গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও তার মর্মার্থ সকল সময়ের সকল মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে কথা বলে।
Published : 21 Mar 2025, 08:42 AM
“কিছুদিন আগে সংবাদ সংগ্রহের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে গিয়েছিলাম। ক্যাম্প-কমান্ডার ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। সেই ব্যস্ততার মুহূর্তে আমার দিকে একটা খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি বসুন। এই খাতাটা পড়ুন বসে বসে।”
জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ ছোটগল্পের শুরুটা এভাবেই। পুরো গল্পে ছোট ছোট সংলাপের মধ্য দিয়ে যে চিত্রকল্প ভেসে ওঠে, তা যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভয়াবহতাকে হাজির করে। আবার লড়াইটা কেন- সেই প্রশ্নও ছুঁড়ে দেয়।
“কিসের জন্য লড়ছি আমরা? এত প্রাণ দিচ্ছি, এত রক্তক্ষয় করছি? হয়ত সুখের জন্য। শান্তির জন্য। নিজের কামনা-বাসনাগুলোকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য। কিংবা শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে। নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। অথবা সময়ের প্রয়োজনে। সময়ের প্রয়োজন মেটানোর জন্য লড়ছি আমরা।”
এই সংলাপের কারণেই গল্পটি চিরকালীন দার্শনিক অনন্যতায় পৌঁছে গেছে বলে মনে করেন সাহিত্যিক ও বিশ্লেষকরা। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও তার মর্মার্থ সকল সময়ের সকল মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে কথা বলে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম মনে করেন, জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি অসামান্য ছোটগল্প।
লেখা আছে অশ্রুজলে বলা হয়ে থাকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য খুব একটা হয়নি। তবে যা হয়েছে, তা-ও নেহায়েত কম নয়। যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে রচিত সেই সব কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটকের কয়েকটি নিয়ে এই বিশেষ আয়োজন। দ্বিতীয় পর্ব জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্প নিয়ে। |
প্রথম পর্ব: পাড়াতলী থেকে কোটি প্রাণে মুক্তি আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়েছিল 'স্বাধীনতা
গল্পটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন দিনের বর্ণনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের যে দার্শনিক দিকটি উন্মোচন করে, তা ‘চিরকালীন’। সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুথানের পর গল্পটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেছে বলেও মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “জহির রায়হান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার সময় কম পেয়েছেন। আমরা জানি তিনি যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই নিখোঁজ হন। তবে অল্প সময়েই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুর্দান্ত কিছু কাজ করেছেন– তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন, সিনেমা নির্মাণ বানিয়েছেন। আর কিছু লেখাও লিখে রেখে গেছেন।”
‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি কেন বিশিষ্ট? মোহাম্মদ আজমের ভাষ্য, “দার্শনিক দিক মূলত গল্পটিকে অনন্য করে তুলেছে এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। গল্পটির শিরোনামের মধ্যেই একটা চিরকালীনতা আছে।
“মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে। কিন্তু ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পে জহির রায়হান প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, আমরা এই লড়াই করছি কেন? আবার গল্পেই বলা হচ্ছে, আমরা আসলে সময়ের প্রয়োজনে লড়ছি। সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থানেও মূলত সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ পথে নেমেছে। সকল প্রগতিশীল আন্দোলনই মানুষ মূলত সময়ের প্রয়োজনে করে। তাই মানুষের সকল লড়াই-সংগ্রামেই গল্পটি অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে।”
কবে লেখা?
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুর থেকে নিখোঁজ হন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক জহির রায়হান। ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি ঠিক কবে লেখা হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে গবেষক ও সাহিত্যিকেরা মনে করছেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন সময়েই জহির রায়হান এই গল্পটি লিখেছেন, যা প্রকাশ্যে আসে তারও প্রায় এক দশক পর।
সাম্প্রতিক সময়ে কাজী জাহিদুল হকের সংগ্রহ ও সম্পাদনায় ‘জহির রায়হানের আত্মকথা ও অন্যান্য রচনা’ এবং ‘যখন যন্ত্রণা অগ্রন্থিত গল্পগুচ্ছ’ নামে দুটি বই প্রকাশ হয়েছে, যেখানে জহির রায়হানের অগ্রন্থিত কিছু লেখা সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছেন জাহিদুল হক।
‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি কবে লেখা হয়েছিল এবং প্রকাশ হয়েছিল- জানতে চাইলে কাজী জাহিদুল হক বলেন, “এটি ঠিক তারিখ ধরে বলা যায় না। তবে যুদ্ধকালীন সময়েই যে লেখা, তা গল্পটি পাঠ করলেই বোঝা যায়। আর মুক্তিযুদ্ধের পর লেখারও সুযোগ ছিল না জহির রায়হানের। বিজয়ের পর দেশে ফিরে সেই সময় ও ফুরসৎ পাননি। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি।”
জহির রায়হানের জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’। তার ছোটগল্পের বড় অংশই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুর পর।
১৯৭৯ সালে সন্ধানী প্রকাশনী থেকে জহির রায়হানের গল্পসমগ্র প্রকাশ হয়, এতে আরো কিছু গল্পের সঙ্গে ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটিও সংকলিত হয়েছে বলে জানান জাহিদুল হক।
তিনি বলেন, “১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমি ‘জহির রায়হান রচনাবলী’ প্রকাশ করে, সেখানেও গল্পটা রাখা হয়েছে। পরে প্রকাশিত আরও অনেক সংকলনে ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি আছে।”
জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সময়ের প্রয়োজনে গল্পটি ঠিক কোন সময়ে লেখা হয়েছিল, এ তথ্যটি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পর প্রথম সন্ধানী থেকেই বেরিয়েছিল। গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বাবার বন্ধু ছিলেন। উনি তখন ‘সচিত্র সন্ধানী’ নামে একটা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন এবং সন্ধানী নামে প্রকাশনাও ছিল তার। বাবার বইগুলো উনিই বের করেছেন। ২০১৭ সালে মারা যান গাজী শাহাবুদ্দিন আহমেদ।”
“মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জহির রায়হানের লেখা প্রবন্ধ আছে, তবে গল্প এই একটিই,” বললেন জাহিদুল হক।
গল্প থেকে মঞ্চনাটক
২০০৫ সালে ঢাকার নাট্যদল থিয়েটার আর্ট ইউনিট মঞ্চে আনে ‘সময়ের প্রয়োজনে’। গল্প থেকে নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ বারী। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে। দেশের বাইরেও নাটকটির একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে।
এর আগে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের একটি পাঠচক্রে গল্পটির ‘পাঠ অভিনয়’ হয়েছিল।
মোহাম্মদ বারী বলেন, “সেই ‘পাঠ অভিনয়’টির নির্দেশনায় ছিলেন প্রশান্ত হালদার। সেটি দেখেই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি নাটক হিসেবে মঞ্চে আনতে। পরে নাট্যরূপ দেওয়া হয়।”
‘সময়ের প্রয়োজনে’ নাটকের শুরু হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ৭ মার্চের ভাষণ, পরে চট্টগ্রাম থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াইয়ের নানা চিত্র উঠে আসে নাটকটিতে।
মোহাম্মদ বারী বলছিলেন, গল্পটির সার্বজনীন ভাষা, আর ছোট ছোট সংলাপই তাকে উৎসাহিত করেছিল এটিকে নাটকে রূপান্তরের কাজে। জহির রায়হান যেন সিনেমার চিত্রনাট্যের মত করেই গল্পটি লিখেছেন।
“‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি পাঠ করলেই একটা চিত্রকল্প ভেসে ওঠে। জহির রায়হান তো সাহিত্যিক, আবার সিনেমার মানুষও ছিলেন। ফলে গল্পটিতে যে সংলাপ লেখা হয়েছে, তা যেন অনেকটা সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো করে ফ্রেম করা।”
গল্পটির সংলাপে আছে- “মেঝেতে পুডিংয়ের মতো জমাট রক্ত। বুটের দাগ। অনেক খালি পায়ের ছাপ। ছোট পা। বড় পা। কচি পা। কতগুলো মেয়ের চুল। দুটো হাতের আঙুল। একটা আংটি। চাপ চাপ রক্ত। কালো রক্ত। লাল রক্ত। মানুষের হাত। পা। পায়ের গোড়ালি। পুডিংয়ের মতো রক্ত। খুলির একটা টুকরো অংশ। এক খাবলা মগজ।”
এই সংলাপের মধ্য দিয়ে যুদ্ধদিনের নৃশংসতার চিত্র যেমন উঠে আসে, আবার যে দেশ স্বাধীন করতে এই যুদ্ধ, সেই যুদ্ধ নিয়েও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়।
মোহাম্মদ বারী বলেন, “কমান্ডার ক্যাম্পে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশ্ন করেছেন- আমরা কেন যুদ্ধ করছি? কেউ বলছে, পাকিস্তানিরা আমাদের স্বজনদের মেরেছে, প্রতিশোধ নিতে চাই। আবার কেউ বলছে, দেশের জন্য যুদ্ধ করছি। তখন কমান্ডার বলছে ‘দেশ তো হলো ভূগোলের ব্যাপার। হাজার বছরে যার হাজার বার সীমারেখা পাল্টায়। পাল্টেছে। ভবিষ্যতেও পাল্টাবে। তাহলে কিসের জন্য লড়ছি আমরা?’
“এই যে প্রশ্নটা এঁকে দেওয়া, এখানেই গল্পটির সার্থকতা এবং অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি। এজন্যই গল্পটি সকল সময়ের মুক্তিসংগ্রামের কথা বলে। সকল সময়ের প্রগতিশীল সকল লড়াই আসলে সময়ের প্রয়োজনেই হয়।”
‘সময়ের প্রয়োজনে’ পাঠ পরিকল্পনার স্মৃতি মনে করে প্রশান্ত হালদার বলেন, “আমরা তখন ইস্কাটন গার্ডেন স্কুলে মহড়া করতাম। মহড়ায় ‘নাটক পাঠ’ হিসেবে এই গল্পটিকে বেছে নিয়েছিলাম। তখন আমরা মোমবাতি জ্বালিয়ে, আর স্কুলের বেঞ্চ আর কাঠ দিয়ে সেট সাজিয়ে সেই পাঠ পর্বটি হয়। সেদিন মূলত গল্পটিই আমরা পাঠ করেছি। পরে মোহাম্মদ বারী গল্পটির নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চে এনেছেন। সেই নাটকে আমি মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে অভিনয়ও করেছি।”
সময়ের প্রয়োজনে গল্পটির ভাষার সহজিয়া রূপ, চিত্রকল্প এবং প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়েই গল্পটি অনন্য হয়ে ওঠেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।
তিনি নিজেও একজন নাট্যকর্মী এবং ‘খনা’সহ বটতলা নামে নাট্য সংগঠনের বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন।
সামিনা বলেন, “যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম বা লড়াইয়ে আমাদের সবার একটা কমন প্রশ্ন থাকে, আমরা কেন এই লড়াই করছি? জহির রায়হান সকলের সেই প্রশ্নটিই গল্পে এনেছেন, আবার তিনি যে উত্তরটি দিয়েছেন, তা চিরকালীন। ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি পাঠ করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা যেমন বোঝা যায়। আবার গল্পটির মধ্যে এক ধরনের সমকালকে অতিক্রম করে যাওয়ার ব্যাপার আছে। গল্পটি সকল সময়ের কথা বলে।”