরেকজনের পক্ষে সেটা অতিক্রম করা কঠিন হয়ে যায়। লেখক সৈয়দ হক দেখে গেছেন ত্রপা মজুমদারের অভিনয়।”
বর্তমানে এ নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন ফেরদৌসী মজুমদার, কেরামত মওলা, তোফা হোসেন, ত্রপা মজুমদার, মারুফ কবির, পরেশ আচার্য, সমর দেব, খুরশিদ আলম, নুরুল ইসলাম, রাশেদুল আওয়াল, জোয়ারদার সাইফ, তামান্না ইসলাম, রুনা লাইলা, তানভীর হোসেন সামদানীসহ অনেকে।